ইনফ্লুয়েঞ্জার লক্ষণ এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের প্রতিকার কি?

Published by

ইনফ্লুয়েঞ্জা হল ভাইরাস দ্বারা সংঘটিত সংক্রমন যা আমাদের শ্বাস – প্রশ্বাসের সাথে যুক্ত অঙ্গ–প্রত্যঙ্গগুলিকে যেমন নাক, গলা এবং ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। সাধারণত ইনফ্লুয়েঞ্জা নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যায়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই ইনফ্লুয়েঞ্জা মারাত্মক প্রানঘাতী রূপ নিতে পারে। যাদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ইনফ্লুয়েঞ্জা মারাত্মক আকার ধারন করতে পারে, তাঁরা হলেন—

  • পাঁচ বছরের কম বয়সী ছোট বাচ্চারা
  • পঁয়ষট্টি বছরের বেশি বয়স্ক ব্যক্তিরা
  • গর্ভবতী মহিলারা এবং বাচ্চার জন্ম দেওয়ার পরের দু–সপ্তাহ পর্যন্ত সদ্য মা
  • দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তি
  • ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, হার্টের অসুখ, কিডনি ও লিভারের অসুখে দীর্ঘদিন ভোগা ব্যক্তি
  • যাঁরা অতিরিক্ত মোটা, বডি মাস ইনডেক্স ৪০ বা তার বেশি

যদিও ১০০% কার্যকরী নয়, তবুও অ্যানুয়াল ভ্যাক্সিনেশন ইনফ্লুয়েঞ্জার বিরুদ্ধে লড়াই করার সবচেয়ে ভালো উপায়।

ইনফ্লুয়েঞ্জার লক্ষণ

এই জ্বরের প্রথম লক্ষন সাধারণ ঠান্ডা লাগার মতো হয়ে থাকে। যেমন – নাক থেকে জল পড়া, হাঁচি, হলা ব্যাথা ইত্যাদি। ঠান্ডা লাগার ক্ষেত্রে রোগলক্ষনগুলি ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়, কিন্তু ফ্লু তে হঠাৎ করেই রোগলক্ষন গুলি বেড়ে যায়। সাধারণ ভাবে যে রোগলক্ষনগুলি দেখতে পাওয়া যায় সেগুলি হল—

সর্দি জ্বর মাথা ব্যথা
  • জ্বর
  • মাংস পেশিতে ব্যাথা
  • কাঁপুনি এবং মাথা যন্ত্রণা
  • শুকনো এবং দীর্ঘস্থায়ী  কফ
  • শ্বাসকষ্ট
  • ক্লান্তি ও দুর্বলতা
  • গলায় ব্যাথা
  • চোখে ব্যাথা
  • শিশুদের মধ্যে ডায়েরিয়া এবং বমি

কখন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষেরা নিজেরাই ওষুধ কিনে খেয়ে নিয়ে ফ্লু সারিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু রোগলক্ষন যদি বাড়তেই থাকে, তাহলে রোগী যদি তাদের মধ্যে কেউ হন, যে যাঁদের জন্য ইনফ্লুয়েঞ্জা মারাত্মক আকার ধারন করতে পারে (উপরে বর্নিত), তাহলে তৎক্ষনাৎ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে যে যে লক্ষনগুলি দেখলে বোঝা যাবে যে রোগ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, তা হল —

  • শ্বাসকষ্ট হওয়া
  • বুকে ব্যাথা
  • ঝিমুনি ভাব
  • খিঁচুনি হওয়া
  • আগে থেকে থাকা রোগগুলির অবস্থা খারাপ হওয়া
  • অত্যধিক দুর্বলতা ও পেশিতে যন্ত্রণা

শিশুদের ক্ষেত্রে রোগ বিপজ্জনক হয়ে ওঠার লক্ষনগুলি হল-

  • শ্বাসকষ্ট
  • ঠোঁটের রঙ নীল হয়ে যাওয়া
  • বুকে ব্যাথা
  • ডিহাইড্রেশন
  • খিঁচুনি হওয়া
  • পেশিতে যন্ত্রণা
  • আগে থেকে থাকা রোগগুলির অবস্থা খারাপ হওয়া

ইনফ্লুয়েঞ্জার কারন

আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশির মাধ্যমে এবং যখন আক্রান্ত ব্যক্তি কথা বলেন তখন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস বাতাসে ভাসমান জলকনা বা ড্রপলেট এর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সুস্থ ব্যক্তির দেহে সরাসরি সেই ভাইরাস বাহিত জলকনা শ্বাস গ্রহনের মাধ্যমে প্রবেশ করতে পারে অথবা টেলিফোন, কিবোর্ড দরজার হাতল বা অন্যান্য নানা জায়গা থেকে ভাইরাস তার হাতেরসংস্পর্শে আসে এবং তারপর চোখেমুখে হাত দিলেফ ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে।

     ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস সবসময় বদলাচ্ছে এবং তার নতুন নতুন স্ট্রেন সামনে আসছে। কোনো ব্যক্তি যে বিশেষ স্ট্রেনটির দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন, তার বিরুদ্ধে তাঁর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যায়। ভবিষ্যতে সেই ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস যাতে রোগী আগে আক্রান্ত হয়েছেন অথবা ভ্যাকসিন নিয়েছেন, তার দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় বা রোগলক্ষন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যায়না। যদিও সময়ের সাথে সাথে অ্যান্টিবডির পরিমাণ কমতে থাকে এবং এই অ্যান্টিবডি ভাইরাসের নতুন স্ট্রেন থেকেও রক্ষা কিরতে পারে না।

ইনফ্লুয়েঞ্জার বিপদ

যে যে কারনে ইনফ্লুয়েঞ্জা ও তার ফলে হওয়া শারীরিক জটিলতার মাত্রা বাড়তে পারে তা হল—

  • বয়সসিসনাল ইনফ্লুয়েঞ্জা ৬ মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এবং ৬৫ বছর ও তার বেশি বয়সের মানুষদের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা করা না হয়।
  • কাজের ধরন বাসস্থান হাসপাতাল /নার্সিংহোম এর কর্মী বা মিলিটারি ব্যারাকে থাকা মানুষদের মধ্যে এই ফ্লু তে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও এতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতাক্যান্সার, দীর্ঘদিন ধরে স্টেরয়েডের ব্যবহার, অঙ্গ প্রতিস্থাপন, HIV/AIDS ইত্যাদির ফলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় তার ফলে খুব সহজেই রোগী ফ্লু তে আক্রান্ত হয়ে যায় এবং রোগের জটিলতা ও বিপদ বৃদ্ধি পায়।
  • ক্রনিক অসুখ — ক্রনিক অসুখ বিশেষত ফুসফুসের যেমন অ্যাজমা, এছাড়া হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিস, নার্ভের অসুখ, মেটাবলিক অসুখ, কিডনি, লিভার ও রক্ত সংক্রান্ত অসুখে ইনফ্লুয়েঞ্জার বিপদ বৃদ্ধি পায়।
  • ১৯ বছরের নীচে অ্যাস্পিরিন থেরাপি১৯ বছরের নীচে যারা দীর্ঘদিন ধরে অ্যাসপিরিন থেরাপি করেছে তারা ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হলে তাদের ভেতর Reye’s syndrome দেখা যায়।
  • প্রেগন্যান্সি প্রেগন্যান্ট মহিলারা তাদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে এবং বাচ্চার জন্ম দেওয়ার পরের দু’সপ্তাহ পর্যন্ত ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হলে তাদের ভেতর এর বিপদের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

রোগী যদি স্বাস্থ্যকর ও অল্পবয়সী হয়, তাহলে এক–দু সপ্তাহের ভেতর রোগ লক্ষন চলে যায় এবং রোগের নিরাময় হয়। কিন্তু বাচ্চা ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে ইনফ্লুয়েঞ্জার পরবর্তী কিছু সমস্যা তৈরি হতে পারে। সঠিক চিকিৎসা না হলে তা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। সেগুলি হল—

  • নিউমোনিয়া
  • ব্রঙ্কাইটিস
  • অ্যাজমা ফ্লেয়ার–আপস
  • হার্ট প্রবলেম
  • কানের ইনফেকশন
  • অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোম

এদের মধ্যে নিউমোনিয়া সবথেকে বিপজ্জনক হয়। শিশু, বৃদ্ধ ও ক্রনিক অসুখে ভোগা ব্যক্তিদের ভেতর নিউমোনিয়া খুবই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের প্রতিকার কি

এই ইনফ্লুয়েঞ্জা রোধের একমাত্র উপায় হল ভ্যাক্সিন নেওয়া। ভ্যাক্সিন নিপে ফ্লু তে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় বা আক্রান্ত হলেও কমপ্লিকেশন তৈরি হয় না। ভাইরাসের সবথেকে কমন তিন–চার রকমের স্ট্রেন এর জন্যই প্রধানত ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়। ভ্যাক্সিন ইঞ্জেকশন ও ন্যাসাল স্প্রের মাধ্যমে দেওয়া হয়। তবে গর্ভবতী মহিলা, কম প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তি এবং ২ থেকে ৪ বছরের বাচ্চা যাদের অ্যাজমা আছে তাদের জন্য ন্যাসাল স্প্রে রেকমেন্ড করা হয় না।

ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমন ছড়িয়ে পড়া রোধের উপায়

ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে যে যে উপায় অবলম্বন করা উচিত সেগুলি হল—

  • বারংবার হাত ধোয়া
  • চোখে মুখে হাত দেওয়া এড়িয়ে চলা
  • হাঁচি কাশির সময় মুখ হাত দিয়ে ঢাকা দেওয়া
  • সারফেস পরিস্কার রাখা
  • ভিড় এড়িয়ে চলা
  • জ্বর থাকলে বাড়িতে থাকা এবং জ্বর সারার ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত বাড়িতে থাকা
ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের চিকিৎসা

সাধারনত বিশ্রাম এবং প্রচুর বিশ্রাম নিলে ইনফ্লুয়েঞ্জা সেরে যায়। কিন্তু সংক্রমণ বাড়াবাড়ি রকমের হলে চিকিৎসক অ্যান্টি ভাইরাল ওষুধ দেন।

সাধারণত মাথা ঘোরা, বমি ইত্যাদি এইসব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখা যায় ; তবে ওষুধের সাথে পুষ্টিকর খাদ্য খেলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম থাকে।

       নিজের এলাকায় ইনফ্লুয়েঞ্জার ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তি ও শিশুকে বাড়িতে রাখুন এবং জ্বর সারার ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত ভিড় এড়িয়ে চলুন। বারে বারে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে এবং জ্বর বা অন্য রোগলক্ষন থাকাকালীন বাড়ির বাইরে যেতে হলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করুন।

Anshula Banerjee

Hello, I am Anshula Banerjee, completed my post-graduation degree in English, along with Bachelor of Education. I live at Nadia. I am a voracious reader in various fields of knowledge that may help the readers to satisfy their urge specially in the area of health and wellness.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago