আই ভি এফ কি এবং কেন করা হয় ?

Published by

আই ভি এফ কি ?

In Vitro Fertilisation (IVF) বা কৃত্রিম প্রজনন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার চিকিৎসাকে পুরো পাল্টে দিয়েছে এই পদ্ধতি। প্রকৃতপক্ষে আই ভি এফ হচ্ছে প্রজননে সহায়ক একটি প্রযুক্তি বা Assisted Reproductive Technology (এ আর টি)। উল্লেখ্য আই ভি এফ- এর ভেতরেও বেশ কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে। টেস্ট টিউব বেবী এই পদ্ধতিগুলির অন্যতম। এই পদ্ধতিতে নারীর সুস্থ ডিম্বাণু পরীক্ষাগারে টেস্ট টিউবের মধ্যে পুরুষের শুক্রকীটের সঙ্গে নিষিক্ত করে একটি ভ্রূণ উৎপাদন করা হয়। প্রজনন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কড়া নজরদারিতে সেই ভ্রূণটিকে নারীর গর্ভে প্রতিস্থাপন করা হয়। যে সব দম্পতি সন্তান না পেয়ে হতাশায় ভোগেন তাঁদের সন্তান লাভের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে আইভিএফ।

আজকের দিনে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অসামান্য অগ্রগতি অনেক গুরুতর শারীরিক সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। এরকমই একটি সমস্যা হল সন্তানহীনতা বা বন্ধ্যাত্ব। প্রতিটি দম্পতিই সন্তান কামনা করেন। পরের প্রজন্মের মুখ দেখার জন্য স্বামী-স্ত্রীর বাবা মাও উৎসুক থাকেন। কিন্তু অনেক দম্পতিরই সন্তান হয় না। তাদের জন্য নতুন দিশা খুলে দিয়েছে “টেস্ট টিউব বেবী” নামের অত্যাধুনিক পদ্ধতি। 

বন্ধ্যাত্ব কী ?

যদি কোনো দম্পতি এক বছর জন্ম নিয়ন্ত্রণবিহীন সহবাস করার পরেও স্ত্রীর গর্ভে সন্তান না আসে তাহলে ওই জুটি বন্ধ্যাত্ব বা ইনফার্টিলিটির শিকার। এ দিকে সন্তান গর্ভে আসার জন্য স্বামী স্ত্রীর জনন তন্ত্রে কতকগুলো ব্যবস্থা ঠিকঠাক থাকা প্রয়োজন। প্রথমেই বলতে হবে, পুরুষের সুস্থ স্বাভাবিক শুক্রাণু ও নারীর সুস্থ ডিম্বাণু উৎপাদনের ক্ষমতা থাকা চাই। এছাড়া শুক্রনালী ও ডিম্বনালীর মধ্যে কোনো সমস্যা থাকা চলবে না। নিষিক্ত ডিম্বাণু ঠিক মতো গর্ভাশয়ে স্থাপিত হওয়া দরকার। তারপর সেটির যথাযথভাবে ভ্রুণের রূপ পাওয়া আবশ্যক। এই সব ব্যাপার মাথায় রেখে বলা যায়, সন্তানের জন্ম দেওয়ার পেছনে পুরুষ ও নারী দুজনেরই ভূমিকা থাকে। পুরুষের ত্রুটির জন্য বন্ধ্যাত্ব আসতে পারে আবার নারীর ত্রুটির জন্যও।

পুরুষের ক্ষেত্রে শুক্রাণুর সংখ্যা কম হওয়া অথবা একদমই না থাকা সন্তান না আসার কারণ হতে পারে। আবার শুক্রাণুর অস্বাভাবিক গঠন অথবা ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছনোর আগেই শুক্রাণুর মৃত্যু ঘটলে সন্তান আসে না। মেয়েদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সাধারণ কারণ হল- ওভুলেশন বা ডিম্বস্ফোটন সংক্রান্ত সমস্যা। এর পাশাপাশি, ঠিক মতো ডিম্বাণু উৎপন্ন না হওয়া, জরায়ুতে কোনো সমস্যা অথবা হরমোনের অসামঞ্জস্য মেয়েদের গর্ভে সন্তান না আসার কারণ হতে পারে।

পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩৩% বন্ধ্যাত্ব মহিলাদের ত্রুটির জেরে এবং প্রায় ৩৩% বন্ধ্যাত্ব পুরুষের ত্রুটির কারণে ঘটে থাকে। অবশিষ্ট ক্ষেত্রগুলিতে পুরুষ বা নারী উভয়ের ত্রুটি বা কোনো অজ্ঞাত কারণ সন্তানহীনতার জন্য দায়ী। অতএব বিজ্ঞান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে পুরুষ ও নারী যে কেউ বন্ধ্যাত্বের জন্য দায়ী হতে পারেন। তা সত্বেও আমাদের সমাজ বেশীরভাগ সময় সন্তানহীনতার জন্য মেয়েদের দোষ দেয়। এর কারণ অজ্ঞতা ও বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব। 

উন্নততর গবেষণার মাধ্যমে চিকিৎসা বিজ্ঞান বন্ধ্যাত্ব থেকে রেহাই পাওয়ার পথ সৃষ্টি করে দিয়েছে। নিঃসন্তান দম্পতিদের দুশ্চিন্তার কারণ নেই। অভিজ্ঞ ইনফার্টিলিটি স্পেশালিষ্টের কাছে গেলে তাঁরাই চিকিৎসার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে দেবেন। সন্তানের মুখ দেখার ইচ্ছা নিয়ে যখন কোনও নিঃসন্তান দম্পতি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে আসেন, প্রথমে তাঁদের বয়স, আগেকার চিকিৎসা সংক্রান্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য ইত্যাদি জানার প্রয়োজন হয়। তারপরে জননাঙ্গে কোনও সার্জারি হয়েছে কিনা, নিয়মিত পিরিওড (ঋতুস্রাব) হয় কিনা ইত্যাদি বিষয়ও জেনে নেওয়া হয়। তারপরেও দরকার মতো একাধিক ক্লিনিক্যাল টেস্ট করিয়ে সন্তান না আসার নির্দিষ্ট কারণ সম্পর্কে ধারণা করা হয়। তার উপর ভিত্তি করে ডিম্বাণু ঠিক মতো উৎপন্ন হচ্ছে কিনা তারও অনুসন্ধানের প্রয়োজন। নারীর ক্ষেত্রে কিছু হরমোনাল টেস্ট ও জরায়ুর কাঠামো ঠিক আছে কিনা তাও দেখা হয়। আর পুরুষের ক্ষেত্রে সিমেন (বীর্য) অ্যানালিসিস করা হয়।

যেসব দম্পতি বন্ধ্যাত্বের সমস্যায় ভুগছেন তাঁরা সন্তান কামনা করেন এটা একদম সত্যি। তবে অনেক সময় দেখা যায়, তাঁরা টেস্ট টিউব বেবি-পদ্ধতির মাধ্যমে সন্তান আনতে ইচ্ছা প্রকাশ করছেন না। তাঁদের ধারণা, অনেক চিকিৎসা করিয়ে ফল না পেলে তখন সন্তান লাভ করার শেষ উপায় হল টেস্ট টিউব বেবি। কিন্তু এই ধারণা ভুল। তার কারণ সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বাবা-মায়ের বয়স। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীর ডিম্বাণু উৎপাদন কমতে থাকে, ডিম্বাণুর মান পড়ে যায় এবং জরায়ুর ধারণ ক্ষমতাও কমে যায়। অন্য দিকে বয়স্ক পুরুষের ক্ষেত্রে সক্রিয় শুক্রাণুর সংখ্যা হ্রাস পেতে পারে, তার ঘনত্ব কমতে পারে এবং সংক্রমণের সমস্যাও চলে আসে। তাছাড়া পুরুষের রক্তে শর্করার পরিমাণ ইত্যাদিও প্রজননের ক্ষেত্রে জরুরি বিষয়। সাধারণত বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষের রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়। তাই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াতে সন্তান না এলে সময় নষ্ট না করে টেস্ট টিউব বেবি নেওয়াই যুক্তিযুক্ত।

অনেকেরই টেস্ট টিউব বেবি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই। কেউ বা ভাবেন, টেস্ট টিউব বেবি মানে ফার্টিলাইজেশন থেকে পূর্ণাঙ্গ শিশু সম্ভবত টেস্ট টিউবেই হয়। বিষয়টি মোটেই সেরকম নয়। টেস্ট টিউব বেবি বন্ধ্যাত্বের সমাধানে চিকিৎসার একটি বিশেষ পদ্ধতি। এই পদ্ধতির মধ্যেও একাধিক কৌশল রয়েছে। যার মধ্যে একটি হচ্ছে I.V.F. বা ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে স্ত্রীকে ঋতুস্রাবের সময় থেকে কিছু ইঞ্জেকশন দেওয়া হয় যাতে তার ডিম্বাণুগুলো বড় ও পরিপক্ক হয়। তারপর আল্ট্রা সাউণ্ড সমেত রক্ত পরীক্ষা করলে বোঝা যায় ডিম্বাণুগুলো বড়ো হচ্ছে কিনা। যখন ডিম্বাণুগুলো বড় ও পরিপক্ক হয় তখন সেগুলোকে বাইরে নিয়ে এসে স্বামীর শুক্রাণুর সঙ্গে মিলিয়ে বা নিষিক্ত করে ল্যাবোরেটরিতে ভ্রূণ সৃষ্টি করা হয়। সেই ভ্রূণ স্ত্রীর জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়। জরায়ুতে ভ্রূণ রেখে দেওয়ার কাজটা ঠিকঠাক সম্পন্ন হওয়ার পরই সেটি ধাপে ধাপে পূর্ণাঙ্গ শিশুতে রূপান্তরিত হওয়ার দিকে এগিয়ে যায়। মনে রাখতে হবে, ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলন ঘটিয়ে এই প্রক্রিয়ার সূচনার পর্যায়টুকু বাদ দিয়ে বাকি সময়টাতে বাচ্চা একেবারে স্বাভাবিক গর্ভাবস্থার মতোই মায়ের গর্ভে বেড়ে ওঠে এবং সময় এলে সেখান থেকেই ভূমিষ্ঠ হয় নবজাতক। কোনও টেস্ট টিউবে এই শিশু বড় হয় না। 

প্রাকৃতিকভাবে গর্ভধারণ করা নারীর সন্তান যেমন হয়, টেস্টটিউব বেবীও সেই রকম সুস্থ স্বাভাবিক মানবশিশু হয়ে জন্ম নেয় ও বড় হয়ে ওঠে। দুটি ক্ষেত্রেই বাচ্চাকে নয় মাস গর্ভে ধারণ করার স্বর্গীয় অনুভূতি হয় মায়েদের। তাছাড়া টেস্ট টিউব বেবীকে পৃথিবীতে আনার পুরো পদ্ধতিতে প্রজননের জন্য স্বামী ও স্ত্রী ছাড়া আর কারুর কোনও ভূমিকা নেই। সুতরাং এই পদ্ধতির সাহায্যে অনেক অনেক সন্তানহীন দম্পতি বাবা-মা হওয়ার সুখ পাচ্ছেন। শুধু ল্যাবোরেটরিতে নিষেক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ায় এবং ল্যাবোরেটরিতে অনেক টেস্ট টিউব থাকায় এই রকম নামকরণ। নিঃসন্তান দম্পতিরা সব দ্বিধা ঝেড়ে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের হাত ধরে এই প্রক্রিয়ার সহায়তা নিলে তাঁদের ভালো হবে। 

আই ভি এফ পদ্ধতি কাদের প্রয়োজন ?

(১) যে সব মেয়ের ফ্যালোপিয়ান টিউবে ব্লকেজ বা কোনো সমস্যা থাকে এবং শুক্রাণু ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করতে পারে না এই পদ্ধতি তাদের সন্তানলাভে সহায়ক।

(২) যে সব মেয়ের জরায়ুর দেওয়ালে ফাইব্রয়েড আছে বা ওভ্যুলেশন (ডিম্বস্ফোটন) ঠিকমতো হয় না তাঁদের জন্য এই প্রক্রিয়া কাজে আসে।

(৩) শারীরিক অসুস্থতা, সার্জারি বা দুর্ঘটনার ফলে যে সব মেয়ের ফ্যালোপিয়ান টিউব বাদ দিতে হয়েছে তাদের জন্য আই ভি এফ ফলদায়ী।

(৪) পুরুষদের ক্ষেত্রে লো স্পার্ম কাউন্ট বা শুক্রাণুর ঘনত্ব কম হলে এই পদ্ধতিতে সুফল মেলে।

(৫) এ ছাড়াও যদি কোনও মেয়ে জেনেটিক অর্থাৎ জিনবাহিত সমস্যার কারণে গর্ভে সন্তান ধারণ করতে না পারে তার জন্য আইভিএফ কাজে আসে।

(৬) অনেক সময়ে টেস্ট করে দেখা যায় সন্তানকামী দম্পতির কারুরই কোনও সমস্যা নেই তবু অজানা কারণে গর্ভে সন্তান আসছে না। সে ক্ষেত্রেও আইভিএফ পদ্ধতির সাহায্যে সন্তানলাভ সম্ভব।

আই ভি এফ-এর খরচ

আই ভি এফ অস্বাভাবিক ব্যয়সাপেক্ষ এমন ধারণা ঠিক নয়। নিঃসন্দেহে এ কথা বলা যায় যে আমাদের দেশে একটা সময়ে শুধু ধনীরাই এই পদ্ধতির সুফল নিতে পারতেন। কিন্তু বর্তমানে আই ভি এফ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নাগালে চলে এসেছে। আগে এই পদ্ধতিতে সন্তানলাভ করার জন্য যত খরচ হত আজকাল তার চেয়ে অনেক কম খরচ হয়। তার কারণ, এই পদ্ধতিতে যে সমস্ত ওষুধ ও সরঞ্জাম দরকার হয় সেগুলির মূল্য কমে গেছে এবং সেগুলির অধিকাংশ এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে। আগে এসব ওষুধপত্র ও সরঞ্জাম পুরোপুরি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হত যার ফলে দামও বেশি ছিল। 

এখনো আই ভি এফ করাতে সামান্য কিছু ওষুধ ও সরঞ্জাম আমদানি করতে হয় ঠিকই। তবে আমদানি করা ওষুধপত্র এবং সরঞ্জামের দামও আগের তুলনায় কমে গেছে। অন্য দিকে আজকাল হার্টের সমস্যা সমাধানে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি, হাঁটু বদল, মেরুদণ্ডের সবচেয়ে আধুনিক চিকিৎসা ইত্যাদিও যথেষ্ট ব্যয়সাধ্য যদিও বিষয়টি সেভাবে জনসমক্ষে প্রকাশ হয় না। আজকাল এই সব চিকিৎসায় যত খরচ আই ভি এফ-এর জন্য খরচ তার প্রায় অর্ধেক। সবাই যেন এই কথাটিও মনে রাখেন। খরচার দিক থেকে আইভিএফ এখন স্বল্পবিত্তদের আওতায় চলে এসেছে।

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

5 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

5 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

5 months ago