পিত্তনালীর রোগের কারণ, লক্ষণ, সমস্যা ও চিকিৎস্যা

Published by

আমাদের লিভার পিত্ত নামক একটি হলদেটে সবুজ রঙের তরল উৎপন্ন করে। এটি চর্বি জাতীয় খাদ্যেকে ভেঙ্গে দিয়ে আমাদের হজমের সহায়তা করে। পিত্ত হল- কোলেস্টেরল, পিত্ত লবণ এবং জল দিয়ে তৈরি একটি ক্ষরণ । এতে বিলিরুবিন থাকে তাই এর রঙ এমন। আমাদের রক্ত কণিকাগুলি ভেঙে গেলে এটি গঠিত হয়।
পিত্তথলি থেকে কিছু নালী ও অগ্ন্যাশয় থেকে কিছু নালী বেরিয়ে সেগুলি এসে যুক্ত হয় অন্ত্র নামক পরিপাক পরিপাক তন্ত্রের একটি অংশে। এগুলি একসঙ্গে একটা জালের মতো অংশ বা ইংরাজিতে নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করে। খাদ্যকে ভেঙে ফেলার জন্য লিভার এবং অগ্ন্যাশয় থেকে পিত্তরস আসে এবং অন্যান্য পাচক রসের সঙ্গে মিলিত হয়। সবশেষে এই সব রসগুলি পরিপাক তন্ত্র ক্ষুদ্রান্ত্রে ঢেলে দেয়।
এতে পিত্তনালী কোনও না কোনো ভাবে ব্লক বা বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই কারণে সব অসুখগুলিতে প্রায় একরকমের লক্ষণ দেখা যায়। পিত্তনালীর রোগ বলতে পিত্তনালীতে কোনো রকমের বাধার কারণে হওয়া জটিল সমস্যাগুলি ও তার জন্যে অসুস্থতাকেই বোঝয় ।

বিলিয়ারী অবস্ট্রাকসন বা পিত্তনালীতে বাঁধা:

পিত্তথলি থেকে যে পথে পিত্ত এসে অগ্ন্যাশয়ের থেকে বের হওয়া রসের সঙ্গে মিশে অন্ত্রে এসে পৌছায় সেখানে কোনো বাধার সৃষ্টি হলে যকৃতে জমে যায় পিত্ত আর এই কারণে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গিয়ে জন্ডিস জাতীয় সমস্যার সৃষ্টি করে।

পিত্তনালীর রোগের কারণঃ

গলস্টোন বা পিত্তনালীতে পাথর
⦁ পিত্তনালীতে প্রদাহ।
⦁ পিত্তনালী সংকীর্ণ হয়ে যাওয়া।
⦁ পিত্তথলি, পিত্তনালী বা অগ্ন্যাশয়ে ক্যান্সার হলে।
⦁ কলেডোকাল সিস্ট (জন্মের সময় শিশুদের মধ্যে উপস্থিত)
⦁ পিত্তথলিতে অস্ত্রোপচারের সময় আঘাত।
⦁ অগ্ন্যাশয়ে বহুদিনের পুরোনো বা ক্রনিক প্রদাহ।
⦁ বর্ধিত লিম্ফ নোড।
⦁ নানা রকমের পরজীবীর উপস্থিতি।
⦁ লিভার, পিত্তথলি, অগ্ন্যাশয়, বা পিত্তনালীকে স্পর্শ করেছে এমন টিউমারগুলি।
⦁ সিরোসিস, বা লিভারে আঘাতের দাগ।
⦁ হেপাটাইটিসের মতো সংক্রমণ।
⦁ লিভারের মারাত্মক ক্ষতি।

যদি কেউ পেটে আঘাত পান তবে তাঁর পিত্তনালীটি অবরুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। এটি সংক্রমণের কারণেও ঘটতে পারে, বিশেষত যদি কেউ এমন ওষুধ খান যা ইমিউন সিস্টেমকে দমন করে।

পিত্তনালীর রোগের লক্ষণঃ

⦁ হালকা রঙের মল।
⦁ ত্বকে চুলকানি।
⦁ শরীরে বিলিরুবিন জমা হওয়ার জন্যে চোখ এবং ত্বক হলুদ হয়ে যায় এবং এর থেকই হয় জন্ডিস রোগ।
⦁ পেটের উপরের দিকের ডান পাশে ব্যথা।
⦁ একটানা জ্বর।
⦁ বমি বমি ভাব এবং বমি।
⦁ প্রচন্ড ক্লান্তি।
⦁ ওজন কমে যাওয়া।
⦁ খিদে কমে যাওয়া।
⦁ গাঢ় রঙের প্রস্রাব।

বিভিন্ন পরীক্ষাঃ

পিত্তনালীর বাধার কারণের উপর ভিত্তি করে, ডাক্তারবাবু প্রথমে পিত্তথলীটি পরীক্ষা করেন। অনেক সময় যকৃতের অন্য কোনো অসুখকে জনডিসের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়। ডাক্তারবাবু রোগীর চিকিৎসা সংক্রান্ত ইতিহাস এবং মদ্যপানের অভ্যেস আছে কিনা তা জেনে নেন। নিম্নলিখিত এক বা একাধিক রক্তপরীক্ষার পরামর্শও তিনি দিতে পারেন :
⦁ বিলিরুবিন।
⦁ ক্ষারযুক্ত ফসফেট।
⦁ অগ্ন্যাশয় নিঃসৃত এনজাইম যেমন অ্যামাইলেজ এবং লাইপেজ।
⦁ গামা-গ্লুটামিলট্রান্সফিরেস(glutamyltransferase)এর মত লিভার এনজাইম।
এই রক্ত পরীক্ষায় যদি বোঝা যায় যে পিত্তনালী বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে, তাহলে ডাক্তারবাবু আরও কয়েকটি পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয় যে এই রোগ হয়েছে। পরীক্ষাগুলি হল :
⦁ আল্ট্রাসাউন্ড (ultrasound)।
⦁ কম্পিউটেড টোমোগ্রাফি (Computed tomography)।
⦁ চৌম্বকীয় অনুরণন কোল্যানজিওপ্যাক্রিয়াটোগ্রাফী(cholangiopancreatography)।
⦁ পারকিউটেনিয়াস ট্রানশেপ্যাটিক কোলানজিওগ্রাম (Percutaneous transhepatic cholangiogram)।
⦁ এন্ডোস্কোপিক রেটরোগ্রেড কোল্যানজিওপ্যাক্রিয়াটোগ্রাফী(Endoscopic retrograde cholangiopancreatography)।

পিত্তনালীর রোগের সমস্যা:

সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালে কি কি ক্ষতি হতে পারে
⦁ সংক্রমণ।
⦁ লিভারের অসুখ।
⦁ জন্ডিস।
⦁ ডায়াবেটিস।
⦁ Pancreatitis বা অগ্ন্যাশয়েতে প্রদাহ।
⦁ ভিটামিনের অভাব
⦁ গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা।
⦁ পিত্তথলি ফোলা বা কোলেসিস্টাইটিস(cholecystitis)
⦁ বিলিয়ারি সিরোসিস বা কোলাঙ্গাইটিস(cholangitis)

পিত্তনালীর রোগের চিকিৎস্যা পদ্ধতি:

⦁ পিত্তনালী বাধা অপসারণ করে অথবা অন্তর্নিহিত কোনো কারণ থাকলে তা নিরাময় করে চিকিৎসা করা হয়।
⦁ পিত্তথলির পাথরগুলি এন্ডোস্কোপিক রেট্রোগ্রেড চোলাঞ্জিওপ্যানক্রিটোগ্রাফি ব্যবহার করে অপসারণ করা হয়। এই অসুখে প্রয়োজন হলে পিত্তথলি অপসারণ বা cholecystectomy এর মতো শল্য চিকিৎসার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
⦁ ক্যান্সারের কারণে যদি পিত্তনালী বাধাপ্রাপ্ত হয় তাহলে চিকিৎসক এন্ডোস্কোপির মাধ্যমে বা রোগীর ত্বকে একটি সূঁচ প্রবেশ করিয়ে পিত্তনালীগুলি প্রশস্ত করবেন এবং পরিষ্কার করে দেবেন। ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্যে কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি বা শল্য চিকিত্সার প্রয়োজনও হতে পারে
⦁ যদি আপনার পিত্তনালীটি কোলেডোকাল সিস্টের কারণে অবরুদ্ধ হয় তবে আপনার ডাক্তার আপনার বর্ধিত পিত্তনালীর চিকিৎসার জন্য অস্ত্রোপচার করবেন।
⦁ যদি প্যানক্রিয়াটাইটিস হয় রোগটির কারণ তাহলে এন্ডোস্কোপিক রেট্রোগ্রেড চোলাঞ্জিওপ্যানক্রিটোগ্রাফির সাহায্য নিয়ে চিকিৎসা করা যেতে পারে। ব্যথা থাকলে তা কমানোর জন্যে ডাক্তারবাবু অসুধ দিতে পারেন।

প্রতিরোধ:

এখানে কয়েকটি পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে যেগুলি মেনে চললে আপনার পিত্তনালীর এই সব সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা খুব কমে যাবে। নিচের এই স্বাস্থ্যবিধিগুলি মেনে চলুন :
⦁ আপনার ডায়েটে ফাইবারের পরিমাণ বাড়ান।
⦁ আপনার ডায়েটে চিনি এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ কমিয়ে ফেলুন।
⦁ যদি আপনার ওজন অতিরিক্ত বেশি হয় অর্থাৎ আপনি যদি স্থূলতা(obesity) রোগে আক্রান্ত হোন, তাহলে আপনার প্রথম কাজ হবে ওজন কমানো। আপনার লিঙ্গ, বয়স এবং উচ্চতার উপর ভিত্তি করে ওজনকে স্বাভাবিক সীমার মধ্যে নিয়ে আসুন। এর জন্যে যোগাযোগ করুন কোনো ভাল ডায়েটিশিয়ানের সঙ্গে যিনি আপনাকে একটি খাদ্যতালিকা তৈরি করে দেবেন যেটি অনুসরণ করলে আপনি নিশ্চিৎভাবে আপনার ওজন কমাতে সফল হবেন।

Dhruba Biswas

Hi, I am Dhruba and I’m a Health Blogger. My goal is to make everyone aware of physical and mental health as well as new methods and technologies in the field of medical science.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago