শিশুদের মনোযোগ বাড়ানোর কয়েকটি পদ্ধতি

Published by

অনেক সময় বাচ্চা ছেলে বা মেয়ে পড়তে চায় না। ধরে বেঁধে পড়তে বসালেও মনোযোগ দেয় না। দেখা যায় শুধু পড়াশোনা নয়, আরো অনেক ব্যাপারেই সে অমনোযোগী। এরকম হলে অভিভাবকদের চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক।

বাচ্চাদের মনোযোগ বাড়ানোর কয়েকটি উপায়

বাচ্চাদের মধ্যে মনোযোগের সমস্যা বড়দের থেকে বেশি হয়। কারণ শিশুদের মন এমনিতেই চঞ্চল এবং তারা সব সময় একটু অস্থির থাকে। তাই মনোযোগের অভাব হওয়া বাচ্চাদের মধ্যে খুবই সাধারণ ব্যাপার। বাচ্চাদের মনোযোগের সমস্যা কাটাতে এই সব পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।  

শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম :- মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেনের সরবরাহ মাথাকে সব চেয়ে ভালোভাবে কাজ করতে সহায়তা করে। তাই বাবা-মা বাচ্চাকে শ্বাস-প্রশ্বাসের কয়েকটি সহজ ব্যায়াম করতে বলতে পারেন। এর ফলে সন্তানের মনোযোগ বাড়তে পারে। যেমন – সাবানের বুদবুদ ফোলানো, হারমোনিকার মতো বাদ্যযন্ত্র বাজানো প্রভৃতি। এই সব আকর্ষক শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম বাচ্চাদের উৎসাহ বৃদ্ধি করতে অত্যন্ত কার্যকর।

খেলাধুলো, শারীরিক কসরত :- রোজ অন্তত একটি ঘণ্টা ছোটাছুটি করে খেলার জন্য থাকুক। এরকম করলে শিশুর দেহ থেকে ঘাম ঝরবে। তার জেরে দেহে এনডরফিন বেশি পরিমাণে নিঃসৃত হবে। খেলাধুলোর পরেই বাচ্চাকে পড়াতে বসালে প্রথম ঘণ্টাখানেকের পড়ায় ওর পুরো মনোযোগ থাকবে।

ইন্ডোর গেমস :- বাজারে আজকাল প্রচুর ইন্ডোর গেমস ও বইপত্র পাওয়া যায়, যেগুলো বাচ্চার কগনিটিভ স্কিল বাড়াতে সহায়ক। এগুলোর মধ্যে আছে নানা ধরনের অ্যাকটিভিটি বুক, বিল্ডিং ব্লকস, পাজ়লস ইত্যাদি। শিশুর হাতে স্মার্টফোনের বদলে এই ধরনের খেলা বা বই তুলে দিলে মনোযোগের সমস্যা বেশ কিছুটা কমে যাবে। সন্ধেবেলা পড়ার মধ্যে একটু বিরতি নিয়ে খানিকটা সময় পাজ়ল সলভ করলে বা বিল্ডিং ব্লকস নিয়ে খেলে নিলে কখনোই মনোযোগে ঘাটতি পড়বে না। তাছাড়া টানা লেখাপড়া করার একঘেয়েমি থেকেও রেহাই পাবে শিশু।

সঙ্গীত মনোযোগ বাড়ায় :- ছোট থেকে শিশুকে বাদ্যযন্ত্র বা মিউজ়িক ইনস্ট্রুমেন্টে তালিম দিতে পারেন। অনেক দেশে শিশুকে আড়াই বছর বয়স থেকে পিয়ানো শেখানো হয়। এখানে যে কোনও শিশুকে অত কম বয়স থেকে বাদ্যযন্ত্রে তালিম দেওয়া সম্ভব না হলেও যতদূর সম্ভব ছোটো বয়স থেকে তবলা, মাউথ অর্গ্যান, সিন্থেসাইজ়ার যে কোনও একটি বাজনা শেখালে ভালো ফল পাওয়া যাবে। এ কথা প্রমাণিত যে নোট ধরে সুর তোলার মধ্য দিয়ে শিশুদের মনসংযোগ অনেকটাই বাড়ে। তাই অভ্যাস হিসেবে বাচ্চাকে বাদ্যযন্ত্রে তালিম দেওয়া হোক।

গল্প বলা :- রাতে শোওয়ার আগে কিছুটা সময় গল্প বলার জন্য বরাদ্দ থাকুক। হাত পা নেড়ে আকর্ষক ভঙ্গীতে গল্প বললে শিশুরা শুনতে আগ্রহী হবে। গল্প বলার ফাঁকেফাঁকে শিশুকে প্রশ্ন করার সুযোগ দিতে হবে। এর ফলে খুদে শ্রোতাটির ধৈর্য ধরে শোনার অভ্যাস গড়ে উঠবে। মনোযোগ বাড়াতে গল্প শোনানোর ভূমিকা বিরাট। বাচ্চা মন দিয়ে গল্প শুনছে কি না, তা বুঝতে বাবা-মা পরে গল্প সংক্রান্ত প্রশ্ন করে যাচাই করে নিতে পারেন।

সংক্ষিপ্ত নির্দেশ :- বড় কাজকে ছোটো ছোটো কাজে ভাগ করে দিতে হবে। একটি বড় কাজ ঠিক মতো করতে সাধারণত বেশি মনোযোগের প্রয়োজন হয়।তাছাড়া একটি বড় কাজ সম্পন্ন করা বেশ সময় সাপেক্ষ। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাচ্চারা বড় কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তেমন বড় কাজে মনোযোগ বসানোও শিশুর পক্ষে খুব মুশ্কিল হয়ে ওঠে। তাই বড় কাজগুলিকে ছোটো ছোটো কাজে ভাগ করে দিতে হবে। এতে বাচ্চাদের কাজ করার আগ্রহ বজায় থাকবে। সেই সঙ্গে ছোটো কাজে মনোনিবেশ করাও সহজ হবে। হোমওয়ার্ক করা, নতুন কিছু শেখা এবং বাড়ির টুকিটাকি কাজ করার সময় এই পদ্ধতি নেওয়া যায়। ছোটো ছোটো কাজ সম্পন্ন করতে সময় কম লাগবে এবং শিশুর মানসিক বিকাশে সহায়তাও হবে। লেখার সময়েও শিশুকে ছোটো ছোটো নির্দেশ দিতে হবে। তিনটে নির্দেশ দিয়ে শুরু করলে ভালো। নির্দেশগুলি হবে এরকম- ছবি আঁকার ক্ষেত্রে ‘পয়েন্টগুলোকে জুড়ে দাও, রং দিয়ে আউটলাইন টানো, ভেতরে রং দাও।’ আস্তে আস্তে নির্দেশের সংখ্যা বাড়াতে হবে আর দেখতে হবে শিশু কতটা মনে রাখতে পারছে। বাড়িতে নির্দেশ মতো ঠিকঠাক কাজ করার অভ্যেস গড়ে তুললে স্কুলেও শিক্ষকদের নির্দেশ মানতে অসুবিধা হবে না।

কাজের সঙ্গে আনন্দ করার সুযোগও দিতে হবে :- ছোটো শিশুরা যদি একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি কাজে জড়িত থাকে, তবে তাদের ক্লান্ত লাগে । তাই মনোযোগ বৃদ্ধি করতে, কাজের পাশাপাশি মজা করার জন্যও পর্যাপ্ত অবসর দিন। এটি আপনার বাচ্চার মনোযোগ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি, কাজের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি করতেও সাহায্য করবে।

বিভ্রান্তি কমানোর চেষ্টা করা :- বাচ্চাদের মন চঞ্চল। খুব সহজেই তাদের মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়। তাই বাচ্চাদের মনোযোগ বৃদ্ধি করতে, কম বিভ্রান্তিকর পরিবেশ তৈরি করা আবশ্যক। টেলিভিশন চালানো, জোরে গান, চিৎকার এবং মোবাইল ফোনের আওয়াজ, এগুলি শিশুদের জন্য বিভ্রান্তি হিসেবে দেখা দেয়। পড়াশোনার সময় বাচ্চাদের মোবাইল কিংবা ইন্টারনেট থেকে দূরে রাখতে হবে। এই সব সতর্ক পদক্ষেপ শিশুদের মনোযোগ বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে।

অঙ্ক করার সুফল :- শিশু প্রথম শ্রেণীতে ওঠার পর অর্থাৎ মোটামুটি ছয়-সাত বছর বয়স থেকেই নিয়মিত খেলাধুলোর পাশাপাশি তার মধ্যে প্রতি দিন কিছুটা সময় অঙ্ক কষার অভ্যেস গড়ে তুলতে হবে। অঙ্ক মানে কিন্তু শুধুই সিলেবাসের এক ধরণের অঙ্ক নয়। পাঠ্য বইয়ের বাইরে অন্য বইয়ের অঙ্কও কষতে হবে, কিছুটা ধাঁধার সমাধান করার মতো করে। অভিভাবকদের মনে রাখা দরকার, মনোযোগ বাড়াতে অঙ্কই হয়ে উঠতে পারে সবচেয়ে বড় সহায়ক। সাম্প্রতিক একটি গবেষণা অনুযায়ী, একটি শিশু যদি দিনে অন্তত দশটা নানা ধরনের অঙ্ক কষতে পারে, তা হলে অজানা কোনও বিষয় সমাধানের ব্যাপারে তার মনোযোগ অনেক বেড়ে যায়। ভবিষ্যতেও নানা ধরণের জটিল পরিস্থিতির সুরাহা করার দিক দিয়ে সে অন্যদের তুলনায় এগিয়ে থাকবে। আবার কোনও বাচ্চার যদি অঙ্কে ভয় থাকে, সে ক্ষেত্রে পড়তে বসে প্রথমে অঙ্ক করে, পরে তার প্রিয় বিষয়গুলি যেমন সাধারণ জ্ঞান, ভূগোল বা পছন্দের ভাষা পড়াতে পারেন। পড়ার প্রথম পর্যায়ে সবারই মনোযোগ বেশি থাকে তা প্রমাণিত। অতএব প্রথমেই অপছন্দের বিষয় পড়ে ফেলতে হবে। শেষের দিকে প্রিয় বিষয় থাকলে অসুবিধা নেই।

খেলার মতো করে শেখানো :- পড়তে বসিয়ে বা আঁকতে বসিয়ে সব সময় মনোযোগ বাড়ানো যায় না, এটাও ঠিক। সে ক্ষেত্রে ছোটো ছোটো খেলা খেলতে পারলে ভালো। সেগুলি এরকম। ধরে নেওয়া গেল, বাবা বাজার করতে যাচ্ছেন। সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে বাজারে যান। তাকে বলা হোক, বাজারে যত সবুজ জিনিসপত্র দেখতে পাচ্ছে, সেগুলো গুণেগুণে বাবাকে বলতে। আবার কোথাও বেড়াতে গিয়ে, এই ধরণের হালকা হিসেব করা যেতে পারে। বাচ্চাকে বলা হোক, পাঁচ দিয়ে শেষ হওয়া কটি ট্রাকের নাম্বারপ্লেট তার চোখে পড়ল, গুণে গুণে বাবাকে জানাতে। এতেও সন্তানের মনোযোগ বাড়বে।

একই সময়ে একই কাজের পুনরাবৃত্তি :- আপনার সন্তানকে প্রতিদিন একই সময়ে লেখাপড়া করতে উৎসাহ দিন। একই সময় প্রতিদিন হোমওয়ার্ক করলে এটি একটি সুঅভ্যাস হিসেবে গড়ে উঠবে। এই ব্যাপারটি রোজ একই সময়ে করা হয় বলে ওই কাজের প্রতি আলাদা করে মনোযোগ দেওয়ার দরকার হবে না। প্রতি দিন সেই নির্দিষ্ট সময়টিতে শিশু নিজেই পড়তে বসে যাবে। এই অভ্যাস শিশুদের মনোযোগ বৃদ্ধি করতেও সহায়ক।

মা-বাবার কর্তব্য :- বাবা ও মা-কে বাচ্চার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হবে, তার সমস্যা মন দিয়ে শুনতে হবে। মা-বাবা বিরক্ত না হয়ে বাচ্চার কথা শুনলে স্বাভাবিকভাবে তার ছটফটে ভাব ধীরে ধীরে কমে যাবে। ওর হোমওয়ার্ক ওকেই করতে দিতে হবে। শিশু শিক্ষকদের বকুনি খাবে, এমন ভয় থেকে বাবা ও মা যেন হোমওয়ার্ক করে না দেন। এর ফলে শিশু পড়াশোনার গুরুত্ব বুঝতে পারবে। সন্তানের বয়স বারো-চোদ্দোয় পৌঁছলে তার পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করা উচিৎ। পড়ানোর সময়ে টাইমার ব্যবহার করা যায়। প্রতিটি টাস্কের সময় বেঁধে দিন। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একেকটি টাস্ক শেষ করে ফেলার অভ্যেস হলে পরীক্ষায় সুবিধে হবে।

বাচ্চাদের সামনে অভিভাবকেরা যেন তার পড়াশোনা নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ না করেন। শিশুর সামনে মনের ভাব চেপে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতে হবে। বাবা মা এরকম না করলে শিশুর মধ্যেও পড়াশোনা নিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। বাড়ির পরিবেশ স্বচ্ছন্দ থাকলে অবধারিতভাবে শিশুর স্বভাবে সেটির গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া হয়। পড়ায় তার মনোযোগ বাড়ে এবং সারা জীবন কারণে-অকারণে উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রবণতাও কমে যায়।

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

5 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

5 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

5 months ago