বয়স্কদের ভুল বকার কারণ

Published by

বয়স্কদের ভুল বকার (Delirium) সমস্যার পিছনে একাধিক কারণ দায়ী থাকতে পারে। সুতরাং কোনও বয়স্ক মানুষ হঠাৎ করে অসংলগ্ন কথা বলা শুরু করলে দেখতে হবে তার পিছনে মূল কারণটি কী। ভুল বকার নেপথ্যে একাধিক কারণ থাকে। অতএব সমস্যার কারণ জেনে সেই বুঝে চিকিৎসা করলেই কথাবার্তায় সঙ্গতি ফিরে আসে।

বয়স্কদের ভুল বকার কারণ—

সোডিয়ামের ওঠানামা: প্রতি লিটার রক্তে সোডিয়ামের স্বাভাবিক মাত্রা— ১৩৫ থেকে ১৪৫ মিলিইক্যুয়াভালেন্ট। সেক্ষেত্রে রক্তে সোডিয়াম স্বাভাবিক মাত্রার নীচে নেমে গেলে দেখা দেয় বিবিধ উপসর্গ। এই ধরনের লক্ষণের মধ্যে অন্যতম জটিলতা হল ‘ভুল বকা’।

স্ট্রেস: একাকিত্ব, অর্থাভাব, অসুখ নিয়ে দুশ্চিন্তা, পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনার কারণে বয়স্কদের মধ্যে জন্ম নিতে পারে মানসিক সমস্যা ও অবসাদ। এই সকল সমস্যার কারণেও বয়স্ক ব্যক্তির আচরণ ও কথায় অসংলগ্ন ভাব দেখা যেতে পারে। এমন ক্ষেত্রে সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নিতে হবে।

স্ট্রোক: বয়স্কদের ব্রেনে মাঝেমধ্যেই ছোট ছোট ক্লট (জমাট রক্ত) তৈরি হয়। এমনকী ছোট ছোট স্ট্রোকও হয়। অবশ্য এমন ছোট ছোট স্ট্রোকের কারণে রোগী পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন না। এমআরআই করালে ক্লটের সমস্যা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়।

দেখা গিয়েছে, কোনও ব্যক্তির হাই ব্লাড প্রেশার, হার্টের রোগ, ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ, ডায়াবেটিস, মাত্রাতিরিক্ত কোলেস্টেরল থাকার ইতিহাস থাকলে এই ধরনের সমস্যা বেশি হতে দেখা যায়। এই জাতীয় সমস্যায় হঠাৎ ভুল বকা শুরু হবে না। অসুখ যত বাড়বে, রোগীর ভুল বকার মাত্রাও তত বৃদ্ধি পাবে। তবে চিকিৎসা আছে। এমআরআই করে রোগ ধরা পড়লে চিকিৎসক সাধারণত ক্লট কমানোর ওষুধ দেন রোগীকে।

মাথায় চোট: মাথায় চোট ও মস্তিষ্কের অন্দরে রক্তক্ষরণ হলেও রোগী মাঝে মধ্যে ভুল বকেন, আবার ক্ষণে ক্ষণে স্বাভাবিক আচরণ করেন। বয়স্ক মানুষ এবং মদ্যপানে আসক্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে ক্রনিক সাবডুরাল হেমাটোমা বেশি হতে দেখা যায়। কারণ এই দুই বর্গের মানুষের বারংবার শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সাধারণত ব্রেনের সিটি স্ক্যান করলেই রোগ ধরা পড়ে।

ব্লাড সুগার: কোনও ব্যক্তি হঠাৎ করে ভুল বকতে শুরু করলে, জানতে হবে তিনি দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিসের রোগী কি না। কারণ ক্রনিক ডায়াবেটিসের রোগীর রক্তে হঠাৎ করে সুগারের মাত্রা বেড়ে গেলে ওই ব্যক্তির কথাবার্তায় অসঙ্গতি দেখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে উপযুক্ত ওষুধ প্রয়োগ করে রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।

থাইরয়েডের সমস্যা: হাইপো থাইরয়েডের সমস্যার কারণে অনেকেই থাইরক্সিন জাতীয় ওষুধ খান। থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে প্রত্যেক তিন থেকে ছয় মাস অন্তর থাইরয়েডের মাত্রা পরীক্ষা করিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগী দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষাও করান না, চেকআপেও আসেন না। একই দাগের ওষুধ খেয়ে চলেন। সমস্যা হল, এমন ক্ষেত্রে ওষুধের ডোজ বাড়ানোর দরকার পড়লেও তা সম্ভব হয় না। থাইরয়েড হরমোনের কম ক্ষরণের ফলে ব্রেনের স্মৃতিশক্তি কমে যায়। ফলে কথাবার্তায় এলোমেলো ভাব দেখা যেতে পারে।

ডিমেনশিয়া: বয়সকালে কিছু ব্যক্তি ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত হন। স্মৃতিভ্রংশ হওয়ার পিছনে মূল কারণ হল, ব্রেনের কিছু নির্দিষ্ট স্মৃতিধর কোষের ক্রমান্বয়ে মৃত্যু হওয়া। ডিমেনশিয়ার কারণেও কিছু মানুষ ভুল বকতে পারেন। ডিমেনশিয়ায় সাধারণত দেখা যায় অল্পদিন আগের স্মৃতি মানুষ ভুলে গিয়েছে। তবে বহু পুরনো স্মৃতি মনে থাকে। ধীরে ধীরে অবশ্য সেসব স্মৃতিতেও ডিমেনশিয়ার থাবা পড়ে। তাই ডিমেনশিয়ার প্রাথমিক লক্ষণ চিনতে হবে। স্বল্পমেয়াদি স্মৃতি যেমন বাজারে সব্জি বা মাছ কিনতে গিয়ে বারংবার পাওনাগণ্ডায় ভুল করা। কয়েকদিন আগে পরিচিত ব্যক্তির সম্পর্কে কিছুই মনে করতে না পারা, জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ভুলে যাওয়া ইত্যাদি। রোগের প্রাথমিক দিকে চিকিৎসা শুরু করা গেলে রোগের অগ্রগতি অনেকখানি রোধ করা যায়।

ভিটামিন: শরীরের পক্ষে ভিটামিন বি১২ অত্যন্ত জরুরি পুষ্টি উপাদান। সাধারণত নিরামিষাশীদের ভিটামিন বি ১২-এর বেশি ঘাটতি হতে দেখা যায়। কারণ ভিটামিন বি১২-এর মূল উৎস হল প্রাণিজ খাদ্য। অর্থাৎ মাছ, মাংস ডিম ইত্যাদি। আবার, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া একটানা অ্যাসিডিটির ওষুধ খেলেও হতে পারে ভিটামিন বি ১২-এর ঘাটতি। এমনকী দেখা গিয়েছে, ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত মেটফর্মিন ওষুধের একটানা সেবনের কারণেও ভিটামিন বি১২-এর ঘাটতি হতে পারে। এই বিশেষ ভিটামিনের ঘাটতি থাকলে রোগীর ভুল বকার সঙ্গে মাথা ঘোরার উপসর্গও দেখা যায়।

ব্রেন টিউমার: ব্রেন টিউমারের কারণে ভুল বকার সমস্যা দেখা যায়। এক্ষেত্রে এমআরআই করে ব্রেন টিউমার সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হয়। একমাত্র চিকিৎসা অপারেশন।

পরিশেষে,ভুল বকার সমস্যা যে কারণেই হোক না কেন, সঠিক সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সেক্ষেত্রে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন। পরিবারের সদস্যরাও নিশ্চিন্ত থাকবেন। অতএব পরিবারের কোনও বয়স্ক মানুষ হঠাৎ ভুল বকলে শুরু করলে সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে হবে ভুল বকার পিছনে মূল কারণটি কী। রোগ নির্ণয় করা অত্যন্ত জরুরি বিষয়। তবেই দ্রুত রোগ সারবে।

Dhruba Biswas

Hi, I am Dhruba and I’m a Health Blogger. My goal is to make everyone aware of physical and mental health as well as new methods and technologies in the field of medical science.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

5 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

5 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

5 months ago