সৃষ্টির হাতে যোগ্য সম্মান পেলেন স্রষ্টা – উন্মোচিত হলো ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তি

Published by

মাতৃত্বের স্বাদ পেতে স্বাভাবিক সন্তানধারণ এমনিতেই এক চিরাচরিত মাধ্যম৷ কিন্তু শারীরিক বা বয়সজনিত নানা সমস্যার কারণে বাধা হয়ে দাঁড়ায় স্বাভাবিক সন্তানধারণ৷ বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে সন্তান নিতে ইচ্ছুক দম্পতির জীবনে এক আশীর্বাদ হয়ে এসেছে ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন বা আইভিএফ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে সৃষ্ট ভ্রুণকে বলা হয় টেস্ট টিউব বেবি বা নলজাতক শিশু।

সময় পেরিয়েছে ৪৩ বছর, এক নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল এই ভারতবর্ষের বুকে৷ অন্য কোথাও নয় খোদ কলকাতাতেই ঘটেছিল এমনটা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, যিনি সেই বিপ্লবের মূল কান্ডারি ছিলেন, আজও তাঁর ভাগ্যে সেই অর্থে জোটেনি কোনও সরকারি স্বীকৃতি। বরং অপমানে,  লাঞ্ছনায় জর্জরিত মানুষটা একদিন বেছে নিয়েছিলেন আত্মহত্যার পথ। তিনি ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মৃত্যুর ৪০ বছর পর, এই প্রথম যার আবক্ষ মূর্তি বসল নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে। শুক্রবার (১লা অক্টোবর, ২০২১) সেই মূর্তির আবরণ উন্মোচন করলেন, সেদিন সুভাষবাবুর হাত ধরে জন্ম নেওয়া দেশের প্রথম নলজাতক শিশু দুর্গা ওরফে কানুপ্রিয়া আগরওয়াল।

পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের অন্যতম সুপ্রজননবিদ ডক্টর গৌতম খাস্তগীর এর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন তাঁর বাবা প্রভাত আগরওয়াল ও। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে আপ্লুত মুম্বইয়ের বাসিন্দা কানুপ্রিয়া। আগামী ৬ই অক্টোবর তার জন্মদিন। তাঁর কথায়, “আজ আমি গর্বিত। কিন্তু স্রষ্টা এমন এক জন মানুষ, যিনি আজও যোগ্য সম্মান পাননি। আমাদের সকলকে সেই স্বীকৃতি আদায়ের লড়াইয়ে শামিল হতে হবে।” এন আর এস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রাক্তনী সংগঠনের দাবি মেনে সেখানকার হস্টেল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তি বসানো এবং তিনি যে ঘরে থাকতেন তার দেওয়ালে ফলক লাগানোর ছাড়পত্র দেয় রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। প্রাক্তনী সংগঠনের সভাপতি, চিকিৎসক অভিজিৎ ঘোষ সংবাদ মাধ্যমকে জানান, “যে সময়ে সুভাষবাবু আমাদের পড়িয়েছেন, সেসসয় তাঁর আমরা মর্ম বুঝিনি। যখন বুঝতে শুরু করলাম, তখন মনে হল, ওঁকে সম্মান জানানো আমাদের অবশ্য কর্তব্য।’’

ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়

সেই ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৬— দীর্ঘ ন’বছর ধরে একটু একটু করে এন আর এস-এ গবেষণাগার তৈরি করেছিলেন সুভাষবাবু। সর্বক্ষণ সেখানে তিনি যুগান্তকারী আবিষ্কারের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতেন। অথচ কোনো এক অজানা কারণে ১৯৭৬ সালে তাঁকে বদলি করা হয় বাঁকুড়ায়। সুভাষবাবুর বহু অনুরোধ করলেও তৎকালীন স্বাস্থ্যকর্তারা সেই নির্দেশ রদ করেননি। শেষ পর্যন্ত বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজে যোগ দেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সপ্তাহান্তে কলকাতার বাড়িতে ফিরে হাসপাতালের ছোট পরীক্ষাগারেই গবেষণা চালিয়ে যেতেন থাকেন সুভাষবাবু। সেই যুগান্তকারী গবেষণারই এক  অন্যতম সাফল্য দুর্গা ওরফে কানুপ্রিয়া। এ দিন তাঁর বাবা প্রভাতবাবু সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, “বিয়ের ১২ বছর পরেও সন্তান না হওয়ার এক ভীষণ মানসিক যন্ত্রণা কুরে কুরে খেত আমাদের দুজনকেই। সুভাষবাবু এও জানান, তিনি নতুন পদ্ধতিতে আমাদের উপরে একটি পরীক্ষা করতে চান। তাতে যে শিশু জন্মাবে, সে বিকলাঙ্গ হলেও হতে পারে। সে কথা শুনেও আমি এবং আমার স্ত্রী বেলা রাজি হয়ে যাই। কারণ, নিঃসন্তান থাকার চেয়ে অন্তত একটি সন্তান হলে আমরা বাবা-মা তো হতে পারব।”

সময়টা ১৯৭৪, চিকিৎসক কৈলাস চৌধুরীর মাধ্যমে সুভাষবাবুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল প্রভাতবাবু ও বেলাদেবীর। কিছু দিন চিকিৎসার পরেও বেলাদেবী গর্ভবতী হতে পারেননি। সুভাষ বাবু পরীক্ষা করে দেখেন, বেলাদেবীর দু’টি ফ্যালোপিয়ান টিউবই অবরুদ্ধ। তখনই তিনি নিজের নতুন গবেষণা ‘টেস্ট টিউব বেবি’র পরীক্ষামূলক প্রয়োগ ওই দম্পতির উপরে করতে চেয়েছিলেন । এদিকে এটি ছিল তার নতুন গবেষণা, তাই ফলাফল সম্পর্কে সুভাষবাবু নিজেও নিশ্চিত ছিলেন না, তাই বিষয়টি গোপন রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। এদিকে তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজকে তিনি কীভাবে বোঝাবেন, সে সম্পর্কে দিশাহারা হয়ে সুভাষবাবুকেও তাঁদের পরিচয় ও বিষয়টি গোপন রাখার আর্জি জানিয়েছিলেন প্রভাতবাবুরা।

আজ অবশ্য প্রভাত বাবু নিজেও সামিল হতে চান সুভাষবাবুর প্রাপ্য স্বীকৃতি আদায়ের এই লড়াইয়ে। তাই ওইদিন ভ্রূণ নিয়ে গবেষণা করা চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কানুপ্রিয়াকে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন প্রভাতবাবু।

রাজ্য কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে যাতে যোগ্য সম্মান দেওয়া হয়, তার জন্য ইতিমধ্যেই লড়াই শুরু করেছেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ গৌতম খাস্তগীর। ১লা অক্টোবর জাতীয় গ্রন্থাগারে এই সম্মেলনের পরে তিনি বলেন, “ভ্রূণ বিকলাঙ্গ হয়, ৯ মাস শুয়ে কাটাতে হয়, অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি, প্রচুর খরচ এবং সাফল্যের হারও খুব কম— টেস্ট টিউব বেবি নিয়ে এই পাঁচটি কুসংস্কার এখনও মানুষের মনে রয়ে গেছে প্রবল ভাবে। সেগুলি কাটানোই আমাদের মূল লক্ষ্য। এটা সম্ভব হলে সুভাষবাবুর আবিষ্কারের প্রতি যোগ্য সম্মান জানানো হবে।’’ এদিকে বেলাদেবীর কথায়, বিয়ের এত বছর পরেও সন্তান না হওয়ায়, আত্মীয় পরিজন প্রতিবেশীদের থেকে নানান কথা শুনতে হত। সুভাষবাবু তো আমাদের ভগবান হয়ে এলেন। মেয়ে জন্মানোর পরে বহু বার সস্ত্রীক আমাদের বাড়িতে এসেছেন তিনি। পারিবারিক একটা সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। এত বড় মনের মানুষ, অথচ মনের ভিতর কত কষ্ট নিয়ে চলে গেলেন, আজও ভাবতে পারি না।”

সময় পেরিয়েছে অনেকখানি, তবু আজও কত মানুষ লড়াই করছেন এই বিশ্বাস নিয়েই যে, সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবার তার যোগ্য সম্মান পাবেনই।

Srikona Sarkar

As a Student of Science, I found the subject of both mental and physical wellness quite intriguing in my school days, Which was further sharpened with the completion of Graduation in Molecular Biology in my College. As The whole world, right now is battling with the greatest pandemic of human civilization, I cannot help myself from helping out people by providing the exact solution for their mental and physical profoundness so that, they can always discover a new tunnel of hope and light, even when their movement is restricted within the boundary of the walls.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago