সায়টিকা কি? সায়টিকার লক্ষণ ও চিকিৎসা

Published by

সায়টিকা শব্দটা আমাদের সকলের জানা থাকলেও আসলে সায়টিকা কি সেটা অধিকাংশ মানুষই জানেন না। বর্তমান সময়ে কাজের চাপ ও ব্যাস্ততা এতই বেশি যে শরীরের দিকে খেয়াল রাখার সময় পাইনা আমরা। আর তার ফলেই বিভিন্ন রকম শারীরিক সমস্যায় ভুগতে হয় আমাদের। মধ্যবয়সী ব্যক্তিরা , বিশেষ করে মহিলাদের সায়টিকার ব্যথা বেশি হয়ে থাকে। এই রোগ থেকে বাঁচতে সঠিক চিকিৎসার পাশাপাশি বদলে ফেলতে হয় কিছু কিছু খারাপ অভ্যেসও।

সায়টিকা কি?

সায়টিকার ব্যথা শব্দটার সঙ্গে আমাদের বরাবরের পরিচয় থাকলেও এর সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষই এখনও বিশ বাঁও জলে। সায়টিকা আসলে আমাদের শরীরের দীর্ঘতম নার্ভ বা স্নায়ু। কোমরের দুদিকের পেছনে দুটি সায়টিকা নার্ভ থাকে। কোমরের পেছন দিক থেকে বেরিয়ে পায়ের পেছন দিক দিয়ে গিয়ে নীচ পর্যন্ত এই স্নায়ু দুটি বিস্তৃত। কোমর সহ পায়ের ব্যথা কিংবা লো-ব্যাক পেনের একটা বড় কারণ এই সায়টিকা নার্ভের ওপর চাপ অথবা আঘাত। আর তার থেকেই সৃষ্ট লোব্যাক পেনকে সায়টিকা ব্যথা বলা হয়।

কখন বা কী অবস্থায় হয় ব্যথার সূত্রপাত?

সাধারণত কোনও ভাবে সায়টিকা নার্ভে চাপ পড়লেই ব্যথা শুরু হয়। সেই চাপ না কমা পর্যন্ত এই ব্যথা চলতেই থাকে। কোমরের পেছনে থাকায় নার্ভে চাপ কী কী ভাবে পড়তে পারে, তার কারণগুলো প্রায় সকলেরই জানা। গর্ভাবস্থায় পেট আকারে আয়তনে বড় হয়ে যায় বলে কোমরের পেছনের নার্ভে চাপ বাড়তে শুরু হয়। তাই এই সময়ে কোমরের ব্যথা প্রায় অবধারিত। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ব্যথা সাময়িক অর্থাৎ প্রসবের পর ধীরে ধীরে ব্যথা চলে যায়। তবে ক্রনিক সায়টিকার পেছনে আছে চোট আঘাত, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ডিজেনারেটিভ আর্থ্রাইটিসের কারণে মেরুদণ্ডের দুটি কশেরুকার মাঝখানের ডিস্ক হার্নিয়েটেড হওয়া অর্থাৎ বেরিয়ে আসা। জেলির মত ডিস্ক স্থানচ্যুত হয়ে সায়টিকা নার্ভে চাপ দিতে শুরু করলেই ব্যথার প্রকোপ বাড়তে থাকে।

কোন বয়সে সায়টিকার প্রকোপ বাড়তে শুরু করে?

পুরুষদের তুলনায় নারীরাই সায়টিকায় আক্রান্ত হন বেশি।  সাধারণত এর প্রকোপ  ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সী মহিলাদের ওপর তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি পড়ে। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই সময় টা আরেকটু পরে আসে সাধারণত। তবে দেখা গেছে সাধারণত ২০ বছরের কম বয়সীদের সায়টিকার ব্যথা হয় না। হলেও তা বিরলতম। এছাড়া ডায়াবেটিস রোগী এবং ধুমপায়ীদের সায়টিকায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে৷

সায়টিকার কারণ কী কী?
  • সায়টিকার ব্যথার প্রধান কারণই নার্ভে চাপ পড়া।
  • সামনের দিকে ঝুঁকে ভারি জিনিস তুললে কশেরুকার মাঝের ডিস্ক স্লিপ করার ঝুঁকি বাড়ে।
  • চোট লাগলে, মেরুদণ্ডে টিউমার হলে, বা কোনও সংক্রমণ হলেও সায়টিকার ব্যথার ঝুঁকি বাড়ে।
  • ওজন বেশি হলেও সায়টিকার ঝুঁকি এবং সম্ভাবনা দুইই বাড়ে।
  • স্পন্ডালাইটিস, পেশীর খিঁচুনি থেকেও সায়টিকার ব্যথা হয়৷
  • ভারী ওয়ালেট হিপ পকেটে রাখলে সায়টিকা নার্ভে চাপ পড়ে ব্যথার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
সায়টিকার লক্ষণ কী?
  • কোমরের দুদিকে দুটি সায়টিকা নার্ভ থাকলেও ব্যথা শুরু হয় একদিকে।
  • কোমরের পেছন দিক থেকে ব্যথা শুরু হয়ে নিচের দিকে নেমে আসে।
  • হাঁচি কাশি হলে ব্যথা বেড়ে যায়। অনেক সময় চেয়ারে বা নীচে বসলে ব্যথা তীব্র আকার নিতে পারে।
  • কখনও কখনও ব্যথা হয়না, কিন্তু পায়ের নিচের দিক অসাড় হয়ে যায়।
  • হাঁটা চলা করতে অসুবিধে হয়।
  • সায়টিকার উপসর্গ আচমকাই শুরু হয় এবং অনেক সময় ব্যথা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়ে উত্তরোত্তর  বেড়ে চলে।
  • পিঠের নীচের অংশে, নিতম্বের হাড়ে ব্যথা হয়।
  • দুই পায়েই জ্বালা করে।
  • খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে বা হাঁটাচলা করলেও ব্যথা হয়।
  • একটি বা দুই পায়েরই পাতায় অসহ্য যন্ত্রণা হয়, ফলে চলাফেরায় খুব সমস্যা দেখা দেয়।
  • দুই পায়েই দীর্ঘকালীন অসাড়তা।
  • কারও কারও মলমূত্র ত্যাগে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়।
  • কখনও সায়টিকার ব্যথা সপ্তাহ খানেকের মধ্যে চলেও যেতে পারে।
  • সাধারণত ৪-৬ সপ্তাহ অব্ধি এই ব্যথা স্থায়ী হয়। তবে তারপরেও না কমলে, সেক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
কীভাবে নির্ণয় করা হয় সায়টিকা?
  • সায়টিকা কিনা নিশ্চিত হতে ডাক্তার প্রথমেই উপসর্গের ওপর জোর দেন ৷ কী কী সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে তা জানতে চাওয়া হয়। এছাড়াও অন্য কোনো রোগ শরীরে আছে কিনা সেটাও গুরুত্বপূর্ণ এক্ষেত্রে।
  • মেডিকেল হিস্ট্রি জানতে চাওয়া হয়। যেমন ব্যথা শুরু কবে থেকে, এবং তা কমলো বা বাড়লো কিভাবে, কবে ইত্যাদি।
  • এছাড়া কিছু শারীরিক পরীক্ষারও পরামর্শ দেওয়া হয়।
  • সায়টিকা কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য কিছু স্ট্রেচিং বা মুভিং এক্সারসাইজ করতে বলেন ডাক্তাররা।
  • যাদের ব্যথা দীর্ঘদিনের এবং যাদের শরীরে ক্যান্সারের মত রোগ ও বাসা বেঁধেছে, তাদের ক্ষেত্রে নার্ভ টেস্ট করা হয়৷
  • সায়াটিক নার্ভ দ্বারা উৎপন্ন নার্ভ ইমপালস পরীক্ষা করে সেখানে কি কি সমস্যা আছে তা নির্ণয় করা হয়। এবং সায়টিক নার্ভের কোথায় কোথায় জটিলতা সেই নির্দিষ্ট লোকেশন সম্পর্কেও জানা যায়।
  • স্পাইনের অবস্থা জানার জন্য ইমেজিং টেস্টের পরামর্শ দেওয়া হয়। এর ফলে সায়টিকার কারণ নির্ধারণে সুবিধা হয়।
  • স্পাইনাল এক্স-রে, এম আর আই, সিটি স্ক্যান করার পরামর্শ দেন ডাক্তাররা। সাধারণ এক্স-রে তে সায়াটিক নার্ভের ড্যামেজ ধরা পড়ে না ৷
  • সিটি মাইলোগ্রাম ইমেজিং পরীক্ষাটিও এক্ষেত্রে করতে বলে হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে স্পাইনাল কর্ড এবং নার্ভ ড্যামেজের পরিষ্কার ছবি পাওয়া যায়।
সায়টিকার চিকিৎসা

অনেক সময় সায়টিকার ব্যথা ৪-৬ সপ্তাহের মধ্যে নিজে থেকেই কমে যায় ৷ যদি না কমে তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন ৷ ওষুধের পাশাপাশি কয়েকটি অভ্যেস নিয়মিত পালন করুন।

কোল্ড কমপ্রেস

আইস ব্যাগ না থাকলে একটি ব্যাগে কিছু বরফ নিয়ে নিয়মিত আক্রান্ত জায়গাটিতে সেঁক করুন ৷ ২০ মিনিট চেপে ধরে থাকুন ৷ প্রথম কিছুদিন দিনের কয়েকবার এটি করুন। তারপর আসতে আসতে ব্যথা কমলে কোল্ড কমপ্রেস কমাতে থাকুন ৷

গরম সেঁক

ইস্ত্রি বা তাওয়া গরম করে তাতে গরম হওয়া কাপড় আক্রান্ত স্থানে রেখে সেঁক দিন ৷ কোল্ড কমপ্রেস শুরু করার দুই থেকে তিনদিন পর গরম সেঁক দেওয়া শুরু করুন। ব্যথা না কমলে ঠান্ডা এবং গরম সেঁক পাল্টাপাল্টি করে দিতে থাকুন ৷

স্ট্রেচিং

এই ধরনের ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে স্ট্রেচিং ভীষণ উপকারী। লেগ রাইজিং, স্কোয়াট, গোড়ালি ও আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়ানো ইত্যাদি নিয়মিত অভ্যেস করতে হবে। তবে  প্রতিটি স্ট্রেচিংয়ের সঠিক পদ্ধতি সম্বন্ধে জানার জন্য একজন ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট বা ট্রেনারের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন।

ওষুধের ব্যবহার

ব্যথা কমানোর জন্য অ্যাসপিরিন বা আইবুপ্রোফেন সাধারণ কিছু ওষুধ ব্যবহার করা হয়। তবে অ্যাসপিরিনের অতিরিক্ত ব্যবহারে স্টমাক ব্লিডিং বা আলসারের মতো জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়াও ডাক্তাররা অনেক সময় অ্যান্টি ডিপ্রেশনের ওষুধও প্রেস্ক্রাইব করেন। কিন্তু ব্যথার প্রকোপ বাড়লে স্পাইনাল কর্ডের এপিডুরাল স্পেস ক্যানালে কর্টিকোস্টেরয়েড ইঞ্জেকশনও প্রয়োগ করা হয়৷

নিয়মিত ব্যায়াম

শরীর যত বেশি মাত্রায় সক্রিয় থাকবে, তত বেশি এন্ডোরফিনস মুক্ত করবে। এন্ডোরফিনস এমন একটি বেদনানাশক যা শরীর নিজে তৈরি করে। সাঁতার বা সাইক্লিং এর মাধ্যমে শরীর চর্চা শুরু করুন ৷ নিয়মিত কিছু ব্যায়ামের অভ্যেস করুন ৷ যেমন ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ, অ্যারোবিক্স, ওজন উত্তোলন ইত্যাদি ৷ এর ফলে ভবিষ্যতে ব্যাক পেনের সম্ভাবনা অনেকাংশেই কমে যায় ৷

সার্জারি

সায়টিকার ব্যথা সিভিয়ার কন্ডিশনে গেলে সার্জারির প্রয়োজন হয়। সাধারণত, দুই ধরনের সার্জারি এক্ষেত্রে করা হয়, ডিসেক্টমি এবং মাইক্রোডিসেক্টমি। ডিসেক্টমির ক্ষেত্রে, ডিস্কের যে অংশটি নার্ভের ওপর চাপ প্রয়োগ করে, সেটি সরিয়ে দেওয়া হয়। মাইক্রোডিসেক্টমিতে মাইক্রোস্কোপের ব্যবহার করে ডিস্কের একটি ছোটো অংশ কেটে তা দূর করা হয়।

চিকিৎসার অন্যান্য পদ্ধতি

সায়টিকার চিকিৎসার এই পদ্ধতিগুলির মধ্যে আছে ওজোন নিউক্লিওলাইসিস, সিলেকটিভ নার্ভ রুট ব্লক, পারকিউটেনিয়াস মাইক্রোডিসেক্টমি, রেডিওফ্রিকোয়েন্সি নিউরোটমি সহ নানান পদ্ধতি। কোন রোগীর জন্য কি চিকিৎসা প্রয়োজন তা নির্ভর করে রোগীর সামগ্রিক অবস্থার ওপর। এগুলোর কোনটিই কিন্তু সার্জারি নয়। কিন্তু সুস্থ হতে গেলে এর সঙ্গে কিছু এক্সারসাইজ করতেই হবে।

সায়টিকা প্রতিরোধের উপায় কী?

ছোটো থেকেই নিয়মিত শরীরচর্চা,ব্যায়াম, সঠিক ভাবে সোজা হয়ে বসার অভ্যেস, একদম সঠিক ভাবে চলাফেরার বা হাঁটার অভ্যেস তৈরি হলে সায়টিকার সমস্যাকে রুখে দেওয়া যেতে পারে।

Srikona Sarkar

As a Student of Science, I found the subject of both mental and physical wellness quite intriguing in my school days, Which was further sharpened with the completion of Graduation in Molecular Biology in my College. As The whole world, right now is battling with the greatest pandemic of human civilization, I cannot help myself from helping out people by providing the exact solution for their mental and physical profoundness so that, they can always discover a new tunnel of hope and light, even when their movement is restricted within the boundary of the walls.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago