অবসাদের লক্ষণ ও চিকিৎসা

Published by

অবসাদ কি ?

মাঝেমাঝেই আমাদের মনখারাপ হয়। কিন্তু মনখারাপ মানেই depression বা অবসাদ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) অবসাদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে। হু’র মতে, “সারাক্ষণ মনের মধ্যে একটা দুঃখের ভাব, সাধারণত যে সব কাজ করতে আপনি ভালবাসতেন তাতেও উৎসাহ হারিয়ে ফেলা, দৈনিক রুটিন মেনে চলতে না পারা— এগুলি যদি দুসপ্তাহ বা তার বেশি অব্যাহত থাকে”, তাহলে আপনি অবসাদগ্রস্ত। অবসাদ নিয়ে বেশ কয়েকটি পরিসংখ্যানও দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সেগুলি হল-

i. বিশ্ব জুড়ে পনেরো থেকে আঠেরো বছর বয়সীরা যে অসুখে সবচেয়ে বেশি ভোগে, সেই তালিকায় অবসাদ চতুর্থ স্থানে রয়েছে।

ii. দশ থেকে চোদ্দ বছর বয়সীরা সারা বিশ্ব জুড়ে যে অসুখে সবচেয়ে বেশি ভোগে, সেই তালিকায় পনেরো নম্বরে রয়েছে অবসাদ।

iii. বিশ্বে অর্ধেকেরও বেশি মানসিক অসুখ চোদ্দ বছর বয়সে শুরু হয়। তা সত্বেও এসব অসুখের বেশিরভাগই নির্ণয় করা যায় না বা নির্ণয় করা গেলেও  চিকিৎসা শুরু হয় না।

iv. সারা বিশ্বে পনেরো থেকে উনিশ বছর বয়সীদের মৃত্যুর তৃতীয় বড় কারণ হল আত্মহত্যা।

v. বাবা-মা অনেক সময় সন্তানের অবসাদের উপসর্গগুলিকে লক্ষ্য করেন না। তাঁরা ধরে নেন, সন্তান মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে।

vi. যে কোনও বয়সী যে কোনও ব্যক্তি অবসাদগ্রস্ত হতে পারেন। বয়ঃসন্ধির সময়টাতে অবসাদে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও যথেষ্ট। বিশেষ করে, কোনও শারীরিক বা আবেগজনিত তীব্র আঘাত (ট্রমা) বা হেনস্থার প্রতিক্রিয়ায় অবসাদ এসে যেতে পারে। উপসর্গ দেখে বুঝতে হবে, কখন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওয়া উচিৎ।

অবসাদের কারণ

কিছু দিন আগে পর্যন্ত মস্তিষ্কে কম সেরোটোনিনের মাত্রাকেই অবসাদের একমাত্র কারণ বলে ধরে নেওয়া হত। কিন্তু আধুনিক গবেষণা বলছে, নিউরোট্রান্সমিটারের সঙ্গে অবসাদের  অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক নেই। বেশ কয়েক দশক আগেই অবসাদের রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতার তত্ত্ব সামনে এসেছে ৷ এই তত্ত্ব বলে, মস্তিষ্কে ফাইভ-এইচটি নামে পরিচিত নিউরোট্রান্সমিটার সেরোটোনিন কমে গেলে অবসাদ তৈরি হয়।

নিউরোট্রান্সমিটার হলো এক ধরনের সিগন্যালিং কেমিক্যাল বা সংকেতবাহী রাসায়নিক, যার মাধ্যমে একটি স্নায়ুকোষ বা নিউরন অন্য নিউরনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। এই তত্ত্বটি ষাটের দশকে প্রথম জানা যায়। সেই সময় ডাক্তাররা মেজাজ ভালো রাখার জন্য ‘আইপ্রোনিয়াজিড’ ওষুধ ব্যবহার করতেন। তারা ভাবতেন, এটি সেরোটোনিনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এখন মনে হচ্ছে, এই তত্ত্বটি আসলে অবসাদের কারণের অতি সরল ব্যাখ্যা। একাধিক গবেষণাপত্রের মূল রিভিউগুলি ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, এমন কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই যে কম সেরোটোনিন অবসাদ ডেকে আনতে পারে।

বেশ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রের ‘পিয়ার রিভিউ’ থেকে প্রাপ্ত প্রমাণ বলছে, রক্তে সেরোটোনিনের মাত্রার সঙ্গে অবসাদের কোনো সম্পর্ক নেই৷ এদিকে অবসাদগ্রস্ত মানুষের মস্তিষ্কের সেরোটোনিন রিসেপটরের সঙ্গে অবসাদ নেই এমন মানুষের মস্তিষ্কের কোনো পার্থক্য খুঁজে পাননি গবেষকেরাও ৷ বিষয়টি নিয়ে দ্বিমত থাকলেও, নতুন গবেষণায় দাবি করা হচ্ছে সেরোটোনিন অবসাদের কারণ নয়। বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন, অবসাদ একটি জটিল পরিস্থিতি যা একাধিক কারণ মিলেমিশে সৃষ্টি হয়।

জীবনে একটার পর একটা নেতিবাচক ঘটনা এবং আমরা কীভাবে সেসবের মোকাবিলা করছি–অবসাদের সঙ্গে তার একটা বড় সম্পর্ক রয়েছে। পাশাপাশি মানসিক চাপ বা স্ট্রেস অবসাদের আরেকটি বড় কারণ।

জার্মানির মিউনিখে ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউটের মনোস্তত্ত্ববিদ পাট্রিসিয়া ফোনসেকা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অবসাদ বা হতাশার ক্ষেত্রে জীবনের একাধিক ঘটনা বড়সড় প্রভাব ফেলে। তবে জেনেটিক কারণগুলির প্রতিক্রিয়াও গুরুত্বপূর্ণ। একটি বিশেষ জিনের বৈশিষ্ট্য হিসেবে জীবনের দুঃখজনক ঘটনাগুলি অবসাদের সূচনা ঘটাতে পারে।”

বর্তমান তত্ত্বগুলি সেরোটোনিনের মতো একক নিউরোট্রান্সমিটারের ব্যাখ্যা থেকে আরো খানিকটা অগ্রসর হয়েছে। স্টাডিতে খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে, অবসাদ কীভাবে মস্তিষ্কের জটিল নেটওয়ার্কগুলিতে পরিবর্তন সৃষ্টি করে যা আবেগ এবং মানসিক চাপ (স্ট্রেস) তৈরি করে।

এই তত্ত্বগুলিতে অবসাদের পেছনে মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা এবং প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের মতো অঞ্চলগুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সমস্ত আবেগ অ্যামিগডালা অংশে তৈরি হয়, এগুলি পরে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সে যায়, যেখানে আবেগের অর্থ বোঝার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। গবেষণা বলছে, অবসাদে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অ্যামিগডালা সঙ্কুচিত হয়েছে, সেই সঙ্গে অ্যামিগডালা এবং কর্টেক্সের মধ্যে সংযোগ কমেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্টেক্স আবেগকে আরো নেতিবাচকভাবে খুঁটিয়ে দেখে এবং তার জেরে অবসাদ চলে আসে। বিশেষ করে যে আবেগ খারাপ স্মৃতির সঙ্গে জড়িত, তা আরো বেশি করে অবসাদ ডেকে আনে। দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ এই প্রক্রিয়াতে আরো বেশি প্রভাব ফেলতে পারে৷

অবসাদের লক্ষণ

i. ঘুমের প্যাটার্নে পরিবর্তন: বেশি ঘুমানো, খুব কম ঘুমানো, ঘুমের মধ্যেও অস্থিরতা।

ii. খাদ্যাভ্যাসে বড় মাপের বদল: খুব বেশি খাওয়া, কম খাওয়া, বার বার খাওয়া।

iii. সামাজিক ব্যবহারে আমূল পরিবর্তন: রাগের সঙ্গে মারাত্মক আবেগপ্রবণতা, ক্রমাগত কান্না, গায়ে পড়ে ঝগড়া করা।

iv. ক্লান্তি অনুভব করা, নৈরাশ্য , অসহায়তায় ভোগা, উদ্বেগে কষ্ট পাওয়া।

v. পছন্দের কাজ, শখ , খাবার, খেলা, ক্লাস, বন্ধুদের সম্পর্কে উৎ‌সাহ কমে যাওয়া।

vi. পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া, মনোযোগ কমা, আগের তুলনায় পড়াশোনায় চটপটে ভাব কমে আসা, স্কুলে যেতে অনীহা।

vii. বন্ধুবান্ধব এবং পরিবার থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা।

vii. নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা বা নেশায় আসক্তি, ধূমপান বা মদ্যপানের অভ্যাস শুরু করা, আত্মহত্যার চেষ্টা।

এ সবের মধ্যে যে কোনও একটা আচরণ কারোর মধ্যে দেখা দিলে, সময় নষ্ট না করে সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নিন। মাথায় রাখতে হবে— এর মধ্যে মাত্র এক-দুটো উপসর্গ নিয়মিত ভাবে থাকলে বা সমস্ত উপসর্গই অনিয়মিতভাবে থাকলে সেগুলি অবসাদের লক্ষণ নাও হতে পারে। তবে নিজেরা সিদ্ধান্ত নেবেন না। কাছের মানুষটি অবসাদে আক্রান্ত কিনা নিশ্চিতভাবে নির্ণয়ের জন্য একজন সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নিতেই হবে।

অবসাদের চিকিৎসা

সাধারণত অবসাদ সারাতে অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। পাশাপাশি কেটামাইন এবং সাইলোসাইবিন মাশরুমের মতো ওষুধ দিয়েও সুফল পাওয়া যাচ্ছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সাইলোসাইবিন নামের একটি ওষুধ অবসাদ সারাতে অ্যান্টি ডিপ্রেসান্ট ড্রাগ এসসিটালোপ্রামের চেয়ে বেশি কার্যকর। ব্রেন-ইমেজিং গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে এই ওষুধগুলি মস্তিষ্কে সংযোগ বাড়াতে সাহায্য করে। অতীতের আবেগগুলিকে নতুনভাবে পুনঃপ্রক্রিয়া করতে সহায়তা করে এই ওষুধ, সেই সঙ্গে অবসাদপ্রবণতা কাটিয়ে উঠতেও মস্তিষ্ককে সাহায্য করে।

ফোনসেকা জানান,  অবসাদের চিকিৎসায় ‘নন-ফার্মাকোলজিক্যাল’ চিকিৎসার কার্যকারিতার নিয়েও ভাবনাচিন্তা করা হচ্ছে৷ তাঁর মতে, সাইকোথেরাপি এই চিকিৎসা পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। তার ফলে মানসিক চাপ এবং হতাশাকে নিপুণভাবে সামাল দেওয়া যাবে। সাইকোথেরাপির সাহায্য নিয়ে কোনো ব্যক্তির অবসাদের কারণ খুঁজে বের করা যায়। বিষয়গুলি নিয়ে সাইকিয়াট্রিস্ট রোগীর সঙ্গে সহজভাবে কথা বললে, তাঁরা রোগ সম্পর্কে জানতে পারেন। সব কথা শুনে নিলে পরে কোনও কঠিন পরিস্থিতিতে রোগীর নিজেকে অসহায় বলে মনে হবে না। তার বদলে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারবেন।

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago