টনসিলাইটিস বা টনসিল এর সমস্যায় ভোগেন অনেক মানুষ কিন্তু এর সু-চিকিৎসা পেতে দৌড়তে হয় ডাক্তারের কাছে।আজ এই টনসিল ইনফেকশনের লক্ষণ ও তার ঘরোয়া চিকিৎসা সম্পর্কে আলচনা করা হল।
গলার পিছনের দিকে অবস্থিত দুটি লসিকা গ্রন্থিকে টনসিল বলা হয়। এই গ্রন্থি শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কাজ করে এবং শরীরকে বিভিন্ন সংক্রমনের হাত থেকে রক্ষা করে। যখন টনসিলে প্রদাহ এবং সংক্রমণ হয়, তখন তাকে টনসিলাইটিস বলা হয়। এই সমস্যা যেকোনো বয়সে হতে পারে, তবে শিশুবয়সে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। এই রোগের সাধারণ লক্ষণগুলি হল— জ্বর, গলা ব্যাথা, টনসিল ফুলে যাওয়া ইত্যাদি। এটি ছোঁয়াচে এবং খুব সাধারণ ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার আক্রমনে এটি হতে পারে, যেমন — স্ট্রেপটোকক্বাস। এর আক্রমনে স্ট্রেপ থ্রোট হতে দেখা যায়। এর ফলে গল্যা ব্যথা ও প্রদাহ হয়। এটির কারনে টনসিলাইটিস হলে এবং তার যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করা হয় তাহলে এ থেকে বড় সমস্যা হতে পারে। টনসিলাইটিস এর রোগ নির্ণয় খুব সহজেই হয়ে যায় এবং রোগলক্ষন সাত থেকে দশদিনের ভেতর চলে যায়।
টনসিলাইটিস তিন প্রকারের হয়ে থাকে। অ্যাকিউট, ক্রনিক, রিকারেণ্ট। টনসিল ইনফেকশনের এর লক্ষণগুলি হল —
অ্যাকিউট টনসিলাইটিস
টনসিলাইটিস শিশুদের মধ্যে খুব কমন। সব শিশুদের অন্তত একবার টনসিলাইটিস হবেই। রোগের লক্ষণ যদি ১০ দিন বা তার বেশি স্থায়ী হয় তাহলে সেটি অ্যাকিউট টনসিলাইটিস। যদি রোগলক্ষণ এর থেকেও বেশিদিন স্থায়ী হয় বা টনসিলাইটিস একই বছরে বারবার ফিরে আসে তাহলে সেটি রিকারেণ্ট বা ক্রনিক টনসিলাইটিস। অ্যাকিউট টনসিলাইটিস সাধারণত ঘরোয়া চিকিৎসাতেই সেরে যায়, তবে এতে না সারলে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন পড়ে।
ক্রনিক টনসিলাইটিস
ক্রনিক টনসিলাইটিসের রোগলক্ষণ অনেক বেশিদিন ধরে স্থায়ী হয়। ক্রনিক টনসিলাইটিসের ফলে টনসিল স্টোন তৈরি হয়। মৃত কোষ, স্যালাইভা, খাবার ইত্যাদি টনসিলের ওপর জমা হয় এবং ধীরে ধীরে এগুলো শক্ত পাথরের মতো আকার নেয়। নিজে থেকে এটা বেরিয়ে না গেলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। ক্রনিক টনসিলাইটিস থাকলে চিকিৎসক অধিকাংশ সময়ে টনসিলেক্টমি অর্থাৎ অস্ত্রোপচার করে টনসিল বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
রিকারেন্ট টনসিলাইটিস
রিকারেণ্ট টনসিলাইটিসের একমাত্র চিকিৎসা হল টনসিলেক্টমি। যা দেখে বোঝা যায় যে এটি রিকারেন্ট টনসিলাইটিস, সেগুলি হল —
ক্রনিক এবং রিকারেণ্ট টনসিলাইটিস টনসিলের ভাঁজে থাকা বায়োফিল্মসের কারনে হয়ে থাকে। বায়োফিল্ম হল একপ্রকার মাইক্রোঅরগ্যানিজম যা অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্টেন্স বাড়িয়ে তোলে, ফলে ইনফেকশন বারবার ফিরে আসে। এছাড়া দেখা গেছে যে জেনেটিক এর কারনে কিছু মানুষ গ্রুপ এ স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না, ফলে বারংবার সংক্রমনের মুখে পড়ে।
টনসিলাইটিস থাকলে রোগলক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার ২৪–৪৮ ঘন্টা আগে রোগীর থেকে এটি অন্যদের মধ্যে ছড়ায়। রোগলক্ষণ চলে যাওয়ার পরও ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। অ্যান্টিবায়োটিক নিলে তা খাওয়ার ২৪ ঘন্টা পরে আর রোগীর থেকে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে না।
রোগীর হাঁচি বা কাশির সময় জীবাণু ড্রপলেটস এর মাধ্যমে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং কোনো সুস্থ ব্যক্তি যদি ওই বাতাসে শ্বাস গ্রহণ করে তো সুস্থ ব্যক্তিও রোগে আক্রান্ত হয়। এছাড়া কোনো সুস্থ ব্যক্তি যদি সংক্রমিত জড় পদার্থ যেমন দরজার হাতল, বা বারবার হাত দিতে হয় এমন কোনো জায়গায় হাত দিয়ে সেই হাতে নিজের নাক, চোখ,মুখে হাত দেয়, সেখান থেকেও সুস্থ ব্যক্তিও সংক্রমিত হতে পারে।
একসাথে অনেক মানুষের সংস্পর্শে আসলে রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সেই কারণে বাচ্চারা যারা স্কুলে যায়, তাদের রোগটা বেশি হয়। তাই রোগলক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে একান্তে ঘরের ভেতর থাকাই উচিত। টনসিলাইটিস হয়েছে এমন ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার পর ২–৪ দিন সময় লাগে রোগলক্ষণ প্রকাশ পেতে।
শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রথম সারিতেই আছে টনসিল। টনসিল আমাদের শরীরে শ্বেত রক্ত কনিকা প্রদান করে, যা শরীরের রোগপ্রতিরোধ করে। মুখ ও নাকের মাধ্যমে শরীরে যে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে টনসিল তাদের সাথে সবার আগে লড়াই করে, আবার অনেক সময় এই ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার দ্বারাই আক্রান্ত হয়। ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া উভয়ের আক্রমনেই হয়ে থাকে টনসিলাইটিস ।
ভাইরাল টনসিলাইটিস
টনসিলাইটিসের প্রধান কারন হল ভাইরাসের আক্রমণ। সাধারণ ঠান্ডা লাগা, জ্বর যে ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে, সেই একই ভাইরাসের কারণে টনসিলাইটিস হয়ে থাকে। এছাড়াও রাইনোভাইরাস, এপস্টিন–বার ভাইরাস, হেপাটাইটিস এ, এইচআইভি (HIV) ভাইরাসের কারনে টনসিলাইটিস হয়ে থাকে।
ভাইরাল টনসিলাইটিসের ক্ষেত্রে রোগলক্ষণগুলি হল— কাশি, নাকবন্ধ ইত্যাদি। অ্যান্টিবায়োটিক এক্ষেত্রে কাজ করে না।
ব্যাকটেরিয়াল টনসিলাইটিস
৫ থেকে ১৫ বছরের বাচ্চাদের ভেতর ব্যাকটেরিয়াল টনসিলাইটিস বেশি হয়ে থাকে। এর চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক প্রেস্ক্রাইব করেন।
টনসিলের অবস্থা দেখে চিকিৎসক বুঝতে পারেন। এছাড়া থ্রোট কালচার করা হয়, যেখানে গলার পেছন দিকের থেকে স্যাম্পেল নিয়ে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। চিকিৎসক ব্লাড টেস্ট করতে পারেন, টনসিলাইটিস ব্যাকটেরিয়াল না ভাইরাল তা বোঝার জন্য।
টনসিলাইটিসের চিকিৎসা সবসময় প্রয়োজন হয় না, বিশেষ করে যদি তা কোল্ড ভাইরাসের কারনে হয়ে থাকে। অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা হয় এবং খুব সিরিয়াস সমস্যা হলে টনসিলেক্টমি করা হয়। টনসিলের কারণে যদি কোনো ব্যক্তির ডিহাইড্রেশন হয়, তখন তাকে ইন্ট্রাভেনাস ফ্লুয়িড দেওয়া হয়। এছাড়া গলার ব্যাথার জন্য ব্যাথা কমানোর ওষুধও দেওয়া হয়।
অপারেশনের মাধ্যমে টনসিল গ্ল্যান্ড কে বাদ দিয়ে দেওয়া কে টনসিলেক্টমি বলা হয়। সাধারণত অ্যাকিউট ও পারসিস্টেন্ট টনসিলাইটিসের ক্ষেত্রে এটি করা হয়। এই অপারেশনের ফলে টনসিলাইটিসের কারণে হওয়া ব্রিদিং প্রবলেম (শ্বাসকষ্ট) ও খাবার গিলতে না পারার সমস্যা থেকে রোগী মুক্তি পায়। যদিও দেখা গেছে যে যাদের শিশু বয়সে টনসিলেক্টমি করা হয়েছে, বড় হয়ে তাদের ভেতর শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত সমস্যা ও অন্যান্য ইনফেকশনে ভোগার সমস্যা বেড়ে গেছে। টনসিলেক্টমি হওয়ার পরও স্ট্রেপ থ্রোট এবং গলার অন্যান্য ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা কমে গেলেও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় না। খুব রেয়ার হলেও কারোর অপারেশনের পরেও আবার টনসিল নতুন করে বেড়ে উঠতে পারে।
যদি ব্যাকটেরিয়ার কারণে টনসিলাইটিস হয় তবে চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন। এতে রোগলক্ষণ বেশ তাড়াতাড়ি সেরে যায়। তবে এর কিছু পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াও আছে। অ্যান্টিবায়োটিক অতিরিক্ত খাওয়া হলে অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্টেন্স তৈরি হয়ে যায়, ফলে পরবর্তী কালে সেই অ্যান্টিবায়োটিকে আর কাজ হয় না। অ্যান্টিবায়োটিক খারাপ ব্যাকটেরিয়ার সাথে ভালো ব্যাকটেরিয়াকেও মেরে ফেলে, তার ফলে একই রোগ আবার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার সময় অনেকেরই পেটের নানারকম সমস্যা দেখা যায়। অ্যান্টিবায়োটিক খেলে কিছু জিনিস অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে , যেমন -রোগলক্ষণ সম্পূর্ণ সেরে গেলেও অ্যান্টিবায়োটিকের পুরো কোর্স কমপ্লিট করতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক একেবারেই খাওয়া যাবে না।
টনসিলাইটিস ও স্ট্রেপ থ্রোট একই ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা যদিও বা হয়, তবে এ দুটো এক জিনিস নয়। টনসিলাইটিস গ্রুপ এ স্ট্রেপটোকক্ক্বাস ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস দ্বারা হতে পারে। কিন্তু স্ট্রেপ থ্রোট কেবল মাত্র গ্রুপ এ স্ট্রেপটোকক্বাস ব্যাকটেরিয়ার কারণেই হয়ে থাকে। টনসিলাইটিসের রোগলক্ষণের সাথে সাথে এতে আরও বেশ কিছু রোগলক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়। যেমন —
যদিও খুব রেয়ার তবে কিছু ক্ষেত্রে টনসিলাইটিসের কারনে গলা এত ফুলে যায় যে রোগীর পক্ষে শ্বাস গ্রহন করা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। সেরকম হলে তৎক্ষনাত চিকিৎসকের শরনাপন্ন হতে হবে।
টনসিল ইনফেকশন বা টনসিলাইটিস প্রতিরোধের উপায়
টনসিলাইটিস প্রতিরোধের প্রধান উপায় হল,যার টনসিলাইটিস হয়েছে, বা গলা ব্যাথা হচ্ছে, এমন ব্যক্তির থেকে নিজের ও সন্তানের দূরত্ব বজায় রাখুন। যাঁর হাঁচি কাশি বা গলা ব্যাথা হচ্ছে এরকম ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে ফেলুন।
কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…
ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…
সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…
পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…
কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…
ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…
This website uses cookies.
Read More
Leave a Comment