Categories: স্থূলতা

ওবেসিটি কি? কী কী জটিলতা দেয় এর কারণে, প্রতিরোধ এবং প্রতিকার কি?

Published by

অফিসের ডেস্কে বসে দশ ঘন্টার ডিউটি হোক কিংবা ওয়ার্ক ফ্রম হোমের দিনগুলো, কম্পিউটারের সামনে থেকে ওঠার অবকাশ আর তেমন মেলে কই। প্রযুক্তির আশীর্বাদে আজকাল তেমন প্রয়োজন হয় না বাজার হাটে যাওয়ারও৷ অগত্যা একটা ক্লিকেই এভ্রিথিং ডান৷ কর্মব্যস্ত জীবন সামলে ইচ্ছে হয়না রান্নাঘরের গরমে থাকতে। তাতে কি জোম্যাটো বা সুইগি করলেই মনপসন্দ খাবার গরমাগরম হাতে৷ সপ্তাহান্তে একবার এক্সপ্লোরেশনের জন্য রেস্তোরাঁয় ঢুঁ না মারলে হয় নাকি! বাড়ির খুদে সদস্যটিও আর যাচ্ছেনা মাঠে খেলতে, বরং না কম্পিউটার বা মোবাইল গেমই সম্বল। আপনাকে নিশ্চিন্ত করে সন্তান তো চোখের সামনেই রইলো, কিন্তু আপনার চোখের আড়ালেই ক্রমশ থাবা বসাচ্ছে ওবেসিটি।

নিজেদের অজান্তেই আমরা প্রবল ভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি যান্ত্রিক জীবনে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ফাস্ট ফুডের প্রতি ঝোঁক। একই জায়গায় বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ। শারীরিক পরিশ্রমের অভাবে ওবেসিটিতে আক্রান্ত ব্যক্তির গ্রাফ ক্রমশ উর্ধ্বমুখী। বর্তমানে ভারতে ১৩৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ ওবেসিটির শিকার এবং সারা বিশ্বে মৃত্যুর অন্যতম কারণ ওবেসিটি, অন্তত এমনটাই দাবী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ওবেসিটি কি?

ওবেসিটি হলো শরীরের এক বিশেষ অবস্থা। বাংলায় একে বলা হয় অতিস্থূলতা। শরীরের বিভিন্ন অংশে অতিরিক্ত মেদ বা চর্বিজাতীয় পদার্থ জমা হয়ে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। এর ফলে শরীরে নানারকম ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে। বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। বর্তমানে ভারতে ১৩৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এই অবস্থার শিকার। শরীরের বডি মাস ইনডেক্স (BMI) দিয়ে ওবেসিটির পরিমাপ করা হয়। সাধারণত ১৮ থেকে ২২.৫-এর মধ্যে বিএমআই থাকলে তা একেবারে স্বাভাবিক। বিএমআই হল শরীরের উচ্চতা এবং ওজনের আনুপাতিক হার। একজন ব্যক্তির স্বাভাবিক বিএমআই এর সীমা হলো ২০-২৫ এর মধ্যে। কিন্তু, বিএমআই-এর মান ২৫-৩০ এর মধ্যে হলে বলা হয় সেই ব্যক্তি স্থূল, ৩০ এর বেশি হলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ক্লাস-১ ওবেসিটি, ৩০-৩৫ হলে ক্লাস-২, ৩৫-৪০ হলে ক্লাস-৩ এবং ৪০ এর বেশি হলে সুপার ওবেসিটি। গোটা বিশ্বে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসাবে স্থূলতাকেই দায়ী করেছেন চিকিৎসকরা। ৪৫-৫৫ বছর বয়সীদের মধ্যে এর প্রভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। শিশুদের ক্ষেত্রেও দিনের পর দিন এর সমস্যা ক্রমবর্ধমান।

কাদের ঝুঁকি বেশি?

যেকোনও বয়সেই একজন ব্যক্তি ওবেসিটিতে আক্রান্ত হতে পারেন। মাঝবয়সীদের এই ক্ষেত্রে এই সংখ্যা বেশি হলেও; বয়ঃসন্ধিতে অনেকেই ওবেসিটির শিকার হন,তবে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে ওবেসিটির হার বেশি দেখা যায়। আজকাল শিশুরাও শিকার হচ্ছে।  ওবেসিটিতে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মৃত্যুর হারও বেশি।

কেন হয় ওবেসিটি?

কেন হয় ওবেসিটি

• অতিরিক্ত মাত্রায় ক্যালোরি যুক্ত খাবার খাওয়া এবং শারীরিক পরিশ্রমের অভাব।

• ফাস্ট ফুডের প্রতি অতিরিক্ত ঝোঁক

• অতিরিক্ত মানসিক চাপ।

• অপর্যাপ্ত ঘুম।

• ওষুধের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার।

• ঘন ঘন মদ্যপান এবং কোল্ড ড্রিংক্স এর অতিরিক্ত সেবন।

• বংশগত কারণেও মানুষ ওবেসিটির শিকার হন।

• শারীরিক ভাবে নিষ্ক্রিয় জীবনযাপন।

• হরমোনের সমস্যা।

• ছোটদের ক্ষেত্রে পড়াশোনার চাপ, খেলাধূলার জায়গার অভাব, একাকিত্ব থেকে অনলাইন গেমের নেশা, ইনস্ট্যান্ট ফুড খাওয়ার অভ্যাস।

ওবেসিটি-র ফলে কী কী সমস্যা বা জটিলতা দেখা দিতে পারে?

ওবেসিটি-র জন্য বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। সহজ ভাবে বলতে গেলে ওবেসিটি আরও অনেক রোগকে ডেকে আনে। একটি সাধারণ রোগও জটিল আকার ধারণ করে ওবেসিটির কারণে। যেমন — হৃদরোগ, ডায়াবেটিস মেলিটাস, অস্টিও আরথ্রাইটিস, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম,বন্ধ্যাত্ব, থাইরয়েড, ইনসমনিয়া, মানসিক অবসাদ, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি।

হৃদরোগ

ওবেসিটির সঙ্গে ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং রক্তে কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। একে ‘মেটাবলিক সিনড্রোম’ বলা হয়। এছাড়াও থেকে ক্যানসারের আশঙ্কাও।

ওষুধ ছাড়াই কিভাবে মেলে প্রতিকার? কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় ওবেসিটি?

• ওবেসিটি থেকে বাঁচার প্রধান উপায়ই হলো হল সঠিক ডায়েট এবং শারীরিক পরিশ্রম। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসের ফলে ওজন কমলেও, পরে তা বাড়তে থাকে। তাই এই সঠিক ওজন ধরে রাখতে গেলে নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করতেই হবে। এক্ষেত্রে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ এবং যোগব্যায়াম খুব ভালো কাজ দেয়।

• ডিটক্স ওয়াটার, ওজন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ডায়েটের সাথে অনুঘটকের কাজ করে ডিটক্স ওয়াটার।

• অনেক সময় দেখা যায় অনেকে খুব কম পরিমাণে খেলেও ওজন বেড়ে যায়, এর জন্য ধীর বিপাক ক্রিয়া। এ ক্ষেত্রেও তাই একটাই উপায়— শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমেই ক্যালোরি খরচ করতে হবে।

• জীবনযাত্রার পরিবর্তন, অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্যতম পথ হলো রোজকার জীবনযাত্রার পরিবর্তন। খাদ্যাভ্যাস থেকে ঘুম — নিয়মিত শরীরচর্চা, ফাস্ট ফুড এড়িয়ে চলা ইত্যাদি।

শরীরচর্চা

• বিভিন্ন ধরনের ডেয়ারি প্রোডাক্ট, চকোলেট, আইসক্রিম, বার্গার, পিৎজা-র মতো খাবারে অতি উচ্চ মাত্রায় ক্যালোরি থাকে। অল্প পরিমাণ খাবার খেলেও শরীরে অধিক মাত্রায় ক্যালোরি সঞ্চয় হয়। তাই এই ধরনের খাবার গুলি পারতপক্ষে বর্জন করাই বাঞ্ছনীয়।

• হোম মেড ফুডে অভ্যস্ত হন৷ তুলনামূলক কম তেলে রান্না করা খাবার খান। রেড মিট, অতিরিক্ত তেল যুক্ত মাছ ইত্যাদি এড়িয়ে চলুন।

• সবুজ দিয়ে প্লেট ভরান৷ খাবারের প্লেটে রাখুন পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসবজি।

• মরসুমি ফল খান প্রতিদিন। অন্তত একটা। কলা, আঙুর, আম খান তবে পরিমিত।

• রাত জাগার অভ্যেস ত্যাগ কর‍তে হবে। নিয়মিত রাত জাগার ফলে শরীরের স্বাভাবিক বিপাকীয় হার নষ্ট হয়। রাতে ৭-৮ ঘন্টার ঘুম এক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজন।

• উচ্চতা, ওজন ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ডায়েট চার্ট পেতে ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নিন৷

ওবেসিটির থেকে মুক্তি পেতে সার্জারির প্রয়োজন কখন হয়?

ওবেসিটি থেকে মুক্তি পেতে যে সার্জারি করা হয়, ডাক্তারি পরিভাষায় তাকে বলে বেরিয়াট্রিক সার্জারি। একমাত্র থার্ড লেভেল ওবেসিটি বা সুপার ওবেসিটির অবস্থা সৃষ্টি হলেই এই সার্জারির সাহায্য নেওয়া হয়। অথবা ওবেসিটির সঙ্গে একাধিক অন্যান্য রোগ দেখা দিলেও সার্জারি করা হতে পারে। এক্ষেত্রে অপারেশনের মাধ্যমে শরীরের মেদ কমিয়ে বা পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্রের মতো পরিপাক তন্ত্রের বিভিন্ন অংশের আয়তন কমিয়ে দেওয়া হয়। ফলে সেই ব্যক্তির কম খাবারেই খিদে মিটে যায় এবং খাবার থেকে ক্যালোরি সঞ্চয়ের পরিমাণও কম হয়। এ ছাড়া গ্যাস্ট্রিক বাইপাস, মিনি গ্যাস্ট্রিক বাইপাস, ডিওডেনাল সুইচের মতো আরও কয়েক ধরনের সার্জারিও করা হয়।

Srikona Sarkar

As a Student of Science, I found the subject of both mental and physical wellness quite intriguing in my school days, Which was further sharpened with the completion of Graduation in Molecular Biology in my College. As The whole world, right now is battling with the greatest pandemic of human civilization, I cannot help myself from helping out people by providing the exact solution for their mental and physical profoundness so that, they can always discover a new tunnel of hope and light, even when their movement is restricted within the boundary of the walls.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago