কোলাজেন কী? কোলাজেন সাপ্লিমেন্টস এর গুরুত্ব এবং কোলাজেন সমৃদ্ধ খাবার

Published by

কোলাজেন কী ?

কোলাজেন হল মানুষের শরীরের এক প্রকার সংযোজক কলা এবং শরীরের প্রোটিন কম্পোজিশনের এক তৃতীয়াংশ অংশ জুড়ে আছে এই কোলাজেন। অস্থির দৃঢ় গঠনের জন্য কোলাজেন তন্তুর উপ্সথিতি প্রয়োজন। কোলাজেন তন্তুর সাথে অজৈব লবনের (ক্যালসিয়াম, ম্যাগ্নেসিয়াম, ফসফরাস) উপস্থিতির ফলে অস্থি দৃঢ় হয়। এই কোলাজেন তন্তু প্রোটিন দ্বারা গঠিত।

শরীরের ত্বক, মাংসপেশি, লিগামেন্ট, কন্ডরা(লিগামেন্ট) ও হাড়ের গঠনের এটি একটি প্রধান একক। রক্তজালক, কর্নিয়া এবং দাঁতেও কোলাজেনের উপ্সথিতি পাওয়া যায়। আমরা কোলাজেন কে আঠার সাথে তুলনা করতে পারি, যা শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে একসাথে ধরে রেখেছে। কোলাজেন শব্দটি গ্রীক শব্দ “কোল্লা”(colla) থেকে এসেছে, যার অর্থ হল “আঠা”।

শরীরে কোলাজেনের কাজ কি?

প্রায় ১৬ প্রকারের কোলাজেন আছে, এর মধ্যে টাইপ ১,২,৩,৪ প্রধান।

টাইপ :

শরীরে উপ্সথিত কোলাজেনের প্রায় ৯০% এই প্রকারের এবং এটি ঘন তন্তুর(ফাইবার) বুননে গঠিত। এটি ত্বক, হাড়, টেন্ডন, কার্টিলেজ, সংযোগকারী কলা এবং দাঁতের গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করে।

টাইপ :

এই প্রকারে তন্তুর বাঁধন অনেক হাল্কা হয়। ইলাস্টিক কার্টিলেজ, যা আমাদের হাড়ের সংযোগ স্থল (joints) কে রক্ষা করে ও আবৃত করে রাখে সেটি এই ধরনের তন্তু দ্বারা গঠিত হয়।

টাইপ :

এই প্রকারটি মাংস পেশি, অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ ও ধমনীর গঠনে সহায়তা করে।

টাইপ :

এই প্রকারটি ত্বকের নানা স্তরে পাওয়া যায়।

যত আমাদের বয়স বাড়তে থাকে আমাদের শরীর তত কম পরিমানের ও অনুন্নত প্রকৃতির কোলাজেন প্রস্তুত করতে থাকে। এর সবথেকে বড় প্রমান হল আমাদের ত্বক, যা বউওসের সাথে সাথে তার দৃঢ়তা ও ঔজ্জ্বল্য হারায় এবং কার্টিলেজও দুর্বল হয়ে পড়ে বয়স বাড়ার সাথে সাথে।

কোলাজেন তৈরিতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান

সমস্ত কোলাজেনই প্রথমে প্রোকোলাজেন হিসাবে তৈরি হয়। গ্লাইসিন (glycine) এবং প্রোলাইন (proline) নামক দুইপ্রকারের অ্যামিনো অ্যাসিডের সাহায্যে প্রোকোলাজেন তৈরি হয় এবং এই পদ্ধতিতে ভিটামিন সি–এর প্রয়োজোন হয়। শরীরে কোলাজেনের পরিমান বৃদ্ধি করতে নিম্নলিখিত পুষ্টির উপাদানগুলি প্রয়োজন হয়।

ভিটামিন সি

টক জাতীয় ফল, স্ট্রবেরি, লঙ্কা ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি পাওয়া যায়।

প্রোলাইন

ডিমের সাদা অংশ, দুগ্ধজাত দ্রব্য, বাঁধাকপি, অ্যাসপারাগাস, মাশরুম ইত্যাদির ভেতর প্রচুর পরিমানে প্রোলাইন পাওয়া যায়।

গ্লাইসিন

চিকেন, পর্ক, জিলেটিনে গ্লাইসিন পাওয়া যায়, যদিও যেকোনো প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্যতেই গ্লাইসিন পাওয়া যায়।

কপার

তিল বীজ, কোকো পাওডার, কাজু এবং মুসুর ডালের ভেতর প্রচুর পরিমানে কপার পাওয়া যায়।

এর সাথে বলা যায় আমাদের শরীরের উচ্চ পর্যায়ের প্রোটিন দরকার যাতে শরীরে অ্যামিনো অ্যাসিডের যোগান ঠিক থাকে যা শরীরে নতুন প্রোটিনের জন্ম দেবে। মাংস, ডিম, সি-ফুড, দুগ্ধজাত দ্রব্য, টফু – এগুলোর মাধ্যমে শরীরে অ্যামিনো অ্যাসিডের উৎকৃষ্ট যোগান সম্ভব হয়।

কি কি কারণে কোলাজেন নষ্ট হয়

যে যে কারনে কোলাজেন ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেগুলো অবশ্যই আমাদের এড়িয়ে চলতে হবে।

  • অতিরিক্ত পরিমানে চিনি রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ

কোলাজেন নিজেই নিজের ক্ষতিগ্রস্ত অংশকে সারিয়ে তুলতে পারে। চিনি এই প্রক্রিয়া কে ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়। খাদ্যে চিনি ও রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট এর পরিমান খুব নিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে।

  • অতিরিক্ত রোদে থাকা

আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি কোলাজেনের উৎপাদন কে কমিয়ে দেয়, তাই রোদে অতিরিক্ত থাকা বন্ধ করতে হবে।

  • ধূমপান

ধূমপান কোলাজেনের উৎপাদন ভীষণ কমিয়ে দেয় এবং তার নিজস্ব ক্ষতিগ্রস্ত কোষের পরিপূর্ণ করার পদ্ধতিকে কমিয়ে দেয় ফলে ত্বকে রিঙ্কলস আসতে শুরু করে দেয়।

কোলাজেন নষ্টের কারণ

কিছু অটোইমিউন ডিজিজ যেমন লুপাস, কোলাজেন কে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

কোলাজেন সমৃদ্ধ খাবার
  • প্রাণী খাদ্যের সংযোগকারী টিস্যুতে কোলাজেন পাওয়া যায়। যেমন চিকেন ও পর্কের ত্বকে প্রচুর পরিমানে কোলাজেন থাকে।
  • Bone broth” একটি কোলাজেনের উৎকৃষ্ট উৎস। মুরগী ও অন্যান্য প্রানীর হাড় ফুটিয়ে এটি তৈরি কর হয়।
  • জিলেটিন হল রান্না করা কোলাজেন, ফলে এটিতে প্রচুর পরিমানে অ্যামিনো অ্যাসিড পাওয়া যায়।

যদিও এটি এখনও প্রমানিত নয় যে কোলাজেন সমৃদ্ধ খাদ্য শরীরে কোলাজেনের পরিমানকে বৃদ্ধি করে কি না।

কোলাজেন সাপ্লিমেন্টস এর গুরুত্ব

দুই ধরনের কোলাজেন সাপ্লিমেন্ট খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

  • হাইড্রোলাইজড কোলাজেন
  • জিলেটিন

এইগুলো আগে থেকেই তে প্রোটিন ভেঙে পেপটাইডস এ পরিনত হয়ে থাকে ফলে আমাদের শরীর তা সহজেই আত্মীকরন করতে পারে। কোলাজেন সাপ্লিমেন্টস নিয়ে খুব বেশি গবেষণা করা হয়নি। তবে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোতে এর উপকারিতা দেখা গেছে —

  • পেশির বৃদ্ধি

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে পুরুষদের ভেতর কোলাজেন পেপটাইড সাপ্লিমেন্টস এবং স্ট্রেন্থ ট্রেনিং এর মাধ্যমে পেশির পরিমান ও শক্তি বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে।

  • আর্থারাইটিস

ইঁদুরের ওপর কোলাজেন সাপ্লিমেন্টস এর পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে পোস্টট্রমাটিক অস্টিওআর্থারাইটিসের বৃদ্ধির গতি কমিয়ে দেয় কোলাজেন।

  • ত্বকের তারুণ্য

যেসব মহিলারা কোলাজেন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করেন তাদের ত্বকের তারুন্যের উন্নতি দেখা গেছে। ট্রপিক্যাল ট্রিটমেন্ট হিসাবে বলিরেখা কমিয়ে ত্বকের তারুণ্য বজায় রাখতে কোলাজেন ব্যবহার করা হয়।

কোলাজেন গ্রহনের প্রধান উপকারিতা

১) ত্বকের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে কোলাজেন বড় ভূমিকা পালন করে। ত্বকের একটা প্রধান উপাদানই হল কোলাজেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কোলাজেন উৎপাদন কমতে থাকে ফলে ত্বক শুষ্ক হয়ে যায় এবং বলিরেখা দেখা দেয়। কোলাজেন সাপ্লিমেন্ট শরীরে কোলাজেনের পরিমান ঠিক রেখে ত্বকের শুষ্ক ভাবকে নিয়ন্ত্রন করে এবং বলিরেখা নিরাময় করে।

২) কার্টিলেজ, রাবারের মতো টিস্যু, যা আমাদের হাড়ের সংযোগস্থলকে রক্ষা করে, কোলাজেন সেটা রক্ষা করে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কোলাজেন উৎপাদন কমতে থাকলে হাড়ের জয়েণ্টের রোগ, যেমন অস্টিওআর্থারাইটিস হতে দেখা যায়। কোলাজেন সাপ্লিমেন্ট গ্রহনের ফলে অস্টিওআর্থারাইটিস ও সামগ্রিক ভাবে হাড়ের জয়েন্টের ব্যাথা কম থাকে।

৩) আমাদের শরীরের হাড় প্রধানত কোলাজেন দিয়েই গঠিত হয়েছে এবং কোলাজেন হাড়কে মজবুত রাখতে সাহায্য করে। বয়সের সাথে সাথে কোলাজেনের উৎপাদন কমতে থাকলে হাড়ও দুর্বল হতে থাকে, এর ফলে অস্টিওপরোসিস এর মতো রোগ জতে পারে, যেখানে হাড়ের ঘনত্ব কমে যায় ও হাড় ভঙ্গুর হয়ে যায়। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে কোলাজেন সাপ্লিমেন্ট সমগ্র হাড়ের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটিয়ে হাড়ের ভঙ্গুরতা ও অস্টিওপরোসিসকে রোধ করে।

৪) ১–১০% পেশির টিস্যু কোলাজেন দিয়ে তৈরি হয়। পেশিকে শক্তিশালী রাখতে এই প্রোটিনটির খুব দরকার হয়। কোলাজেন সাপ্লিমেন্টের মাধ্যমে বয়স বাড়ার সাথে সাথে পেশির ক্ষয়কে রোধ করা যায়। কোলাজেনের সাথে সঠিক এক্সারসাইজ পেশির বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

৫) কোলাজেন ধমনীর গঠনে সহায়তা করে, যার মাধ্যম দিয়ে রক্ত হৃদপিণ্ড থেকে সারা শরীরে যায়। পর্যাপ্ত পরিমাণে কোলাজেন ছাড়া ধমনী দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে যেতে পারে। কোলাজেন সাপ্লিমেন্ট হৃদপিণ্ড সংক্রান্ত সমস্যাকে দূরে রাখতে সাহায্য করে।

Anshula Banerjee

Hello, I am Anshula Banerjee, completed my post-graduation degree in English, along with Bachelor of Education. I live at Nadia. I am a voracious reader in various fields of knowledge that may help the readers to satisfy their urge specially in the area of health and wellness.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago