ছোটদের পেটে কৃমির সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়

Published by

মন্দার আর মন্দিরা। যমজ ভাইবোন। জন্মের ১ বছর পর সেই যে দুই পায়ে দাঁড়াতে শিখল ওরা, তারপর আর বসেনি। শুধু, দৌড়াচ্ছে, এটা ওটা ভাঙছে। বাবার শেভিং ক্রিম মিশিয়ে দিচ্ছে পোস্তর তরকারিতে। লঙ্কা গুঁড়ো দিচ্ছে ঠাম্মির ইসবগুলে। পড়শির বাড়িতে ঢুকে এমন যুদ্ধ লাগাচ্ছে যে তাদের বাড়ির অবস্থা হচ্ছে মিসাইল বিধ্বস্ত ইরাকের মতো। প্রকৃতিতে গুন্ডা হলেও ভাইবোনকে ভালোবাসত পাড়ার লোকেরা। তারপরে হঠাৎ যেন কী একটা হয়ে গেল। দুই ভাইবোন নির্জীব, অথচ খিটখিটে হয়ে উঠতে লাগল ক্রমশ। খামচে দেওয়া, কামড়ে দেওয়া লেগেই থাকত। তার সঙ্গে বার বার পেট ব্যথা, কাশি, খিদে কমে যাওয়া, মাঝেমধ্যেই জ্বর, ওজন কমতে শুরু করার মতো উপসর্গ দেখা দিল। ছোট্ট মানুষ দুটোর হাড় জিরজিরে চেহারা দেখে আর থাকতে পারলেন না পাশের বাড়ির এক দিদা। ‘খোকা-খুকুকে ডাক্তার দেখাও গো। মনে হচ্ছে কৃমি হয়েছে।’— ভাইবোনের মা তৃণাকে বললেন তিনি। সত্যিই তাই। চিকিৎসক জানালেন ভাইবোনে একসঙ্গে আক্রান্ত হয়েছে গোল কৃমির সমস্যায়। চলল ওষুধ। কয়েকদিনের মধ্যেই সেরে উঠল ওরা। সারা পাড়ার লোকে মুখে ফুটে উঠল হাসি।

কৃমির সমস্যা আসলে কী ?

আমরা প্রায় প্রত্যেকেই কোনও না কোনও সময়ে কৃমি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি। ছোটবেলা এবং বড় হলেও। কৃমি বহুকোষী পরজীবী প্রাণী। খালি চোখে দেখতে পাওয়া যায়। মানব শরীর হল এই পরজীবীর আবাসস্থল।

কৃমির ধরণ

কৃমি প্রধানত দুই ধরনের— ফিতাকৃমি ও গোলকৃমি (tapeworm and roundworm)।

ফিতাকৃমি :- বিশেষ কিছু বড় প্রাণীর শরীরে বাসা বাঁধে ফিতাকৃমি। তাই যে কোনও বড় প্রাণীর মাংস সঠিকভাবে সেদ্ধ করে না খেলে মানুষের পেটেও কৃমি বাসা বাঁধতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গোরুর মাংসে থাকে টিনিয়া সোলিয়াম ও শুয়োরের মাংসে থাকে টিনিয়া সাজিনেটা নামে কৃমি। এরা পেটে বাসা বাধলেও সাধারণত কোনও সমস্যার সৃষ্টি করে না। তবে শাকসব্জি সঠিকভাবে পরিষ্কার না করলে এই ধরনের কৃমির ডিম পেটে প্রবেশ করে রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। একসময় ডিম লার্ভাতে পরিণত হয়। এই লার্ভা মাংসপেশি ও ব্রেনে বাসা বাঁধতে পারে। বিশেষ করে টিনিয়া সোলিয়াম-এর ক্ষেত্রে এমন হয় এবং এই সমস্যার নাম দেওয়া হয়েছে সিস্টিসারকোসিস। এক্ষেত্রে লক্ষণ হিসেবে থাকে খিঁচুনি। হতে পারে মস্তিষ্কের আরও কিছু অসুখ। একটি উল্লেখযোগ্য ফিতাকৃমি হল একাইনোকক্কাস। এই কৃমির ডিম প্রধানত কুকুরের লোমের মাধ্যমে মানব শরীরে ঢোকে ও লিভারে পৌঁছে লার্ভায় রূপান্তরিত হয় এবং সিস্ট বা জলভরা থলির সৃষ্টি হয় যাকে বলে হাইডাটিড সিস্ট। এছাড়া কিছু কিছু ফিতাকৃমি লিভারের অন্দরেও বংশবৃদ্ধি করে। এর ফলে দেখা যায় জন্ডিস ও লিভারের সমস্যা। অনেকসময় সিস্টোসোমা নামে এক ধরনের ফিতাকৃমি ব্লাডার এবং লিভারের অন্দরে বাসা বেঁধে নানা শারীরিক জটিলতা তৈরি করে। এরা প্রধানত নোংরা জলাশয়ে থাকা শামুকের শরীরে বাস করে। এই শামুক সঠিক প্রক্রিয়ায় রান্না না করে খেলে আমাদের শরীরে ওই কৃমি শরীরে প্রবেশ করে।

গোলকৃমি :- বাচ্চারা যে ধরনের কৃমির সমস্যায় আক্রান্ত হয় সেগুলির মধ্যে প্রধান হল, অ্যাসক্যারিস অর্থাৎ বড় গোল কৃমি, হুক ওয়ার্ম, ট্রাইচুরিস বা হুইপ ওয়ার্ম, এন্টারোবিয়াস বা পিন ওয়ার্ম। এরা প্রধানত মলের মাধ্যমে আমাদের শরীরে ঢোকে। স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে ও মাঠেঘাটে মলত্যাগের মাধ্যমেই গোলকৃমির ডিম শরীরে প্রবেশ করে। এদের বংশবৃদ্ধির ফলে অপুষ্টি, রক্তাল্পতা, অনিয়মিত মলত্যাগ, অম্বল, অজীর্ণ ইত্যাদির উপসর্গ দেখা যেতে পারে। শিশু ও পরিণত বয়সে মলদ্বারে চুলকানির অন্যতম কারণ পিন ওয়ার্ম। এদের মধ্যে উল্লেখ্য হুক ওয়ার্ম-এর লার্ভা মানুষের শরীরে চর্মের মাধ্যমে ঢোকে। খালি পায়ে মাঠে হাঁটলে এবং মাঠে মলত্যাগ করলে ত্বকের মাধ্যমে এর লার্ভা আমাদের শরীরে ঢুকে পড়ে। কিছু কিছু গোলকৃমি মশার কামড়ের মাধ্যমে ফাইলেরিয়াসিস সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে কিউলেক্স মশা, যারা নোংরা জলে জন্মায়, তারাই এর জীবাণু বহন করে এবং পরিণত কৃমি মানুষের লসিকা গ্রন্থিতে বাসা বেঁধে পা ফোলা বা গোদ রোগের সৃষ্টি করে। বিরল ক্ষেত্রে লোওয়া নামের এক গোলকৃমি চোখেও বাসা বাধে। এই কারণেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা খুব জরুরি। অর্থাৎ শৌচকার্য এবং তারপরে সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধোয়া জরুরি। নখ ছোট করে কাটা, খাবার আগে হাত ধোয়ার মতো কাজও করতে হবে নিয়ম মেনে। এছাড়া চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কৃমির ওষুধ খাওয়াতে হবে রোগীকে।

কৃমির সমস্যা প্রতিরোধ ও প্রতিকার—

i.কোনওভাবেই আধসেদ্ধ মাংস খেলে চলবে না।

ii.শাকসব্জি খুব ভালো করে ধুয়ে খাওয়া খুব দরকার।

ii.বাড়িতে কুকুর থাকলে নিয়মিত পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। কুকুরকে নিয়মিত কৃমির ওষুধ খাওয়ানোও খুব জরুরি।

iv.জলাশয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন। এই ধরনের কৃমিতে আক্রান্ত হলে ডাক্তার এর পরামর্শ খুব জরুরি। অনেক সময় শল্য চিকিৎসারও প্রয়োজন হতে পারে।

Dhruba Biswas

Hi, I am Dhruba and I’m a Health Blogger. My goal is to make everyone aware of physical and mental health as well as new methods and technologies in the field of medical science.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

5 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

5 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

5 months ago