অটোইমিউন ডিজিজ কি? অটোইমিউন ডিজিজ এর কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

Published by

অটোইমিউন ডিজিজ হল শরীরের এমন এক অবস্থা, যখন কারোর শরীরের ইমিউন সিস্টেম (রোগ প্রতিরোধ তন্ত্র) তার নিজের শরীরকেই ভুল করে আক্রমণ করে। সাধারণত শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতার সমস্যা (Immune System Disorder) তখন হয়, যখন প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব কম থাকে, অথবা অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে যায়। প্রতিরোধ ক্ষমতা অতিরিক্ত সক্রিয় হলে তখন শরীর নিজেরই কোষ–কলাকে আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে।

আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা শরীরকে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে থাকে। শরীর বিজাতীয় কোনো ব্যাকটেরিয়া ভাইরাসের শিকার হলে শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতা সেই আক্রান্ত অঞ্চলে প্রতিরোধী ব্যাবস্থা শুরু করে দেয়।

অটোইমিউন ডিজিজের ক্ষেত্রে শরীরের বিভিন্ন অংশ যেমনঃ– অস্থিসংযোগ (joints), ত্বক এগুলোকে বিজাতীয় বস্তু বলে ধরে নেয় এবং তখন অটোঅ্যান্টিবডি নামক একপ্রকার প্রোটিন নির্গত করে এবং সুস্থ কোষগুলোকে আক্রমণ করে।

অটোইমিউন ডিজিজের কারণ (Cause of Immune System Disorder)

ঠিক কি কারণে এই রোগ হয়, তা এখনও অজানা। তবে মনে করা হয় যে কোনো বিশেষ প্রকারের ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া বা কখনো কোনো বিশেষ ওষুধের প্রভাবে শরীরের এমন কিছু পরিবর্তন আনে যে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার পদ্ধতিকে নষ্ট করে ফেলে।

     কিছু অটোইমিউন ডিজিজে বিশেষ জনগোষ্ঠীর মানুষ আক্রান্ত হন। যেমনঃ– লুপাস রোগে আফ্রিকান – আমেরিকান ও হিসপানিক জনগোষ্ঠীর মানুষ ককেশিয়ান জনগোষ্ঠীর মানুষের থেকে বেশি পরিমানে আক্রান্ত হন। তবে লুপাস এবং মাল্টিপল স্ক্লেরোসিসের মতো রোগ জেনেটিক হয়ে থাকে।  

     ২০১৪ এর একটি সমীক্ষা অনুযায়ী ২.৭% পুরুষ ও ৬.৪% মহিলারা এই রোগে আক্রান্ত হন। সাধারণত মহিলাদের ক্ষেত্রে সন্তানধারণের উপযুক্ত বয়স (১৫–৪৪) থেকেই এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

অটোইমিউন ডিজিজের কারণ হিসাবে খাদ্যাভ্যাস
পশ্চিমি খাদ্যাভ্যাস সংস্কৃতি, যেমনঃ– উচ্চমাত্রায় ফ্যাট, উচ্চমাত্রায় কার্বোহাইড্রেট এবং প্রসেসড খাদ্য দীর্ঘদিন ধরে গ্রহণ করা  এই রোগের একটা সম্ভাব্য কারণ বলে মনে করা হয়।

বিভিন্ন প্রকারের অটোইমিউন ডিজিজ (Types of Autoimmune Disease )

১) রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস : এই রোগে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা এমন এক অ্যান্টিবডির সৃষ্টি করে যা অস্থিসংযোগের আবরণের সাথে যুক্ত থাকে। প্রতিরোধী কোষগুলো তখন অস্থিসংযোগে আঘাত করে এবং সেখানে ফোলাভাব, প্রদাহ ও যন্ত্রনা শুরু হয়। সঠিক চিকিৎসা না হলে রিউমাটয়েড আর্থারাইটিসের কারণে সারা জীবনের জন্য অস্থিসংযোগ বিকল হয়ে যেতে পারে।

২) টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস : অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন নামক হরমোনের উৎপাদন করে যা রক্তে শর্করার পরিমান নিয়ন্ত্রণ রাখতে সাহায্য করে। শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষকে আক্রমণ করে। রক্তে অতিরিক্ত শর্করা রক্তজালিকা, হৃদপিন্ড, কিডনি, চোখ এবং স্নায়ুর ক্ষতি করে।

৩) সোরিয়াসিস/সোরিয়াটিক আর্থারাইটিস : সোরিয়াসিসের ফলে ত্বকের কোশের অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি ঘটে। অতিরিক্ত কোষগুলি জড়ো হয়ে লাল হয়ে ফুলে যায় এবং ত্বকের উপরিভাগে রূপালী–সাদা আঁশের মতো তৈরি হয়।

   সোরিয়াসিসে আক্রান্ত ৩০% মানুষ তাদের অস্থি–সংযোগে ব্যাথা, ফোলা ও আড়ষ্টতা অনুভব করে। এই রোগটির নাম সোরিয়াটিক আর্থারাইটিস।

৪) মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস : এই রোগটি মায়ালিন পর্দা (নিউরনের আবরণ) কে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যার ফলে মস্তিষ্ক থেকে সুষুম্না কান্ডের মাধ্যমে সারা শরীরে এবং শরীর থেকে সুষুম্না কান্ডের মাধ্যমে মস্তিষ্কে অনুভূতি আদান-প্রদানের গতি মন্থর হয়ে যায়। এর ফলে অসারতা, দুর্বলতা, হাঁটতে না পারার মত সমস্যা দেখা যায়। ৫০% মাল্টিপল স্ক্লেরোসিসে আক্রান্ত মানুষের রোগলক্ষন প্রকাশের ১৫ বছরের মধ্যে একা হাঁটতে পারার ক্ষমতা চলে যায়।

৫) সিস্টেমিক লুপাস এরিথেমাটোসাস : এই রোগে অস্থিসংযোগ, কিডনি, মস্তিষ্ক, হৃদপিন্ড সবই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অস্থিসংযোগে যন্ত্রণা, ক্লান্তি ইত্যাদি এর খুব সাধারন উপসর্গ।

৬)ইনফ্লামেটরি বাওয়েল ডিজিজ : এর ফলে অন্ত্রের দেওয়ালের আবরনে প্রদাহ দেখা দেয়। যার ফলে বারংবার ডায়েরিয়া, পেটে ব্যাথা, মলদ্বার থেকে রক্তপাত, বারংবার মলত্যাগের প্রবনতা, ওজন হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি ঘটে থাকে।

৭) গ্রেভস ডিজিজ : এই রোগে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা এমন অ্যান্টিবডি উৎপাদন করে যা থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে থাইরয়েড হরমোনের অতিরিক্ত উৎপাদন(hyperthyroidism) ঘটায়। এর লক্ষ্মণগুলি হলঃ– শরীরের ওজনের অস্বাভাবিক হ্রাস, চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসা, হৃদপিণ্ডের গতি দ্রুত হয়ে যাওয়া, দুর্বলতা ইত্যাদি।

৮) হাসিমোটোস থাইরয়ডিটিস : শরীরের প্রতিরোধী ক্ষমতায় তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি থাইরয়েড গ্ল্যান্ড কে আক্রমণ করে এবং ধীরে ধীরে থাইরয়েড উৎপাদনকারী কোষগুলিকে ধ্বংস করতে থাকে। যার ফলে থাইরয়েড হরমোন প্রয়োজনের তুলনায় কম উৎপন্ন হয় ( hypothyroidism)। ক্লান্তি, কোষ্ঠকাঠিন্য, অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি, শুষ্ক ত্বক ইত্যাদি লক্ষ্মণ শরীরে দেখা দেয়।

৯)মায়াস্থেনিয়া গ্র‍্যাভিস : এই রোগের ক্ষেত্রে শরীরের মাংসপেশি ও তাকে নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয় (Neuromuscular disorder)। এই রোগের প্রধান লক্ষন হল রোগী যত শারীরিক ভাবে নিজেকে সচল করার চেষ্টা করে ততই দুর্বল হয়ে পড়ে। এই রোগের প্রধান চিকিৎসা হল মেসটিনন ( Mestinon) নামক ওষুধের প্রয়োগ।

১০) ভাস্কুলিটিস : এই রোগের সময় শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা রক্তজালিকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই রোগে শরীরের যে কোনো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ফলে এর লক্ষ্মণও বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয় এমন কর্টিকোস্টেরয়েড ব্যবহারের মাধ্যমে এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়।

অটোইমিউন ডিজিজের লক্ষন (Symptoms of Autoimmune Disease)

বিভিন্ন অটোইমিউন ডিজিজের প্রাথমিক লক্ষ্মণগুলি মোটামুটি একইরকমের হয় —

  • ক্লান্তি
  • মাংসপেশিতে যন্ত্রণা
  • হাল্কা জ্বর
  • মনোযোগে সমস্যা
  • হাত ও পায়ের পাতায় অসাড় ভাব
  • অতিরিক্ত চুল পড়ে যাওয়া
  • ত্বকে র‍্যাশের উপস্থিতি
রোগ নির্ণয় পদ্ধতি (Diagnosis of autoimmune disease)

কোনো একটিমাত্র পরীক্ষার মাধ্যমে অটোইমিউন ডিজিজ ধরা পড়ে না। বিভিন্ন প্রকারের পরীক্ষা ও রোগলক্ষন দেখে এই রোগকে শনাক্ত করা হয়।

       অটোইমিউন ডিজিজের রোগলক্ষন দেখা দিলেই ডাক্তাররা প্রথমেই সাধারণত Antinuclear antibody test (ANA) করে থাকেন। টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ আসলে বুঝতে হবে রোগী সম্ভবত অটোইমিউন ডিজিজে আক্রান্ত। তবে নির্দিষ্টভাবে শরীরের কোন অঙ্গ আক্রান্ত তা বোঝার জন্য আরও নানারকম পরীক্ষার প্রয়োজন হয়।

কিভাবে অটোইমিউন ডিজিজ  এর  চিকিৎসা হয় :

এই রোগের প্রধান চিকিৎসাই হল ওষুধের (nonsteroidal anti-inflammatory drugs, immune–suppressing drugs) মাধ্যমে আক্রান্ত অঙ্গের প্রদাহকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং শরীরের অতিসক্রিয় প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শান্ত করা। রোগলক্ষনকে প্রশমিত করার চিকিৎসাও করা হয়। তবে চিকিৎসার মাধ্যমে অটোইমিউন ডিজিজকে কেবল নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়, তা কখনোই পুরোপুরি সারে না। সুষম খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত শরীর চর্চা এই রোগের বিরুদ্ধে শরীরকে ভালো রাখতে সাহায্য করে।

Anshula Banerjee

Hello, I am Anshula Banerjee, completed my post-graduation degree in English, along with Bachelor of Education. I live at Nadia. I am a voracious reader in various fields of knowledge that may help the readers to satisfy their urge specially in the area of health and wellness.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago