Categories: চর্মরোগ

একজিমা (Eczema) – লক্ষণ কি? কেন হয়? প্রতিকার কি?

Published by

একজিমা কি?

একজিমা, এক প্রকার চর্মরোগ। যার অন্য নাম হল অ্যাটোপিক ডারমাটাইটিস, শরীরের ভিতর থেকে অথবা বাইরে থেকে কোন বস্তু যখন ত্বকের উপর প্রভাব ফেলতে থাকে, তখন দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অতি-সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে ত্বকের উপরে এই রোগ অর্থ একজিমার সৃষ্টি হয়। যে বস্তুগুলি দেহের বাইরে থেকে শরীরে প্রভাব ফেলে সেগুলির মধ্যে আছে রাসায়নিক পদার্থ এবং ড্রাগস। দেহের ভিতর থেকে যেগুলি প্রভাব ফেলে সেগুলি হল বিভিন্ন প্রকার অ্যান্টিজেন এবং হ্যাপটেনস (এক ধরণের অ্যান্টিজেন)।

একজিমার প্রকারভেদ গুলি কি কি?

একজিমার সাধারণ প্রকারটি হলো অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস। এছাড়াও যে তিনপ্রকারের একজিমা লক্ষ্য করা যায় তা হলো :

কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস (Contact Dermatitis)
কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস মূলত হয় কোনো পদার্থের (কিছু ধাতব অথবা চামড়া জাতীয় বস্তু) সংস্পর্শে আসলে৷ জ্বালা-যন্ত্রণা, চুলকানি, রেডনেস ইত্যাদি দেখা যায়। ইরিট্যান্ট শরীর থেকে দূরীভূত হলে ইনফ্ল্যামেশন ও দূরীভূত হয়৷

ডিস-হাইড্রোটিক ডার্মাটাইটিস (Dyshidrotic Eczema)

ডিস-হাইড্রোটিক ডার্মাটাইটিস আঙুল, হাতের চেটো অথবা পায়ের পাতায় জলে ভরা গুটি বা ফুস্কুড়ির মতন৷ এর কারণে চুলকানি, খসখসে, লাল, ফাটা ত্বক হতে দেখা যায়।

নাম্মিউলার ডার্মাটাইটিস (Nummular Dermatitis)
নাম্মিউলার ডার্মাটাইটিসের সমস্যা সাধারণত শীতকালে হয়।এর ফলে ত্বকের উপর শুষ্ক ও গোলাকার প্যাচ সৃষ্টি হয়। এটি সাধারণত পায়ের পাতার উপরিভাবে দেখা যায়। মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের উপর এই রোগের প্রকোপ বেশি লক্ষ্য করা যায়৷

চর্মরোগ তো অনেক রকমের হয় – একজিমার উপসর্গ গুলি কি কি?

একজিমার বিভিন্ন প্রকারভেদ আছে। এর মধ্যে কতগুলি আছে যা হওয়ার কিছু পরিবেশগত কারণ আছে। আবার কতগুলি আছে যেগুলি আরও জটিল। সব ধরণের একজিমার ক্লিনিকাল লক্ষণ এবং উপসর্গ একই রকমের শুধু ফারাক থাকে সময়কালের, অর্থাৎ ক্ষণস্থায়ী (তীব্র) বা দীর্ঘস্থায়ী। যেমনঃ
অ্যাটোপিক একজিমা বাচ্চাদের মুখে এবং মধ্যশরীরে হয়। যেহেতু বাচ্চারা সংক্রামিত জায়গায় আঁচড়াতে থাকে তাই চামড়া উঠে যায় এবং লাল হয়ে যায়। অ্যাটোপিক একজিমাতে ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়।প্রথম দেখা দেয় গালে। বাচ্চাদের ফুসকুড়ি গুলি দেখা যায় হাঁটুর পিছনে, কনুইয়ের সামনে, কব্জিতে এবং গোড়ালিতে। অ্যাটোপিক একজিমা কখনও কখনও জননেন্দ্রিয়তেও হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে, একটি হাল্কা ধরণ লক্ষ্য করা যায় এবং চামড়া শুষ্ক হয়ে উঠে যায়; এগুলি হয় হাতে, চোখে, শরীরের ভাঁজে এবং স্তনাগ্রে।
এছাড়াও অন্যান্য প্রকারের একজিমার ক্ষেত্রে

  • মাথায়, মুখমণ্ডলে এবং দেহের ঊর্ধ্বাংশে ছোট ছোট চামড়ার স্তর দেখা যায়।
  • বাচ্চাদের এই রোগ হলে ক্র্যাডেল ক্যাপ (মাথায় হালকা এবং চটচটে চামড়া ওঠা) হয় এবং বগলে ও কুঁচকিতে গোলাপি রঙের ফুসকুড়ি হয়।
  • বয়স্কদের ক্ষেত্রে সাধারণত ব্লেফারাইটিস (চোখের পাতার সীমানায় লাল চামড়ার স্তর হওয়া) দেখা যায়।
  • একজিমা সাধারণত শীতকালে হয়।
  • ক্ষতগুলি লাল রঙের হয়, তাতে ফোসকা হয় এবং ত্বকের খোসা পড়তে থাকে। ধীরে ধীরে জায়গাটি শুখিয়ে যায় এবং চামড়া ফেটে যায়।
  • সাধারণত পায়ের নিচের অংশে একজিমা হলে ত্বক লালচে রঙের হয়ে যায় ত্বকে সূক্ষ্ম ফাটা থাকে এবং উঁচু নিচু হয়।
  • অনেকসময় শিরাতেও একজিমার সৃষ্টি হয়। এর ফলে ফুসকুড়ি, ফোস্কা, গাঢ় ত্বক, পায়ে পুরু চামড়া, শুষ্ক ত্বক, আলসার প্রভৃতি লক্ষ্য করা যায়। এই ক্ষতগুলি অত্যন্ত বেদনাদায়ক হয়।
কেন হয় একজিমা?

অনেকক্ষেত্রে মানবদেহের বিশেষ কোনো অংশে প্রোটিনের অস্বাভাবিক রেসপন্স থেকে একজিমার সৃষ্টি হয়।
একজিমা দেখা দিলে মানবদেহের ইমিউন সিস্টেম দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করার ক্ষমতা হারায়, যার ফলে ইনফ্ল্যামেশনের সৃষ্টি হয়।

এছাড়াও কিছু কারণ আছে যার জন্য একজিমার উপসর্গ দেখা দেয়,যেমনঃ

  • ডিটারজেন্ট বা সাবানে উপস্থিত রাসায়নিক, যা ত্বক শুষ্ক করে দেয়।
  • রুক্ষ এবং খড়খড়ে বস্তু (যেমন- উল)
  • সিন্থেটিক কাপড়
  • দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি
  • ঘাম হওয়া
  • তাপমাত্রার পরিবর্তন
  • হঠাৎ আর্দ্রতা হ্রাস পাওয়া
  • স্ট্রেস
  • খাবারে অ্যালার্জি
  • আপার রেসপিরেটরি ইনফেকশনস
কি কি জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে একজিমার থেকে?

বাচ্চাদের ক্ষেত্রে একটি বড় ভয়ের কারণ থেকে যায় অ্যাজমা বা হে ফিভারের। একজিমার সমস্যা বাড়তে থাকলে প্রায়শই বাচ্চাদের ক্ষেত্রে পাল্লা দিয়ে বাড়ে শ্বাসকষ্টের সমস্যা। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে (বয়স ৩০ এর কম) এমনটা হতে পারে, তবে তার সম্ভাবনা তুলনামূলক অনেক কম থাকে৷

কিভাবে বোঝা যায় যে রোগটি একজিমা-ই? কি কি পরীক্ষা করা যেতে পারে?

নির্দিষ্ট কোনো পরীক্ষা নেই একজিমা নির্ণয় করার জন্য। ডাক্তার রা সাধারণত লক্ষণ গুলি দেখেই সিদ্ধান্ত নেন৷ কখনও কখনও অ্যালার্জেন প্রয়োগ করে একটি প্যাচ টেস্ট করা হয় একজিমা কিনা নির্ধারণের জন্য।

কিভাবে সারবে একজিমা?

ডাক্তাররা ওষুধ প্রয়োগের সাথে সাথে কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে বলেন একজিমা থেকে সেরে ওঠার জন্য৷

ওষুধের প্রয়োগ

  • চুলকানি কমাতে cetirizine, fexofenadine-এর মত antihistamines ট্যাবলেট দেওয়া হয়।
  • নিয়মিত ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করার সাথে সাথে কম পরিমাণে নির্দিষ্ট স্থানে লাগানোর জন্য কর্টিকোস্টেরয়েড ব্যবহার করতে পরামর্শ দেন ডাক্তাররা।
  • ‘ওয়েট র‍্যাপস’, টার এবং ইচথাম্মল পেস্ট দিয়ে ব্যান্ডেজ করে রাখতে হবে। ক্ষতে সংক্রমণ হলে অ্যান্টিহিস্টামিনসের মত ওষুধ এবং ক্ষতের জায়গায় অ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে রাখতে হবে।
  • কিটোকোনাজোল শ্যাম্পু এবং ক্রিমের মত জিনিসগুলি এই একজিমার চিকিৎসার বুনিয়াদ হিসেবে গণ্য হয়। এর সাথে যদি প্রয়োজন হয় তাহলে অতি অল্প কর্টিকোস্টেরয়েডস দেওয়া হয়।
  • একজিমার জন্য ব্যবহৃত ওষুধগুলি মূলত যেভাবে ব্যবহার করা হয়: কর্টিকোস্টেরয়েডস যেমন 1% হাইড্রোকর্টিজোন অথবা 0.05% ক্লোবিটাজোন বিউটাইরেট অথবা 30 গ্রাম ক্ষমতাশালী কর্টিকোস্টেরয়েডস, যেমন 0.1% বিটামিথাজোন ভ্যালেরেট, 0.1% মোমেটাজোনে ফিউরোয়েট।( ঘা থাকলে সেখানে এই ওষুধগুলি লাগানো যাবেনা।) * আশে পাশে ফোলা থাকলে পা উঁচুতে তুলে রাখতে হবে এবং গ্রেডেড কমপ্রেশান ব্যান্ডেজ বাঁধতে হবে।
  • প্লাকের চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে স্টেরয়েড লাগাতে হবে। প্রতি 4-6 সপ্তাহ অন্তর স্টেরয়েড ইনজেকশন নিতে হবে।
  • একজিমার সংক্রামিত হাতের তালু এবং পায়ের পাতাতে পটাশিয়াম পারম্যঙ্গানেট দ্রবণে ভেজান কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। মোজা সমেত আরামদায়ক জুতো, অ্যান্টিপার্সপির‍্যান্ট (অধিক ঘামের ব্যবস্থাপনার জন্য), স্থানীয় ভাবে লাগানোর জন্য কর্টিকোস্টেরয়েড ক্রিম, সিস্টেম্যাটিক কর্টিকোস্টেরয়েড গুলি ব্যবহার করা হয়।

সংযত জীবনযাত্রা

  • ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করে ত্বক সবসময় আর্দ্র রাখবেন।
  • যে সকল রাসায়নিক থেকে একজিমা হতে পারে তার সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
  • ঘরের মধ্যে তাপমাত্রার ওঠানামা সীমাবদ্ধ রাখুন।
  • এসির ব্যবহার কম করুন৷
  • ধ্যান এবং যোগাসনের দ্বারা মানসিক চাপের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখুন।
  • সঠিক ওজন বজায় রাখা এবং স্বাস্থ্যকর খাওয়ার অভ্যাস করুন।
  • দেহের কোথাও একজিমা হলে নখ দিয়ে আঁচড়াবেন না।

মনে রাখবেন, একজিমা থেকে কখনও পুরোপুরি সেরে ওঠা যায় না, শুধুমাত্র উপসর্গ গুলি থেকে মুক্তি পাওয়া যায় সঠিক চিকিৎসা হলে৷
কিছু জিনিস মেনে চললে এই রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা কম থাকে। যেমনঃ অতিরিক্ত ঘাম হতে না দেওয়া, স্ট্রেসম্যানেজমেন্ট এবং পর্যাপ্ত ঘুম। এছাড়াও অতিরিক্ত ক্ষার জাতীয় সাবান ডিটারজেন্ট ব্যবহার না করা। খসখসে বা সিন্থেটিক কাপড়ের ব্যবহার কমানো, বেশি ঠান্ডায় না থাকা। নিয়মিত ব্যবহার করুন ময়েশ্চারাইজার, ত্বককে কোনোভাবেই শুষ্ক হতে দেবেন না।

Srikona Sarkar

As a Student of Science, I found the subject of both mental and physical wellness quite intriguing in my school days, Which was further sharpened with the completion of Graduation in Molecular Biology in my College. As The whole world, right now is battling with the greatest pandemic of human civilization, I cannot help myself from helping out people by providing the exact solution for their mental and physical profoundness so that, they can always discover a new tunnel of hope and light, even when their movement is restricted within the boundary of the walls.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago