ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

Published by

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে?

ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ ব্যাধি। ব্রেনে প্রচুর রক্তজালিকা থাকে তা ব্রেনের কোষে কোষে পুষ্টি উপাদান সহ অক্সিজেন সরবরাহ করে।

কোনও কারণে ব্রেনের রক্তবাহী নালিকায় রক্তসঞ্চালন বাধা পেলে তখন ব্রেনের ওই জায়গার কোষ নষ্ট হয়ে যায় ও ব্রেনের কাজকর্মে গন্ডগোল দেখা যায়। সেই কারণেই হয় স্ট্রোক।

ব্রেনের কোষে কোষে এভাবে রক্ত সঞ্চালন দু’ভাবে বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে— ইস্কিমিক স্ট্রোক আর হেমোরেজিক স্ট্রোক। ইস্কিমিক স্ট্রোক হল ধমনীর অন্দরে যে রক্ত সঞ্চালন হয় সেখানে ক্লট বেঁধে গিয়ে অবস্ট্রাকশন তৈরি করে সামনের দিকে আর রক্ত সঞ্চালন হয় না। এই সমস্যাকেই আমরা ইস্কিমিক স্ট্রোক বলে থাকি। সিটি স্ক্যান করালে ব্রেনে স্ট্রোক হওয়া অংশগুলিকে কালো দেখায়।

আর এক ধরন হল হেমোরেজিক স্ট্রোক যেক্ষেত্রে ধমনী বা রক্তবাহী নালী ফেটে গিয়ে ব্রেনের অন্দরে রক্তক্ষরণ হয়। এর ফলে ব্রেনে প্রেশার পড়ে। ওই চাপের কারণেই রক্তপ্রবাহ বাধা পায় ও ওখানকার কোষগুলি মারা পড়ে। এই ধরনের সমস্যাগুলিকে হেমোরেজিক স্ট্রোক বলা হয়। দেখা গিয়েছে পশ্চিমী দেশগুলিতে প্রায় ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই হয় ইস্কিমিক স্ট্রোক । আর ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে হয় হেমোরেজিক স্ট্রোক।

অন্যদিকে আমাদের দেশে প্রায় হেমোরেজিক স্ট্রোক আর ইস্কিমিক স্ট্রোক-এর অনুপাত প্রায় ৫০:৫০।

আর তার পিছনে মূল কারণ হল, ভারতীয়দের মধ্যে ব্লাড সুগার, হাই ব্লাড প্রেশারের ঘটনা অনেক বেশি। আর যত বেশি সুগার এবং উচ্চ রক্তচাপ বাড়বে তত বেশি হেমোরেজিক স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পাবে। সেই কারণে দেখা গিয়েছে আমাদের দেশে ৪০-৫০ বছর বয়স থেকেই স্ট্রোক হতে শুরু করে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় হেমোরেজিক স্ট্রোক।

আমাদের দেশে, মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ হল স্ট্রোক। আর পঙ্গুত্বের প্রথম এবং প্রধান কারণ। দেখা গিয়েছে স্ট্রোক থেকে বেঁচে ওঠা ব্যক্তির মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ পঙ্গুত্বের শিকার হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় একদিকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়া, স্মৃতি নষ্ট হওয়া, কথা বলার ক্ষমতা হারানো, অন্য ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে অক্ষমতা ইত্যাদি। রোগীর মধ্যে অনেকেই শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। কেউ কেউ হাঁটাচলা হয়তো করতে পারেন তবে স্বাভাবিক কর্মজীবনে ফিরতে পারেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ৪০-এর পরেই বছর বয়সে স্ট্রোকের সমস্যা বেশি হয়। তাই আমাদের স্ট্রোকের ঝুঁকিগুলি সম্পর্কে জানতে হবে।

ব্রেন স্ট্রোকের লক্ষণ

স্ট্রোক হলে ছ’টি বিষয় মাথায় রাখতে হয় আর তা হল— বি ই এফ এ এস টি (BE FAST)।

বি (B) : ব্যালেন্স বা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করাও মনে হল যেন শরীরের ভারসাম্যের অভাব ঘটছে! এমন ঘটনাও হতে পারে স্ট্রোকের লক্ষণ।

ই (E) : ই ফর আই। এতের হঠাৎ করে দৃষ্টিশক্তি ঝপসা হয়ে গেলে তাও হয়ে যেতে পারে স্ট্রোকের আশঙ্কা।

এফ (F) : মুখ বেঁকে যেতে পারে।

এ (A) : আর্ম বা হাত। যে কোনও একদিক বা দু’দিকের হাত অবশ হয়ে যায়।

এস (S) : স্পিচ বা কথা জড়িয়ে যায়। কথা বলতে না পারা বা বুঝতে না পারা।

টি (T) : টাইম বা সময়। উপরিউক্ত তিনটি লক্ষণ দেখলে সময় নষ্ট না করে রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কারণ স্ট্রোক হওয়া মানেই ব্রেনের কোষ নষ্ট হচ্ছে। যত বেশি কোষ নষ্ট হবে তত বেশি পক্ষঘাতগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে রোগীর।

রোগ নির্ণায়ক পরীক্ষা

রোগীকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার পর করাতে হবে সিটিস্ক্যান। ছবিতে হেমোরেজিক স্ট্রোক হলে জায়গাটি সাদাভাবে দেখা যায়। ইস্কিমিক হলে কালোভাবে অংশটি নজরে আসে।

কী কী বিষয় বাড়িয়ে দেয় স্ট্রোকের আশঙ্কা?

  • উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেশার। দেখা গিয়েছে যতজন ব্যক্তির স্ট্রোক হয় তাদের মধ্যে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন। এমনকী অনেকে বুঝতেও পারেন না যে ব্লাড প্রেশার বাড়ছে। কারণ ব্লাড প্রেশার বৃদ্ধির কোনও লক্ষণ নেই। ফলে উচ্চ রক্তচাপকে অনেকেই সাইলেন্ট কিলার হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। দেখা গিয়েছে হাই ব্লাডপ্রেশার থাকলে ব্রেনে ছোট ছোট অনেক স্ট্রোক হতে থাকে। এমনকী তার কোনও প্রভাব তৎক্ষণাৎ শরীরে দেখা যায় না। অথচ একসময় দেখা যোয় ৫৫-৬০ বছরের এক ব্যক্তি ধীরে ধীরে সাধারণ বিষয়গুলি ভুলতে শুরু করেন। হাঁটাচলা সীমিত হয়ে যায়। এই ধরনের সমস্যাকে ভাসকুলার কগনেটিভ ইমপেয়ারমেন্ট বা ভাসকুলার ডিমেনশিয়া। সার পৃথিবীতেই এই ধরনের ডিমেনশিয়ার সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ আমরা খুব সহজেই বিষয়টি প্রতিরোধ করতে পারি। বিশেষ করে যাঁদের বাড়িতে বাবা-মায়ের রক্তচাপ থাকার ইতিহাস রয়েছে, রয়েছে কম বয়সে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ইতিহাস রয়েছে, সেই পরিবারের সুস্থ সন্তানদের অবশ্যই উচিত ৩০ বছর বয়স থেকে ব্লাড প্রেশার মাপা।

আর ব্লাড প্রেশার ধরা পড়লে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে খেতে হবে ওষুধ। নিজে নিজে ওষুধ বৱন্ধ করবেন না।

  • হাই কোলেস্টেরল বা রক্তে জাতীয় পদার্থের মাত্রা বেড়ে যাওয়াও স্ট্রোকের আশঙ্কা বাড়িয়ে যায়।
  • হার্টের ছন্দের গন্ডগোল বা এট্রিয়াল ফিব্রিলেশনের সমস্যাও বাড়িয়ে দিতে পারে স্ট্রোকের সমস্যা।
  • অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস নিঃসন্দেহে সমস্যা হওয়ার পিছনে অন্যতম কারণ।
  • স্থূলত্ব একটা বড় সমস্যা। বিশেষ করে বিএমআই যাঁদের বেশি থাকে তাঁদেরও স্ট্রোকের সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা থেকে যায়।
  • আজকাল কেউই এক্সারসাইজ করতে চান না। অথচ মশলাদার, তৈলাক্ত খাদ্য খাওয়ার প্রতি কারও অরুচি নেই। সুতরাং আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা প্রচুর খাবার খান, অথচ কায়িক শ্রমের বালাই নেই। ফলে সব ধরনের সমস্যা শরীরে বাসা বাঁধার আশঙ্কা থাকে যা আবার স্ট্রোকের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়।
  • যে কোনওরকম ভাবে তামাক সেবন বাড়িয়ে দিতে পারে স্ট্রোকের আশঙ্কা। অর্থাৎ ধূমপান, গুটকা সেবন সবই স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপানের এই কু’অভ্যেস মহিলাদের মধ্যে ধূমপানের আশঙ্কা দিচ্ছে বাড়িয়ে। দেখা গিয়েছে যত স্ট্রোক হয় তার মধ্যে ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রেই স্ট্রোকের শিকার হন মহিলা।
  • রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজ, কিছু সংক্রমণ ইত্যাদি থেকেও স্ট্রোক হয়।

মনে রাখবেন—

কিছু সমস্যা আমাদের হাতে নেই বা আমরা চাইলেও সেগুলির কোনও পরিবর্তন করতে পারব না। তবে বেশি কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলির রাশ রয়েছে আমাদের হাতেই, যেমন ধূমপান, মদ্যপান না করা, অতিরিক্ত ভাজাভুজি না খাওয়া, এক্সারসাইজ করা, সুষম খাদ্যগ্রহণ করা ইত্যাদি। দৈহিক ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখাও একটা বড় বিষয়।

Dhruba Biswas

Hi, I am Dhruba and I’m a Health Blogger. My goal is to make everyone aware of physical and mental health as well as new methods and technologies in the field of medical science.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

গলব্লাডার স্টোন ওষুধে কি গলে যায়?

গলব্লাডার স্টোন বলতে কী বোঝায়? বাংলায় গলব্লাডারের অর্থ হল পিত্তথলি। লিভারের সঙ্গে যুক্ত থাকা একটি…

4 months ago