মাথা ঘোরা থেকে মুক্তির উপায় (Dizziness)

Published by

এক এক সময় মনে হচ্ছে আমার সাথে গোটা ঘরটাই ঘুরছে।এই  মাথা ঘোরা থেকে মুক্তির উপায় কী?  

মাথা ঘোরা দু-ধরণের হয়, ভার্টাইগো এবং ডিজিনেস।আপনি কোন রোগের শিকার?  

মাথা ঘোরার প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে ‘মাথা ঘোরা’ কে সাধারণত ডাক্তারি পরিভাষায় দুটি নামে অভিহিত করা হয়। ভার্টাইগো এবং ডিজিনেস ৷ এই দুটি ক্ষেত্রেই বেশিরভাগ লক্ষণ গুলো এক থাকলেও মাথা ঘোরার প্রকৃতি আলাদা হয়।এছাড়া মাথা ঘোরার কারণেও কিছু তারতম্য লক্ষা করা যায়।

ডিজিনেসের ক্ষেত্রে সাধারণত নিজেকে সাময়িক ভাবে ভারসাম্যহীন মনে হয়। মাথা একেবারে হালকা হয়ে যায়, বিঘ্নিত হয় শরীরের স্বাভাবিক ভারসাম্য। সেই অবস্থায় রোগী মনে করেন তার চারপাশ টা তার সাথে  ঘুরছে চারিদিকে এবং তিনি তৎক্ষনাৎ অজ্ঞান হয়ে যাবেন।

কখনও কখনও এর সাথে বমি বমি ভাব বা বমি হওয়ার ঘটনাও দেখা যায়। ডিজিনেস আসলে কোনো মেডিকেল কন্ডিশন নয়, বরং শরীরে বাসা বেঁধে থাকা কোনো রোগের কারণেই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়।

তাহলে ‘ডিজিনেস’ এর কারণ টা কি? কেন হয় এরকম মাথা ঘোরার সমস্যা?

তার সম্ভাব্য কিছু কারণ অবশ্য আছে।

যেমন :

  • বিনাইন পারঅক্সিজমাল পজিশনাল ভার্টাইগো (BPPV)
  • Hypoglycemia ( লো ব্লাড সুগার)
  • Hypotension ( রক্তচাপের মাত্রা কমে যাওয়া)
  • নিয়মিত নেওয়া কিছু ওষুধের ব্যবহারের জন্য।
  • অন্তকর্ণের সমস্যা।
  • রক্ত পরিবহনের সমস্যা।
  • এছাড়াও কিছু শারীরিক সমস্যা, যেমন, রক্তাল্পতা, মাইগ্রেন অথবা দুশ্চিন্তা।
  • স্ট্রোক।
  • মোশন সিকনেস (ট্রেন বা প্লেনে চড়ার সময় অনেকে এর শিকার হন, লিফট বা নাগর দোলাতে উঠলেও হয়)
  • মাথায় কোনো আঘাত।
  • এছাড়াও কিছু সাধারণ অসুখ যেমন ঠান্ডা লাগা, সর্দি, সাইনাস।

বিনাইন পারঅক্সিজমাল পজিশনাল ভার্টাইগো (BPPV) ভেস্টিবুলার সিস্টেমের স্বাভাবিক বার্ধক্যের কারণে, কানের অভ্যন্তরের কোনো আঘাত, ধমনীতে রক্ত ​​সঞ্চালনের সমস্যা বা মাইগ্রেন ইত্যাদি থেকে হতে পারে। এটি মস্তিষ্কের স্বাভাবিক অবস্থান কে বিঘ্নিত করে। BPPV -র কারণে মাইল্ড থেকে সিভিয়ার ডিজিনেসের সমস্যা দেখা দেয়।

রক্তে সুগারের মাত্রা কমে গেলে মাথা ঘুরতে পারে। এর চিকিৎসা হল রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা। বারে বারে অল্প সময়ের ব্যবধানে হাল্কা এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খেলে রক্তের সুগারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

যারা উচ্চ রক্তচাপ জনিত সমস্যায় ভোগেন, তারা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ওষুধ খান। আর অনেক ক্ষেত্রেই এই ওষুধ হাইপোটেনশন এর মত শারীরিক আকৃতি সৃষ্টি করে৷

যেকোনো ওষুধ জনিত কারণে যদি ‘ডিজিনেস’র সৃষ্টি হয় সেক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে৷

এছাড়াও বেশ কিছু সমস্যার কারণে ডিজিনেস তৈরি হয়।

কানের ভিতরের অংশে অর্থাৎ ইনার ইয়ার (Inner Ear)-এ ইনফেকশন হলে Labrynthitis হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে কানে জ্বালা জ্বালা ভাব অনুভূত হতে পারে। এর ফলে নার্ভাস সিস্টেমে এর প্রভাব পড়ে। যার ফলে শরীরের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়৷ এই সমস্যা থেকে ডিজিনেসের মত অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

ডিহাইড্রেশন একটি বড় ফ্যাক্টর ডিজিনেসের ক্ষেত্রে। শরীরে জলের অভাব হলে হঠাৎ করে মাথা ঘুরে যায়। চোখ বা দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে।

এছাড়াও ডিজিনেসের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ফ্যাক্টর ভীষণ ভাবে কাজ করে।

যেমন :

অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা

 মেয়েদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা ভীষণ ভাবে দেখা যায়। অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড খাওয়া, সঠিক ডায়েট অনুযায়ী খাবার না খাওয়া, অনিয়মিত মেন্সট্রুয়েশন এর বড় কারণ৷

এছাড়াও শরীরে আয়রনের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণেও ডিজিনেস সৃষ্টি হয়।

অ্যাংজাইটি বা দুশ্চিন্তা

 মানসিক স্বাস্থ্য ডিজিনেসের ক্ষেত্রে একটি বড় ফ্যাক্টর৷ যারা এর অ্যাংজাইটি থেকে মুক্তি পেতে নিয়মিত ওষুধ খান, সেই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াতেও ডিজিনেসের মত অবস্থার সৃষ্টি হয়।

স্নায়বিক রোগ

 বেশ কিছু স্নায়ু জনিত রোগ আছে যার ফলে শরীরের স্বাভাবিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে মানুষ। এর মধ্যে দেখা দেয় ডিজিনেজের মতো সমস্যা। যেমন – পারকিনসনস

 মাথা ঘোরা থেকে মুক্তির উপায় কি?

ওষুধ ছাড়াও বেশ কিছু ঘরোয়া উপায় অবশ্য আছে, যার ফলে অনেকাংশে মুক্তি পাওয়া যায় ডিজিনেসের মত সমস্যা থেকে৷

পর্যাপ্ত জল

আগেই বলা হয়েছে যে মাথা ঘোরার পিছনে একটি অন্যতম কারণ হিসেবে ডিহাইড্রেশানকে দায়ী করা যেতে পারে। তাই সারাদিনে পর্যাপ্ত পরিমাণ  জল পান করা ভীষণ ভাবে জরুরী। জল শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে এবং মাথা ঘোরার সমস্যাও অনেকাংশে নিরাময় করে।

আদা

আদার ব্যবহার মাথা ঘোরা দূর করার ক্ষেত্রে উপকারী বলে মনে করা হয়। একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুসারে জানা যায় যে আদায় রয়েছে বিশেষ ঔষধী গুণাবলী। যদি কোথাও ঘুরতে যাওয়ার সময় আদার টুকরো মুখে রাখা যায় তাহলে এটি মোশন সিকনেশ (মাথা ঘোরার একটি অন্যতম প্রধাণ কারণ) এর সমস্যাও সমাধান করতে সাহায্য করে। এছাড়াও আদা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্যযুক্ত হয় যা মাথা ঘোরার সমস্যার ক্ষেত্রে খুবই উপকারী বলে গণ্য করা হয়।

আদা টুকরো করে কেটে নিতে হবে। এবার ট্রেন/ প্লেন / গাড়িতে ওঠার আগে মুখে ঐ আদার টুকরো রেখে সেটা চিবোতে হবে।

পাতিলেবু / কমলালেবু

মাথা ঘোরার সমস্যা প্রতিকারের জন্য যেকোনো লেবুর ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি বৈজ্ঞাণিক গবেষণা সূত্রে জানা যায় যেকোনো প্রকার লেবু গ্রহণ করার ফলে বমি ভাব কমে যায় একইসাথে মাথা ঘোরার প্রবণতাও অনেকটাই হ্রাস পায়। পাতিলেবু বা কমলালেবু পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে, যা Meniere’s disease থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে৷

ভিটামিন ই

ভিটামিন ই সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করলে সমগ্র শরীরে রক্তের পরিবহন সংক্রান্ত সমস্যা দূর হয়। যার ফলে ডিজিনেসের মতো সমস্যা সৃষ্টি হতে পারেনা।

নানাপ্রকার অরগ্যানিক শষ্য বীজ, বাদাম, কিউই, পালংশাকে ভরপুর ভিটামিন ই থাকে।

ভিটামিন ডি

ভিটামিন ডি BPPV র মতো সমস্যাকে প্রতিহত করে।

আয়রন

রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়ার মত সমস্যা দেখা দিলে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার বা আয়রন ট্যাবলেট ডিজিনেস থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে৷

খাসি বা মুরগীর মাংস এবং ডিম, বিনস, সবুজ শাক সবজি রক্তে আয়রনের মাত্রা বৃদ্ধি করে।

তাহলে কী ওষুধের প্রয়োজন নেই?

অবশ্যই আছে। কিন্তু ওষুধ সাধারণত দেওয়া হয়, যে শারীরিক সমস্যা থেকে ডিজিনেস সৃষ্টি হচ্ছে তার প্রকোপ কমানোর জন্য।

যেমন মাইগ্রেনের জন্য ডিজিনেস সৃষ্টি হলে মাইগ্রেনের প্রকোপ কমানোর জন্য ওষুধ দেওয়া হয়। আবার অ্যাংজাইটি থেকে মুক্তি পেতে দেওয়া হয় অ্যান্টি ডিপ্রেশন এর ওষুধ।

এছাড়াও ডাক্তাররা কিছু ওষুধ দিয়ে থাকেন, যেমন

 অনেক সময় কানের সংক্রমণ বা প্রদাহের কারণেও মাথা ঘুরতে দেখা যায়। যাকে Meniere’s disease নামে অভিহিত করা হয়। এমন ক্ষেত্রে ডাইউরেটিক ওষুধ (মূত্র বর্দ্ধক) সেবন করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

চিকিৎসকের পরামর্শ মতো অ্যান্টিকোলিন এবং অ্যান্টিহিস্টামিন ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে।

এছাড়াও আকুপাংচার বা ফিজিক্যাল থেরাপির মাধ্যমেও মুক্তি পাওয়া যায় ডিজিনেস থেকে। আকুপাংচার এবং ফিজিক্যাল থেরাপি বা মানসিক চিকিৎসার সাহায্যে মাথা ঘোরার চিকিৎসা করা হয়। ফিজিক্যাল থেরাপির মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভেস্টিবুলার রিহাবিলিটেশান এর সহায়তা নেওয়া হয়। যা শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।

ব্যায়ামের প্রয়োজন

ব্যায়ামেরও প্রয়োজন আছে, তবে তা অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী।

যেমন Epley Maneuver.

সাধারণত বিনাইন পারঅক্সিম্যাল পজিশনাল ভার্টাইগো এবং ডিজিনেস থেকে মুক্তির জন্য ডাক্তার রা এই উপায় টি অবলম্বন করতে বলেন ৷ বাড়িতে বসে খুব সহজেই করা যায় এই প্র্যাকটিস।

একটি সমান্তরাল জায়গায় সোজা হয়ে পিছনে বালিশ দিয়ে শুয়ে পড়ুন

পা দুটো কে একদম সোজা করে দিন।

এবার মাথাটাকে আস্তে আস্তে ডানদিকে ৪৫° কোণে ঘোরান।

মাথা টাকে ওভাবে উঁচু রেখে বালিশ দিয়ে সাপোর্ট দিন এবং এভাবে ৩০ সেকেন্ড অপেক্ষা করুন৷

এবার পুরো ৯০° কোণে মাথা টাকে ডানদিকে নিয়ে যান, কিন্তু ঘাড় নাড়াবেন না।

এবার সম্পূর্ণ শরীরের শক্তি দিয়ে মাথা সহ শরীর কে বাঁদিকে করুন৷

এবার ধীরে ধীরে প্রাথমিক অবস্থায় ফিরে সামনে তাকিয়ে সোজা হয়ে উঠে বসুন।

মনে রাখবেন, এই ব্যায়ামটি তখনই করবেন, যদি আপনার ডিজিনেসের সমস্যা ২৪ ঘন্টার বেশি স্থায়ী হয়৷ সেক্ষেত্রে প্রতিদিন একবার করে এই ব্যায়ামটি প্র্যাকটিস করুন।

Srikona Sarkar

As a Student of Science, I found the subject of both mental and physical wellness quite intriguing in my school days, Which was further sharpened with the completion of Graduation in Molecular Biology in my College. As The whole world, right now is battling with the greatest pandemic of human civilization, I cannot help myself from helping out people by providing the exact solution for their mental and physical profoundness so that, they can always discover a new tunnel of hope and light, even when their movement is restricted within the boundary of the walls.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago