অটিজমের কবল থেকে বেরিয়ে এসে সুর বাঁধছে ক্ষুদেরা – শ্রীকনা সরকার

Published by

একজন বাবা-মা যখন যৌথ ভাবে সন্তানের জন্ম দেন, তাদের কাছে সে স্বাভাবিক নিয়মেই বাকি দুনিয়ার থেকে ‘স্পেশাল’। সন্তানের তুল্যমূল্য কোনোদিন কোনোকিছুর বিনিময়ে না হয়েছে, না হয়। কিন্তু সন্তানকে নিয়ে বাবা-মায়ের লড়াইটা কঠিনতম হয়ে ওঠে যখন ডাক্তারি পরিভাষায় তাদের ‘স্পেশাল’ বলে অভিহিত করা হয়। স্পেশাল চাইল্ড বা বিশেষ ভাবে সক্ষম শিশুরা, যে আদপেই স্পেশাল তার বাবা মা তার পরিবার এমনকি এই দুনিয়ার একটা গোটা অংশের কাছে, আজও সেটুকু ভাবনা কে মন থেকে গ্রহণ করে উঠতে পারেননি সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ। বিশেষ ভাবে সক্ষম নয়, বরং ক্রমে হয়ে ওঠা যায় স্বাভাবিক ভাবেই সক্ষম ;  শুধু তার জন্য প্রয়োজন একটু সাহচর্য, সঠিক থেরাপি বা ট্রেনিং এবং অনেকটা ধৈর্য্য।

খোদ কলকাতা শহরের বুকে এরকমই বাচ্চাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে ‘সংজ্ঞা’ নামক একটি রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার। গত ১৭ই মে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘সংজ্ঞা’র পঞ্চম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান। করোনা অতিমারীর জেরে ভার্চুয়ালি সারতে হলো এবারের অনুষ্ঠান। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের প্রফেসর ডঃ সোমনাথ সরকার৷ এছাড়াও “হেলথ ইনসাইড” এর তরফ থেকে উপস্থিত ছিলেন হেলথ ব্লগার শ্রীকনা সরকার। সমগ্র অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন সংস্থার সভাপতি শ্রীমতী মিতালী নন্দী৷

শ্রীমতী মিতালী নন্দী – সভাপতি (সংজ্ঞা)

সংজ্ঞা-র কর্মকান্ড প্রসঙ্গে মিতালী দেবী হেলথ ইনসাইড কে জানালেন, ” সংজ্ঞার জন্মটা হঠাৎই। সেই যেন ইচ্ছা হয়ে ছিল মনের মাঝারে। আমরা যারা সংজ্ঞাকে কন্যাসম স্নেহে বড় করার চেষ্টা করছি সকলেই NCC CADETS। ইচ্ছে ছিল দেশের দশের জন্যে কিছু কাজ করার। সেই ইচ্ছেরুপী ছাতা কে সংজ্ঞা বা চেতনা রূপে বাচ্চা বাবা মায়ের সাথী করে তোলাই আমাদের উদ্দেশ্য।২০১৬ সালের ১৭ই মে সংজ্ঞার জন্ম। জন্মলগ্নে কোলে এসেছিল ৫ টি শিশু। আজ প্রায় ৩৫ টি শিশু সংজ্ঞা পরিবারে যুক্ত। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং থেকে শুরু করে কলকাতা হাওড়া এমনকি জামশেদপুর থেকেও বাচ্চারা সংজ্ঞায় আসছে, এতে আমরা সত্যি অভিভূত, ধন্য। এ ছাড়াও বিভিন্ন NCC Camp এ সংজ্ঞার সদস্যরা গিয়ে বর্তমান CADETS দের বোঝানোর চেষ্টা করেন যাতে প্রতিবন্ধকতার হার কমে। একজন প্রতিশপর্ধি মানুষের সাহচর্যে থেকে শিক্ষা নিতে অনুপ্রাণিত করতে শেখানোর চেষ্টা করা হয় এখানে। সংজ্ঞার জন্ম লগ্ন থেকেই যারা সাথে আছেন, যেমন সহ সভাপতি রবি ভাসওয়ানি ছাড়াও বিশেষ সদস্য কুন্তলা , কাশ্মীরা, সিলভেস্টার, সাগর এদের সবার সাহচর্যেই সংজ্ঞা আজ এই বাচ্চাগুলোকে নতুনভাবে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।”

অনুষ্ঠানে সাবলীল ভাবে অংশগ্রহণ করে সংজ্ঞার ক্ষুদে সদস্যরা। তার যাদের কথা উল্লেখ না করলেই নয়, বিহান ব্যানার্জি, আদৃৎ রায় জন্ম থেকেই অটিজমের শিকার, কিন্তু সঠিক ট্রেনিং, কাউন্সেলিং এবং থেরাপির মাধ্যমে অনেকাংশে ফিরেছে স্বাভাবিক জীবনে। আরেক সদস্য ওয়েন্দ্রি ঘোষাল সেরিব্রাল পালসির শিকার, কিন্তু তার উপস্থাপনা পরিষ্কার বলে দেয় জীবনের উপর থেকে কেটে গেছে কালো মেঘ। কনিষ্ক দে, মানসিক প্রতিবন্ধী, নিউজ চ্যানেল গুলি তার নখদর্পনে। উদ্বুদ্ধ হয়েছে এই আকালের সময় রেড ভলান্টিয়ার্স দের কাজে। তাই রেড ভলান্টিয়ার্স সেজে মায়ের প্রতীকী জ্বর মেপে খাইয়ে দিলেন জল, খাবার এমনকি ওষুধও। যার কথা না বললে সংজ্ঞার জার্নি অসম্পূর্ণ থেকে যায়, সে অর্ণব দাস। অর্ণব মাল্টিপল ডিজঅর্ডারের শিকার, আছে অটিজম, মানসিক প্রতিবন্ধকতা, ক্লিনিকাল ব্লাইন্ডনেস। সংজ্ঞার জন্মলগ্ন থেকেই নিয়মিত ট্রেনিং নিচ্ছেন৷ দিব্যি বলে ফেললেন আস্ত একখানা কবিতা। সংস্থার কর্ণধার এবং সভাপতি মিতালী দেবী দীর্ঘবছর ধরে কাজ করছেন বিশেষ ভাবে সক্ষম শিশুদের নিয়ে। এখানে এসে বাচ্চাদের ট্রেনিং, থেরাপি, কাউন্সেলিং সবটাই সামলাচ্ছেন নিজে হাতে৷ হয়ে উঠেছেন তাদের আরেক মা।

কথা বলেছিলাম সংজ্ঞায় নিজেদের সন্তানকে নিয়ে আসা অভিভাবকদের সাথেও। তারা জানালেন তাদের অভিজ্ঞতা এবং লড়াইয়ের এক লম্বা কাহিনী।

ওয়েন্দ্রির মা বিদিশা ঘোষাল জানান, ” আমার মেয়ের ৯০% প্রতিবন্ধকতা ছিল, তাই স্বাভাবিকভাবেই শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিকমতো চালনা করতে পারতো না। সংজ্ঞায় যখন আমরা যাই আমার বাচ্চা ঠিকমতো দাঁড়াতেই পারতো না। ম্যামের সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলি ও এঞ্জয় করতে শুরু করে৷ খুব সাধারণ এবং সহজলভ্য জিনিস দিয়ে থেরাপি করাতেন ওকে। এর ফলে আসতে আসতে ও নিজে থেকে কাজ করার চেষ্টা করে এবং আসতে আসতে ওর নিজের ভয় টাকে জয় করে। ও ছোটোবেলায় চোখে দেখতে পেতো না, সেটাও আসতে আসতে  ঠিক হয়৷ কারোর সাথে মিশতে পারতো না, সংজ্ঞায় ও একটা আলাদা পরিবার পায়। ভেলোর থেকে ব্যাঙ্গালোরের নিমহ্যান্স, চিকিৎসার জন্যে ঘুরেছি সবজায়গা তেই। ভেলোরে আজও ওর চিকিৎসা চলছে। তবে সংজ্ঞা ওর কাছে ক্লাসরুম নয়, বরঙ খেলার মাঠ। এখন অনেকাংশে সুস্থ হোক। নিজে হাতে খাওয়া থেকে শুরু করে নিজের কাজ টুকু সবটাই এখন একা করে। ভাবতে পারিনি, আমাদের জীবনেও এভাবে সুদিন আসবে। ম্যামের থেকে ইন্সপায়ারড হয়ে আমি নিজেও স্পেশাল এডুকেশনে বি.এড করা শুরু করেছি, এই সমস্যা গুলোকে আরও ভালো করে জানার জন্য।”

সার্থকের মা ঝিনুক মুখার্জির অভিজ্ঞতা আবার আরেকটু অন্যরকম। প্রথমদিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন ” আমরা তখন সুইজারল্যান্ডে, সার্থক মোটে তিন, জার্মানির এক ডাক্তার জানালেন আমার ছেলে অটিজমের শিকার, অটিজমের বিশেষ ২০টি বৈশিষ্ট্যই ছিল ওর মধ্যে। আমাদের কাছে রোগটাই পুরো অজানা তখন৷ তারপর কলকাতা ফিরে এসে চেক আপ করাই এবং তার ব্যাঙ্গালোরে নিমহ্যান্স এবং কর্ণাটকে ওর চিকিৎসা চলে। আজও আমার ছেলের কোনো ওষুধের প্রয়োজন হয়না, থেরাপি চলছে এখনও। তারপর কলকাতায় ফিরে ওকে নিয়ে সংজ্ঞাতে আসা৷ আজ চারবছর যাবত মিতালী ম্যামের ব্যবহার, ধৈর্য্য, স্নেহ, মাতৃত্ব,  তাত সহজ সরলভাবে করা থেরাপি সার্থককে অনেক খানি স্বাভাবিক করে তোলে৷ ও অসম্ভব ভালো গান গায় ছোটো থেকেই, পিয়ানো বাজায়, খুব ভালো কবিতা বলে৷ সংজ্ঞা ওর মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করেছে৷ একটা কথা বলা ভীষণ প্রয়োজন, সন্তানদের এই অবস্থা স্বামী-স্ত্রীর কনযুগাল লাইফকে ভীষণ প্রভাবিত করে, এবং বাবা-মায়ের সম্পর্কে এই জটিলতা ওরা খুব ভালো উপলব্ধি করতে পারে৷ তাই নিজেদের সম্পর্ককে সহজ রাখুন  ভালো রাখুন, তাতে ওরাও ভালো থাকবে আরও বেশি। আমরা ধারণাও করতে পারিনা ওরা কতটা বেশি সেনসিটিভ৷ মায়েদের এই কঠিন লড়াইয়ে সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন, তা হলো ধৈর্য্য। “

নিজের অভিজ্ঞতা জানান অয়নের বাবা শুভেন্দু মন্ডল, বললেন ” অয়নকে প্রথম পিয়ারলেসে ট্রিটমেন্ট করাই প্রায় দু’বছর৷ তারপর সংজ্ঞায় নিয়ে আসা ওকে৷ কখনও বন্ধু কখনও টিচার কখনও বা মায়ের মতন কাছে টেনে ওকে সবকিছু শেখালেন। আমার ছেলে আসতে আসতে ফিরে আসছে বাকি বাচ্চাদের মতো স্বাভাবিক জীবনে।”

জামশেদপুর নিবাসী রিক্তা বিশ্বাসের অভিজ্ঞতা মাত্র ছ’মাসের। মাস তিনেক সামনাসামনি থেরাপি করালেও এখন ভরসা অনলাইন কাউন্সেলিং। তার জমজ পুত্র ঋষি ঋদ্ধিকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য এসেছেন সংজ্ঞাতে। তিনি জানালেন ” আমার বাচ্চারা অতিরিক্ত মাত্রায় হাইপার অ্যাক্টিভ ছিল। একজন পড়তে পারে একজন লিখতে। সংজ্ঞাতে ওদের র্যাপিং থেরাপি (Wrapping Therapy) এবং জড়িয়ে ধরে আদর করার মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়েছে, যাতে নার্ভ গুলি সচল হয়। মাত্র এক দেড় মাসেই ওরা অনেক স্বাভাবিক হয়ে গেছিল। আমি ওদের মা, মিতালী ম্যাম যেন আমার মা।”

কেউ কথা বলতে পারেনি, কেউ হাঁটতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধকতা মানসিক। আজও সমাজ এই বাচ্চগুলিকে ‘অ্যাবনরনাল’ বা ‘পাগল’ বলে দেগে দেয়। কিন্তু সঠিক পদ্ধতিতে থেরাপি, কাউন্সেলিং আর একটু সহানুভূতির মাধ্যমেই তারা ফিরে আসছে স্বাভাবিক জীবনে৷ মাতৃত্বের ছোঁয়াচ দিয়ে নতুন পথের দিশা দেখাচ্ছে ‘সংজ্ঞা’। বেঁধে বেঁধে চলার পথে সামিল হচ্ছে বাবা মায়েরা। এখানে সবাই সবার বন্ধু, পথ চলার সাথী।

Srikona Sarkar

As a Student of Science, I found the subject of both mental and physical wellness quite intriguing in my school days, Which was further sharpened with the completion of Graduation in Molecular Biology in my College. As The whole world, right now is battling with the greatest pandemic of human civilization, I cannot help myself from helping out people by providing the exact solution for their mental and physical profoundness so that, they can always discover a new tunnel of hope and light, even when their movement is restricted within the boundary of the walls.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago