ভালো ঘুম উত্তম জীবনের চাবিকাঠি

Published by

এ কথা একদম সত্যি যে ধারাবাহিক ভালো ঘুম জীবনের মানকে উন্নত করে তোলে। তার কারণ, ভালোভাবে ঘুমনোর ওপরে সুখ এবং ভালো থাকা অনেকটাই নির্ভর করে। দীর্ঘ দিন ধরে নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমোতে যাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুললে ভালো ঘুম হয়। তাঁদের মতে, ভালো বা গভীর ঘুম হচ্ছে কিনা সেটাই বড় কথা। নিদ্রা কত দীর্ঘ সেটা জরুরি নয়।

Czech Household Panel Survey নামে একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এই সব তথ্য পাওয়া গেছে। আগে এই বিষয়ে গবেষণা থেকে জানা গিয়েছিল যে নিদ্রার মানের সঙ্গে ব্যক্তির সামগ্রিক ভালো থাকার যোগসূত্র আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক এই সমীক্ষাই প্রথমবার জীবনের মানের ওপরে সোশাল জেট ল্যাগের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করল। সেই সঙ্গে এই সমীক্ষা জানতে চেয়েছে যে নিদ্রার দৈর্ঘ্য,মান এবং সময়ে পরিবর্তন কিভাবে দীর্ঘ দিনের জন্য ব্যক্তির জীবনের মানকে প্রভাবিত করে।

এই নিরীক্ষণ চালানোর সময়ে জীবনের সন্তুষ্টি, ভালো থাকা, সুখ, সমীক্ষার আওতায় থাকা প্রত্যেকের  স্বাস্থ্য এবং কাজের চাপ নিয়ে কতকগুলি প্রশ্ন করা হয়। এ ছাড়া নিজের ঘুম কতক্ষণ স্থায়ী হয়, কেমন ঘুম হয় এবং ঘুমের সময় অথবা ‘সোশাল জেট ল্যাগ’ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। এই সব প্রশ্নের উত্তরগুলিকে তুলনা করে দেখে সমীক্ষাকারী দলটি।

সোশাল জেট ল্যাগ কাকে বলে ?

সামাজিকতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ঘুমের নিজস্ব ধাঁচ আর একান্ত শারীরবৃত্তীয় (বায়োলজিকাল) নিদ্রার ধাঁচ যখন মেলে না, সেই অবস্থাকে সোশাল জেট ল্যাগ বলা হয়। কোনও মানুষ রাতের শিফটে চাকরি করলে অথবা একেক দিন একেক শিফটে বা সময়ে কর্মক্ষেত্রে গেলে এরকম হতে পারে।

সমীক্ষার সঙ্গে জড়িত গবেষকদের মতে, নিদ্রার মান কাজের চাপ ছাড়া জীবনের পাঁচটি মানদণ্ডের সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণভাবে জড়িত। এই সংযোগ এতটাই গভীর যে এই পাঁচ মানদণ্ডে কোনও হেরফের হলে, ঘুমের মানও পাল্টে যায়। বিষয়টিকে অন্যভাবেও বলা যায়। নিদ্রার দৈর্ঘ্য অথবা সোশাল জেট ল্যাগ দীর্ঘ কাল ধরে জীবনের মানকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে না।

তিন বছর ব্যাপী এই সমীক্ষা চালানোর সময়ে গবেষণারত টিম একটি ব্যাপার সম্পর্কে সচেতন ছিল। তা হল- সোশাল জেট ল্যাগের বেশ কয়েকটি কারণ আছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কোনও ব্যক্তি একটি নতুন চাকরি পেলেন। পুরনো চাকরির সময় আলাদা ছিল। নতুন চাকরিতে অন্য রকম শিফট। এরকম ঘটনা কোনও ব্যক্তির জীবনেই ঘন ঘন হয় না। ব্যক্তির জীবনে স্বল্পস্থায়ী নিদ্রা ও সোশাল জেট ল্যাগের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসার জন্য তিনটি বছর যথেষ্ট নয়। সেই সঙ্গে কোভিড মহামারীর জন্য সমীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল সংগ্রহের ওপরেও অকল্পনীয় প্রভাবও পড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা নিদ্রার মান সংক্রান্ত এই সমীক্ষা নিয়ে কি বলছেন

নিউ ইয়র্ক শহরের নিউরোসাইকোলজিস্ট সনম হাফিজ এ ব্যাপারে বক্তব্য রেখেছেন। তাঁর মতে, বিরাট সংখ্যক লোকজনের মধ্যে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। সুতরাং ব্যক্তির ভালো থাকার ওপরে নিদ্রার মানের প্রভাব সম্পর্কে এই সমীক্ষা আশাব্যঞ্জক।

তিনি বলেছেন যে মনের ক্রিয়াকলাপ ও স্নায়বিক সমস্ত ব্যাপারের ওপরে ভালো ঘুম না হওয়ার একাধিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সাইকিয়াট্রিস্টরা দীর্ঘ দিন ধরেই ভাবনাচিন্তা করে আসছেন। তবে অন্তত অতিমারীর সময়ে সমীক্ষাটির একটি অংশ করা হয়েছিল বলে সেই তাৎপর্য পাল্টে গিয়েছে। তার কারণ কোভিডের সময়ে ব্যক্তির লাইফস্টাইল ও কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত লাইফস্টাইল উল্লেখযোগ্য ভাবে পাল্টে গিয়েছিল।

তার ওপর, চেকোস্লোভাকিয়ার সংস্কৃতি ও আমেরিকার সংস্কৃতির মধ্যে খানিকটা মিল থাকলেও দুটি পুরো এক রকম নয়। তার ফলে মনে প্রশ্ন জাগে, এই সমীক্ষার ফলাফল আমেরিকার মানুষের ক্ষেত্রেও কি একই রকম বলে গ্রাহ্য করা যেতে পারে?

শেলবি হ্যারিস নামে এক ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট জানিয়েছেন, সামগ্রিকভাবে জীবনের মান বাড়ানোর জন্য ঠিক মতো ঘুম এবং ভালো ঘুম, দুটোই দরকার। সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও সুখ বজায় রাখার জন্য নিয়মিত ভালো ঘুম অত্যাবশ্যক। ভালো ঘুম হলে মেজাজ ভালো থাকে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও সমন্বয় ক্ষমতা বাড়ে। জীবনের মানও উন্নত হয়।

অন্য দিকে ঠিক মতো ঘুম না হলে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। কোনও তথ্য জেনে সেটিকে মাথায় রাখা, ঠিক সময়ে মনে করা ও কাজে লাগানোর সময় অসুবিধা হয়। একে কগনিটিভ প্রসেসিং এর সমস্যা বলা হয়। এছাড়া পর্যাপ্ত ঘুম না হলে হার্টের (কার্ডিওভাস্কুলার) রোগ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে যথেষ্ট ঘুমের অভাবে আরো বেশ কয়েকটি গুরুতর শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। 

ভালো অর্থাৎ গাঢ় ও টানা ঘুম না হওয়ার সঙ্গে ব্যক্তির শারীরবৃত্তীয় ব্যাপারগুলির পাশাপাশি বংশগত সমস্যা, শরীরের কাঠামো এবং কয়েকটি রাসায়নিক বিষয়ও জড়িত থাকে। সব মিলিয়ে কিছু কারণ চিহ্নিত করা গিয়েছে।

ঠিকমতো ঘুম না হওয়ার কারণ

১. মানসিক চাপ।

২. ধূমপান।

৩. স্লিপ অ্যাপনিয়া বা ঘুমের সময় বারবার নি:শ্বাস বন্ধ ও খুলে যাওয়া।

৪. ওজন বেড়ে যাওয়া।

৫. সম্পর্কের চাপ জাতীয় সাইকোসোশাল স্ট্রেসর বা সমস্যা যার মধ্যে আর্থিক সংকট, প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্কে টানাপোড়েন, বিবাহিত জীবনের সমস্যা ইত্যাদি অনেক কিছুই থাকতে পারে।

৬. একদমই শারীরিক কসরত না করা।

সাইকিয়াট্রিস্টরা বলছেন, পরপর কয়েকটি সপ্তাহ ভালো ঘুম না হলেই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিৎ।

ভালো ঘুম হওয়ার জন্য কয়েকটি পরামর্শ:

১. রোজ রাতে একই সময়ে একই শয্যায় ঘুমোলে ভালো ঘুম হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।

২. সকালে ঘুম ভাঙার পর চোখেমুখে যত বেশি সম্ভব প্রাকৃতিক আলো লাগে ততই ভালো। ঘুম ভেঙেই সূর্যের আলোর সংস্পর্শে এলে জাগ্রতভাব বাড়ে এবং শরীরের circadian cycle (নিদ্রা ও জাগরণের চক্র) নিয়ন্ত্রণে আসে, যার ফলে ভালো ঘুম হয়।

৩. রাতে শোওয়ার আগে কতকগুলি নিয়ম মেনে চলা উচিৎ। শোওয়ার আট ঘন্টা আগের সময়ের মধ্যে কফি চলবে না। মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে শোওয়ার তিন ঘন্টা আগে সেরে ফেলতে হবে। শুতে যাওয়ার আগে তিরিশ মিনিট বা বড়জোর এক ঘন্টার বেশি মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি ও টিভি দেখা চলবে না।

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago