ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড কি? ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্ন ও উত্তর

Published by

ধরুন আপনি আপনার গাইনিকোলজিস্টের কাছ থেকে রুটিন চেকআপ সেরে এসেছেন এবং তিনি বলেছেন যে সম্ভবত আপনি ইউটেরাইন ফাইব্রয়েডে আক্রান্ত। শুনে হয়ত ভাবতে থাকবেন ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড কি? ক্যান্সার নয় তো! এতে কি সমস্যা হয়? এগুলো কি সার্জারী করা প্রয়োজন?  কিভাবে সার্জারী হবে?

প্রথমেই বলি, শান্ত হোন, ফাইব্রয়েড খুবই কমন। প্রায় ২০ –৭০% মহিলাদের সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম বয়সটায় ফাইব্রয়েডের সমস্যা হয়ে থাকে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো তে কোনো সমস্যা হয় না। তার মানে এই নিয় যে ফাইব্রয়েডকে অবহেলা করতে হবে। এর ফলে অতিরিক্ত রক্তপাত ও অন্যান্য ফার্টিলিটি সংক্রান্ত সমস্যা দেখা যায়। এখানে কিছু প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে আমরা বুঝে নেবো এই ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড কি? কিভাবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে এবং কি করলে মহিলারা এর থেকে মুক্তি পেতে পারেন, তাই নিয়ে আমরা আলোচনা করবো।

ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড কি?

অনেকের মনেই একটি প্রশ্ন থাকে, জরায়ুর টিউমার বা ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড কি ক্যান্সারাস টিউমার? এক কথায় এর উত্তর – না। এটি একপ্রকার নন ক্যান্সারাস গ্রোথ, যা জরায়ুর ভেতর তৈরি হয়। এগুলো খুবই কমন। জরায়ুর দেওয়ালের গায়ের বাইরের দিকে ফাইব্রয়েডকে সাবসেরোসাল ফাইব্রয়েড বলা হয়। জরায়ুর পেশির ভেতর দিকে ফাইব্রয়েড হলে তাকে ইন্ট্রামিউরাল ফাইব্রয়েড বলে এবং জরায়ুর ক্যাভিটির ভেতর যে ফাইব্রয়েড হয়, তাকে সাবমিউকোসাল ফাইব্রয়েড বলে।

ফাইব্রয়েড হওয়ার কারন

ফাইব্রয়েড হওয়ার পিছনে বংশগতির প্রভাব ভীষণ ভাবে থাকে। এখনও পর্যন্ত কোনো জীবন ধারনের পদ্ধতির সমস্যার কথা জানা যায়নি, যা ফাইব্রয়েডের কারন হতে পারে।

ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড এর লক্ষন

কিছু কিছু মহিলার ক্ষেত্রে ইউটেরাইন ফাইব্রয়েডের কোনো লক্ষনই থাকে না, এমনকি তাঁরা বুঝতেই পারেন না, যে তাঁদের ফাইব্রয়েড আছে। আবার কিছু কিছু মহিলার গুরুতর রোগলক্ষন থাকে। প্রধান রোগলক্ষন হল মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত। কোনো কোনো মহিলার এতই বেশি রক্তপাত হয় যে তারা অ্যানিমিয়ার শিকার হয়। ইউটেরাইন ক্যাভিটির কাছাকাছি থাকা ফাইব্রয়েডগুলো সাধারণত বেশি রক্তপাত ঘটায়।

কিছু মহিলাদের ফাইব্রয়েডের আকার এতটাই বড় হয় যে জরায়ুর আকৃতি স্বাভাবিকের থেকে ১০ গুন বেড়ে যায়। একেই চিকিৎসকরা “বাল্ক সিম্পটম” বলেন। কিছু মহিলাদের যেমন মনে হয় যে তাঁরা প্রেগন্যান্ট। জরায়ুর বাল্ক সাইজের জন্য কোষ্ঠকাঠিন্য বা ঘনঘন মূত্রত্যাগের মতো সমস্যাও দেখা যায়।

অন্যান্য সমস্যারও কি এই রোগলক্ষনগুলো হতে পারে?

এই একই ধরনের রোগলক্ষন আর যে যে সমস্যার জন্য হয়ে থাকে, সেগুলো হল — ইউটেরাইন পলিপ, ডিসফাংশনাল ইউটেরাইন ব্লিডিং এবং হরমোনাল সমস্যার কারণে অতিরিক্ত ব্লিডিং হতে পারে।

কিভাবে ফাইব্রয়েডের সমস্যার রোগ নির্ণয় করা হয়

সাধারণত আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে ফাইব্রয়েডের ডায়গনসিস করা হয়। এটাই সবচেয়ে সহজ উপায় জরায়ুকে ভালো ভাবে লক্ষ্য করার এবং এর ফলে ফাইব্রয়েডগুলো খুব সহজেই দেখা যায়। খুব ছোট ছোট ফাইব্রয়েডের ক্ষেত্রে এই আল্ট্রাসাউন্ডই একমাত্র উপায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিকিৎসক MRI ও করে থাকেন, সমগ্র পেলভিক অঞ্চল টা পরীক্ষা করার জন্য।

কিভাবে ফাইব্রয়েডের চিকিৎসা করা হয়?

চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ভর করে ফাইব্রয়েডের আকার ও রোগলক্ষনের ওপর। ইউটেরাইন ক্যাভিটির ভেতর দিকে ফাইব্রয়েড থাকলে ডাক্তার হিস্টেরেস্কোপিক মায়োমেক্টমি করে থাকেন, যেখানে ক্যামেরার সাহায্যে জরায়ুর ভেতরটা দেখা হয়। ওই একই সময়ে চিকিৎসক সার্জারী করে ফাইব্রয়েডকে বাদ দিয়ে দেন, যদি সেটা একদম জরায়ুর ক্যাভিটির একদম ভেতরে থাকে।

যদি কোনো মহিলার রোগলক্ষন খুব গুরুতর হয় এবং ফাইব্রয়েডের অবস্থান যদি জরায়ুর পেশির ভেতর বা জরায়ুর বাইরের অংশে হয়, তবে সার্জারী একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে রোবোটিক অ্যাসিস্টেড ল্যাপ্রোস্কোপিক মায়োমেকটমি সবথেকে উপযুক্ত। এর মাধ্যমে পেটে মাত্র চার থেকে পাঁচটি ফুটো করা হয় এবং খুব ছোট ছোট যন্ত্রের মাধ্যমে ফাইব্রয়েডগুলোকে বের করে নিয়ে আসা হয়।

জরায়ুর টিউমারের চিকিৎসায় ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি

এর থেকে সিভিয়ার কেসে বড় করে কেটে মায়োমেক্টমি করা হয়। একে অ্যাবডোমিনাল মায়োমেক্টমি বলা হয়। তলপেটে বড় করে কেটে চিকিৎসক ফাইব্রয়েডগুলো কেটে বের করে দেন।

কিছু নন সার্জিক্যাল পদ্ধতিতেও ইউটেরাইন ফাইব্রয়েডকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেগুলোকে আকারে ছোট করে দেওয়া হয় এবং তার গ্রোথ ধীরে করে দেওয়া হয়, যেমন বার্থ কন্ট্রোল পিল। লিউপ্রোলাইড অ্যাসিটেট নামক একপ্রকার ওষুধ আছে, যার মাধ্যমে ফাইব্রয়েডের আকার ছোট করে দেওয়া যায়।

ফাইব্রয়েড কিভাবে ফার্টিলিটি ও প্রেগন্যান্সির ওপর প্রভাব ফেলে

ফাইব্রয়েডের আকার তার অবস্থান এবং তার রোগ লক্ষন এই সবকিছুই ফার্টিলিটি ও প্রেগন্যান্সির ওপর প্রভাব ফেলে। ইউটেরাইন ক্যাভিটির ভেতরের ফাইব্রয়েড এমব্রায়োকে জরায়ুর গায়ে ইমপ্লান্ট হতে বাধা দেয় এবং এর ফলে ফিটাস অর্থাৎ ভ্রূণের গঠন হতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। চার সেন্টিমিটার বা তার থেকে বড় আকারের ফাইব্রয়েড যা জরায়ুর দেওয়ালের ভেতরে বা তার পেশির ভেতর তৈরি হয় সেগুলোও ইমপ্লান্টেশনে বাধা দেয়। জরায়ুর পেশির ভেতর অবস্থিত ফাইব্রয়েড ফ্যালোপিয়ান টিউব কে ব্লক করে দেয়, ফলে ইনফার্টিলিটি হয়ে থাকে।

ছোট ও মাঝারি আকারের ফাইব্রয়েড সাধারণত প্রেগন্যান্সিতে বাধা সৃষ্টি করে না, তবে প্রেগন্যান্সির সময় হরমোনের উৎপাদন বেড়ে যায় এবং রক্তসঞ্চালন বেড়ে যাওয়ার কারণে ফাইব্রয়েডগুলির আকার বৃদ্ধি পায়। আকারে বড় ও সংখ্যায় অনেক ফাইব্রয়েড থাকলে প্রেগন্যান্সি ও ডেলিভারিতে যে যে সমস্যা দেখা যায়, সেগুলো হল —

  • সিজারিয়ান সেকশন — যেসব মহিলাদের ফাইব্রয়েড থাকে তাদের ক্ষেত্রে সিজারিয়ান সেকশন করার সম্ভাবনা ছয়গুন বেড়ে যায়।
  • ব্রিচ প্রেসেন্টেশন — বাচ্চার মাথা নীচের দিকে থাকার পরিবর্তে পা নীচের দিকে ও মাথা ওপরের দিকে থাকে।
  • প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশন — বাচ্চা ডেলিভারি হওয়ার আগেই জরায়ুর দেওয়াল থেকে প্লাসেন্টা ভেঙে যায়। এর ফলে বাচ্চা তখন অক্সিজেন পায় না।
  • প্রিটার্ম ডেলিভারি — বাচ্চার জন্ম সঠিক সময়ের আগে অর্থাৎ প্রেগন্যান্সির ৩৭ সপ্তাহের আগেই হয়ে য
ফাইব্রয়েড থাকলে সন্তান ধারন সম্ভব কি না

বেশিরভাগ সময়েই ফাইব্রয়েড প্রেগন্যান্ট হওয়ার ক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলে না। কিন্তু ফাইব্রয়েডের পরিমাণ যদি অনেক থাকে এবং সেগুলো সাবমিউকোসাল হয়, তাহলে তা ফার্টিলিটির ওপর প্রভাব ফেলে। ফাইব্রয়েড ওভ্যুলেশনে কোনো সমস্যা করে না, কিন্তু সাবমিউকোসাল ফাইব্রয়েড কন্সেপশন ও প্রেগন্যান্সি ক্যারি করতে সমস্যা তৈরি করে। এই ধরনের ফাইব্রয়েড ইনফার্টিলিটি বা প্রেগন্যান্সি লসের জন্যও দায়ী হয়। যদি আপনি প্রেগন্যান্ট হন বা কনসিভ করতে চাইছেন, তাহলে ফাইব্রয়েডেএ নিয়মিত চিকিৎসা ও তার খেয়াল রাখা খুবই জরুরি।

ফাইব্রয়েড কি ক্যান্সারে পরিনত হতে পারে?

ফাইব্রয়েড অধিকাংশ সময়েই বিনাইন অর্থাৎ এর থেকে ক্যান্সার হয় না। খুব রেয়ার কেসে (হাজার জনে এক জনেরও কম) ক্যান্সারাস ফাইব্রয়েড হয়ে থাকে। একে লেইওমায়োসারকোমা বলা হয়। যার ফাইব্রয়েড রয়েছে, তার সেই ফসিব্রয়েড থেকে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফাইব্রয়েড থাকলে তা থেকে ক্যান্সারাস ফাইব্রয়েড হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায় না বা ইউটেরাসে অন্য কোনো ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয় না।

চিকিৎসার পরও কি ফাইব্রয়েড ফেরত আসতে পারে?

চিকিৎসার মাধ্যমে ফাইব্রয়েডের অবস্থা ও তার রোগলক্ষনের উপশম হয় ঠিকই, তবে একমাত্র হিসটেরেক্টমি ছাড়া অন্য সব চিকিৎসা পদ্ধতিতেই ফাইব্রয়েড ফিরে আসতে বা নতুন করে হতে পারে। হিসটেরেক্টমিতে চিকিৎসক সম্পূর্ণ জরায়ুটাই বাদ দিয়ে দেন।

কি ধরনের খাদ্য বাদ দিলে ফাইব্রয়েড হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়?

ফাইব্রয়েডের ওপর খাদ্যের প্রভাব নিয়ে চিকিৎসকেরা এখনো গবেষণা করে যাচ্ছেন, তবে দেখা গেছে যে রেড মিট বেশি পরিমানে খেলে ফাইব্রয়েড হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

Anshula Banerjee

Hello, I am Anshula Banerjee, completed my post-graduation degree in English, along with Bachelor of Education. I live at Nadia. I am a voracious reader in various fields of knowledge that may help the readers to satisfy their urge specially in the area of health and wellness.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago