জরায়ুর টিউমার বা ফাইব্রয়েডের ব্যথাকে চেনা এবং তার ঘারোয়া চিকিৎসা

Published by

ফাইব্রয়েড বা জরায়ুর টিউমার হল একপ্রকারের নন ক্যান্সারাস টিউমার যা ইউটেরাস বা জরায়ুর দেওয়ালে গড়ে ওঠে। অধিকাংশ মহিলারই জীবনে কোনো না কোনো সময়ে ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড হয়ে থাকে, কিন্তু যতক্ষণ না কোনো বিশেষ রোগলক্ষন প্রকাশ না পায়, তারা তা বুঝতে পারে না। কিছু মহিলার ক্ষেত্রে এই ফাইব্রয়েডের যন্ত্রণা অসহ্য হয়ে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে প্রলম্বিত মাসিক এবং তা থেকে অতিরিক্ত রক্তপাতের সাথে সাথে ফাইব্রয়েডের কারনে আর যা যা সমস্যা হয়ে থাকে তা হল—

  • পেলভিক অঞ্চলে চাপ এবং ক্রনিক ব্যথা
  • পিঠের নীচের দিকে ব্যথা
  • পেটে ব্যথা এবং পেট ফুলে থাকা (ব্লোটিং)
  • মাসিক এবং যৌন সংসর্গের সময় যন্ত্রণা

এই ফাইব্রয়েড এর ফলে রোগীর মনে হয় যে তার বারবার মূত্রত্যাগের  প্রয়োজন।

     ব্যথা মাঝেমাঝে চলে যায় আবার ফিরে আসে, অথবা শুধুমাত্র মাসিক বা যৌন সংসর্গের সময় হয়ে থাকে। যন্ত্রণাটা তীক্ষ্ণ বা চাপা ধরনের হয়ে থাকে। ফাইব্রয়েডেস এর আকার, পরিমান এবং অবস্থানের ওপর নির্ভর করে রোগলক্ষনের নানা পরিবর্তন হয়ে থাকে।

অন্যান্য পেলভিক ডিসঅর্ডার যেমন — এন্ডোমেট্রিওসিস, অ্যাডিনোমায়োসিস, পেলভিক ইনফেকশন ইত্যাদির সাথে ফাইব্রয়েড এর রোগলক্ষনের প্রচুর মিল দেখতে পাওয়া যায়। যদি আপনার পেলভিক অঞ্চলের যন্ত্রণা দীর্ঘস্থায়ী হয়, প্রলম্বিত মাসিকের সাথে অতিরিক্ত রক্তপাত এবং মূত্রত্যাগের সময় সমস্যা হয়ে থাকে তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে এবং সঠিক চিকিৎসা শুরু করতে হবে।

বাড়িতে কিভাবে ফাইব্রয়েডের ব্যথার উপশম করা যায়?

ঘরোয়া পদ্ধতিতে এবং ওভার দ্য কাউন্টার মেডিসিন অর্থাৎ খুব সহজেই দোকানে কিনতে পাওয়া যায় এরকম ওষুধের মাধ্যমে  রোগলক্ষন কে নিয়ন্ত্রন করা যায়। এটা তখনই সম্ভব যখন রোগলক্ষন খুবই সামান্য এবং ত দৈনন্দিন জীবন যাত্রাকে ব্যাহত করে না।

ঘরোয়া পদ্ধতিগুলি হল—

  • ননস্টেরয়েড অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগ, যেমন আইবুপ্রুফেন খাওয়া
  • হিটিং প্যাড বা গরম সেঁক দেওয়া

আরও কিছুকিছু ঘরোয়া পদ্ধতি আছে যার সাহায্যে রোগলক্ষনকে প্রশমিত করা যায় —

  • স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। খাবারের ভেতর প্রচুর ফল, সবজি, দানা শস্য, লিন মিট খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে এবং রেড মীট, কার্বোহাইড্রেট এবং রিফাইন্ড সুগার জাতীয় খাদ্যকে বাদ দিতে হবে যেগুলো ফাইব্রয়েড এর অবস্থা কে আরো খারাপ করে তোলে।
  • দুধ ও দুধ জাতীয় খাদ্য যেমন দই, চীজ ইত্যাদি সপ্তাহে একদিন করে খেতে হবে।
  • অ্যালকোহলের পরিমান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে
  • আয়রন এবং ভিটামিন বি এর সাথে সাথে অন্যান্য ভিটামিন এবং মিনারেলস খেতে হবে যাতে অতিরিক্ত রক্তপাতের কারনে রক্তাল্পতা না হয়।
  • নিয়মিত এক্সারসাইজ করতে হবে এবং নিজের শরীরের ওজন সঠিক রাখতে হবে
  • সোডিয়ামের পরিমান নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে যাতে ব্লাড প্রেশার বেড়ে না যায়
  • যোগা বা মেডিটেশন করে মানসিক চাপ বা স্ট্রেস কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে

আকুপাংচার এর মাধ্যমে কি ফাইব্রয়েডের চিকিৎসা করা সম্ভব?

আকুপাংচার ফাইব্রয়েডের যন্ত্রণা কে নিয়ন্ত্রন করতে সাহায্য করে। আকুপাংচার একটি প্রাচীন চৈনিক চিকিৎসা পদ্ধতি।  এর মাধ্যমে ত্বকের ওপর নানা জায়গায় খুব সরু সূঁচের মাধ্যমে সমগ্র শরীরের নানা অংশ কে ইনফ্লুয়েন্স করা যায়। কারেন্ট রিসার্চে দেখা গেছে যে আকুপাংচারের মাধ্যমে অনিয়মিত রক্তপাত এবং মাসিকের যন্ত্রনা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। যদিও এই রিসার্চ করার সময় কিছু টেকনিক্যাল ভুল ছিলো।

ফাইব্রয়েডের ব্যথার প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতি

অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাসিকের জন্য দায়ী যে হরমোন, ওষুধের মাধ্যমে তার চিকিৎসা করা সম্ভব। সেগুলি হল —

  • ওরাল কন্ট্রাসেপটিভ
  • প্রোজেস্টিন রিলিজিং ইন্ট্রা ইউটেরাইন ডিভাইসেস
  • গোনাডোট্রোপিন রিলিসিং অ্যাগোনিস্টস
  • গোনাডোট্রপিন রিলিসিং অ্যান্টাগোনিস্ট

এই ওষুধগুলো রোগলক্ষনের সাময়িক নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, তবে এতে ফাইব্র‍য়েড সেরে যায়না।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর একমাত্র চিকিৎসা হল সার্জারি (মায়োমেকটমি) এবং নন সার্জিক্যাল মেথড যাকে ইউটেরাইন আর্টারি এমবোলাইজেশন বলা হয়। এমবোলাইজেশনের মাধ্যমে ফাইব্রয়েড এর অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং এর ফলে ফাইব্রয়েড এর আকার ছোট হয়ে যায়।

অন্যান্য নন সার্জিক্যাল পদ্ধতিগুলি হল মায়োলাইসিস এবং ক্রায়োমায়োলাইসিস। মায়োলাইসিস পদ্ধতি যেমন Acessa, এতে ইলেকট্রিক কারেন্ট বা লেসার এর মতো হিট সোর্স ব্যবহার করে ফাইব্র‍য়েড এর আকার কে ছোট করে দেওয়া হয়। ক্রায়োমায়োলাইসিসের মাধ্যমে ফাইব্রয়েডস কে ফ্রোজেন করে দেওয়া হয়।

সার্জারির মাধ্যমে জরায়ু সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া, যাকে হিসটেরেক্টমি বলা হয়, সেটাই ফাইব্রয়েডের যন্ত্রণা কমানোর একমাত্র স্থায়ী উপায়। হিসটেরেক্টমি একটি অনেক বড় অপারেশন এবং এর ফলে রোগীর আর ভবিষ্যতে সন্তান ধারনের ক্ষমতা থাকে না, তাই যখন অন্য আর কোনো চিকিৎসা পদ্ধতিতে কাজ হয় না, তখনই এই সার্জারি করা প্রয়োজন।

ফাইব্রয়েড বা জরায়ুর টিউমার হলে কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে?

পেলভিক অঞ্চলের যেকোনো যন্ত্রণা, তা সে যতই সামান্য হোক না কেন চিকিৎসক বা গায়নোকোলজিস্টের পরামর্শ নিতে হবে। এছাড়াও যে যে বিষয়গুলোর জন্য চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে, সেগুলো হল—

  • স্বাভাবিকের অতিরিক্ত বেশি সময় ধরে মাসিক চললে এবং অতিরিক্ত রক্তপাত হলে
  • দুটো মাসিকের মাঝে আবার সামান্য  রক্তপাত হলে
  • পেলভিক অঞ্চলের যন্ত্রণা যা সহজে যাচ্ছে না বা বারবার ফিরে আসছে এমন যন্ত্রনা
  • মূত্রত্যাগের সময় সমস্যা
  • বারবার মূত্রত্যাগের প্রবনতা এবং তার জন্য রাতে বারংবার ঘুম ভেঙে যাওয়া
জরায়ুর টিউমার বা ফাইব্রয়েডের যন্ত্রণা থেকে কতদিনে মুক্তি পাওয়া যাবে?

ফাইব্রয়েডের যন্ত্রণা মেনোপজের পরে কমে যায়, তবে পুরোপুরি সেরে যায় না। যদি রোগী ফাইব্রয়েডের থেকে মুক্তির জন্য সার্জারী করেন, তো তার পরেই এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তবে এই ফাইব্রয়েড আবার ফিরে আসতে পারে রোগীর বয়েসের ওপর নির্ভর করে। রোগী যদি তার মেনোপজের কাছাকাছি সময়ে চলে আসে, তাহলে সমস্যা বারবার ফিরে আসার সম্ভাবনা কমে যায়।

কিছুক্ষেত্রে ফাইব্রয়েড রিমুভ করার সময় জরায়ু বেশ ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং তার ফলে সন্তান ধারনের সমস্যা দেখা দেয়।

ফাইব্রয়েডের সমস্যার একমাত্র পারমানেন্ট সমাধান হল হিসটেরেক্টমি, কারণ তাতে সম্পূর্ণ ইউটেরাসটাই বাদ দেওয়া হয়, তবে এটি অনেক বড় অপারেশন হওয়ার কারনে এর পরে সুস্থ হতেও অনেক সময় লেগে যায়।

জরায়ুর-টিউমার এর চিকিৎসায় ল্যাপারোস্কপিক সার্জারি

সবশেষে বলা যায় পেলভিক অঞ্চলের যেকোনো যন্ত্রণা, তা বেশ কিছুদিন স্থায়ী হলেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। ফাইব্রয়েডের রোগলক্ষন এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম হয়ে থাকে এবং তা বয়স, ফাইব্রয়েডের সংখ্যা এবং আকারের ওপর নির্ভর করে। ফাইব্রয়েডের যন্ত্রণার নানারকম চিকিৎসা আছে। একদম প্রথমেই ডায়েট এবং লাইফস্টাইল চেঞ্জ করতে হবে, তবে কিছুক্ষেত্রে হিসটেরেক্টমি একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়।

ফাইব্রয়েডের যন্ত্রণা কারোর কারোর ক্ষেত্রে প্রচণ্ড বেশি হয়ে থাকে, তবে এটা কখনই ক্যান্সারাস নয়, এর সাথে প্রেগন্যান্সির কোনো সম্পর্ক নেই এবং সাধারণ ভাবে মেনোপজের পরে ফাইব্রয়েড ছোট হয়ে যায়।

Anshula Banerjee

Hello, I am Anshula Banerjee, completed my post-graduation degree in English, along with Bachelor of Education. I live at Nadia. I am a voracious reader in various fields of knowledge that may help the readers to satisfy their urge specially in the area of health and wellness.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago