লিভার সিরোসিস এর লক্ষণ ও চিকিৎসা

Published by

লিভার বা যকৃৎ মানবদেহে উপস্থিত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা রক্ত থেকে বিষাক্ত পদার্থ ছেঁকে বের করে দেয় এবং এনজাইম বা উৎসেচক তৈরি করে খাবার হজম করতে সাহায্য করে। এছারাও শর্করা এবং পুষ্টি সঞ্চয় করে এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে।
যখন এই যকৃৎ আঘাতপ্রাপ্ত হয়, এটি নিজেকে মেরামত করে নেয় এবং শক্তিশালী আঘাতের দাগযুক্ত টিস্যু বা তন্তু তৈরি করে। যখন খুব বেশি এইরকম দাগযুক্ত তন্তু তৈরি হয়, তখন যকৃত ভালোভাবে কাজ করতে পারে না।
লিভার সিরোসিস হল লিভারের রোগের চূড়ান্ত পর্যায়। এরকম হলে লিভার কাজ করা একেবারে বন্ধ করে দেওয়ার আগে সেখানে কিছু ক্ষতের দাগ দেখা দেয়। সিরোসিস হলে লিভার বা যকৃত শক্ত ও সঙ্কুচিত হয়ে যায়। ফ্যাটি লিভার, হেপাটাইটিসের মতো অসুখ এবং মদ্যপানের মতো বদ অভ্যাসের ফলে এই রোগটি হয়।

লিভার সিরোসিস এর লক্ষণ

এই রোগের ক্ষেত্রে প্রথম প্রথম কোনও লক্ষণ নাও থাকতে পারে। কিন্তু যত সময় যায় লিভার তত ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে। যে লক্ষণগুলি ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে শুরু করে সেগুলি হল :
⦁ ক্লান্তি ও দুর্বলতা।
⦁ ক্ষুধাভাব এবং ওজন হ্রাস।
⦁ বমি বমি ভাব।
⦁ সহজেই রক্তপাত বা ক্ষতের সৃষ্টি এবং পা বা পেটে ফোলাভাব দেখা দিতে পারে।
⦁ রক্ত বমি।
⦁ পেশীতে মারাত্মক টান ধরা।
⦁ বাদামী প্রস্রাব।
⦁ জ্বর।
⦁ বর্ধিত প্লীহা।
⦁ হাড়ের রোগ, যার ফলে হাড়গুলি আরও সহজে ভেঙে যায়।

এছাড়াও এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ত্বকে নিম্নলিখিত পরিবর্তনগুলিও লক্ষ্য করতে পারেন, যেমন:

⦁ জন্ডিস (যখন ত্বক এবং চোখ হলুদ হয়ে যায়)।
⦁ তীব্র খিঁচুনি।
⦁ ত্বকের রক্তনালীগুলি মাকড়সার জালের মতো আকার ধারণ করা।
⦁ হাতের তালুতে লালভাব দেখা দেওয়া বা নখের রঙ সাদা হয়ে যাওয়া।

চিন্তা করার ধরণে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। একাগ্রতা বা মেমরির সমস্যা হতে পারে। মহিলাদের ক্ষেত্রে পিরিয়ড বা মাসিক স্রাব বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পুরুষদের সেক্স ড্রাইভ বা যৌন উত্তেজনা কমে যেতে পারে, স্তনগুলি বড় হয়ে যেতে শুরু করতে পারে বা অন্ডকোষগুলি সঙ্কুচিত হয়ে আকারে ছোট হয়ে যেতে পারে।

সিরোসিসের লক্ষণগুলি দুটি পর্যায়ে পড়ে:

  1. এতে সাধারনত কোনো লক্ষণ থাকে না কিন্তু পরে সমস্যা গুরুতর আকার নিতে পারে।
  2. এটি এমন একটি পর্যায় যেখানে জন্ডিস বা অ্যাসাইটিসের মতো লক্ষণগুলি দেখা দেয়। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। সিরোসিস শুরু হওয়ার কারণগুলি যদি প্রথম থেকেই নিয়ন্ত্রণে আনা যায় তাহলে ধীরে ধীরে রোগীর উন্নতি দেখা যায় ও ক্ষতি অনেকটাই কমে যায়।

লিভার সিরোসিস এর পরীক্ষা

আপনার ডাক্তার যদি সিরোসিস সন্দেহ করেন তবে তিনি কয়েকটি রক্ত পরীক্ষা করতে দেবেন। এই সব পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যাবে যে আপনার লিভারটি সঠিকভাবে কাজ করছে কি না। নীচে রক্তপরীক্ষায় কি কি অস্বাভাবিকতা দেখা যেতে পারে সেগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল :

⦁ লিভার থেকে উৎপন্ন কিছু নির্দিষ্ট উৎসেচক বা এনজাইমের উচ্চ মাত্রা।
⦁ রক্তে অত্যাধিক বিলিরুবিনের উপস্থিতি, যা হেমের অর্থাৎ রক্তের লৌহ দ্বারা গঠিত অংশের পরিপাক থেকে তৈরি হয়। হেম আয়রন হিমোগ্লোবিন থেকে আসে এবং মুরগির মাংস ও অত্যাধিক চর্বিযুক্ত মাংস যেমন গরু, ছাগল বা শুয়োরের মাংসে পাওয়া যায়।
⦁ রক্তে প্রোটিনের নিম্ন মাত্রা।
⦁ রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টে কিছু কিছু অস্বাভাবিকতা।
⦁ কোনো ভাইরাসঘটিত সংক্রমণ।
⦁ অটোইমিউন লিভারের রোগের কারণে উৎপন্ন অ্যান্টিবডির উপস্থিতি।

অনেক সময় এম.আর.আই বা আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে পেটের ছবি তুলে পরীক্ষাও করা হয়। বায়োপসি নামে একটি পরীক্ষা পদ্ধতিরও প্রয়োজন হতে পারে। এতে আপনার লিভারের টিস্যু বা তন্তুর একটি নমুনা সংগ্রহ করে আপনার লিভারের কতটা ক্ষতি হয়েছে তা দেখা হয় এবং আপনার লিভারের রোগের সম্ভাব্য কারণটিও জানা যায়।

লিভার সিরোসিস এর চিকিৎসা

প্রথমেই যে কারণে আপনার সিরোসিস হয়েছে তার চিকিৎসা করতে হবে। ক্ষতি যাতে না বাড়ে সেদিকে নজর দিতে হবে। কিছু জিনিস আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে যেমন :

ওষুধের প্রয়োগ
সিরোসিসের কারণের উপর নির্ভর করে, আপনার ডাক্তারবাবু কিছু ওষুধ দিতে পারেন, যেমন বিটা-ব্লকার বা নাইট্রেটস (পোর্টাল হাইপারটেনশনের জন্য)। হেপাটাইটিসের চিকিৎসার জন্য তিনি অ্যান্টিবায়োটিক বা অন্যান্য ওষুধেরও পরামর্শ দিতে পারে। এই ওষুধগুলি খেতে হবে নিয়ম করে তাহলে সিরোসিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

জীবনযাত্রার পরিবর্তন
⦁ যদি মদ্যপানের ফলে আপনার সিরোসিস হয়ে থাকে তবে ডাক্তারবাবু মদ্যপান বন্ধ করার পরামর্শ দেবেন।
⦁ চিকিৎসার প্রয়োজনে ওজন কমাতে বলতে পারেন।
⦁ অ্যাসাইটিসের থাকলে কম সোডিয়াম ডায়েট করা শুরু করুন।

শল্যচিকিৎসা বা সার্জারী
যদি সিরোসিস খুব বেশি আশঙ্কাজনক অবস্থায় চলে যায় তাহলে শুধুমাত্র চিকিৎসাই যথেষ্ট নয়। তখন লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট এর মাধ্যমে রোগীকে বাঁচিয়ে তোলা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকেনা ।

লিভারের সিরোসিস লিভারের একটি গুরুতর অসুখ এবং বিভিন্ন উপায়ে তা হতে পারে, যেমন অ্যালকোহলের দীর্ঘস্থায়ী অপব্যবহার,অনিয়ন্ত্রিত হেপাটাইটিস সংক্রমণ অথবা এনএএফএলডি রোগের যথোপযুক্ত চিকিৎসা না করা। পুষ্টিকর খাদ্য, শারীরিক ক্রিয়াকলাপ, মাঝারি থেকে সীমিত অ্যালকোহল গ্রহণ এবং ডাক্তারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ এই অসুখের নিরাময়ের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমন একটি জীবনধারা অনুসরণ করুন যা আপনার যকৃতকে সুস্থ ও সবল রেখে আপনাকে রাখবে প্রাণোজ্বল ও কর্মঠ।

Dhruba Biswas

Hi, I am Dhruba and I’m a Health Blogger. My goal is to make everyone aware of physical and mental health as well as new methods and technologies in the field of medical science.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago