পিসিওএস এবং তার সঠিক ডায়েট

Published by

পিসিওএস (পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম) বর্তমানে বহুল প্রচলিত একটি রোগের নাম। হরমোন জনিত সমস্যা থেকেই সৃষ্টি হয় PCOS এর সমস্যা। এই মুহূর্তে প্রতি পাঁচজন মহিলার মধ্যে একজন এই রোগের শিকার। অনিয়মিত পিরিয়ড বা একেবারেই পিরিয়ড না হওয়া পিসিওএসের প্রাথমিক সমস্যা। তবে শুরুতেই যদি এই রোগ ধরা পড়ে তাহলে টাইপ টু ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, হাইকোলেস্টেরল, হার্টের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। পিসিওএস এর মূল সমস্যা হলো ওবেসিটি বা অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি। এছাড়াও দেখা যায় ইনফার্টিলিটির মতো সমস্যা ৷

পিসিওএস আবার একটি মেটাবলিক ডিসঅর্ডার। এ ক্ষেত্রে ওভারি থেকে অনেক বেশি পরিমাণে পুরুষ হরমোন নির্গত হয়। পিসিওএস এর ক্ষেত্রে ওভারিতে পলিসিস্টিক অ্যাপিয়্যারেন্স থাকে। তার সারফেস জুড়ে অনেকটা ছোট ছোট ফোসকার মতো দেখতে লাগে। এর ফলে ওভারি ভারী হয়ে যায়। পুরুষ হরমোনের আধিক্যের কারণে ফেসিয়াল হেয়ার, অবাঞ্ছিত রোম বাড়ে।

পিসিওএস এর লক্ষণ গুলি কি কি?

  • অনিয়মিত পিরিয়ড বা পিরিয়ড একেবারেই না হওয়া।
  • পিরিয়ডে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ
  • মুখ এবং দেহে অতিরিক্ত চুল বৃদ্ধি বা হিরসুটিজম
  • ত্বকে ব্রণ হওয়া
  • অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি
  • মাথায় চুল পড়ে যাওয়া বা অ্যালোপেশিয়া
  • ত্বকের কালচে ভাব
  • হরমোনের পরিবর্তনের জন্য প্রায়শই  মাথাব্যথা হওয়া
  • মানসিক অবসাদ
  • স্লিপ অ্যাপনিয়া

একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, পিসিওএস নিয়ন্ত্রণে ডাক্তাররা  মেটফরমিন বা কন্ট্রাসেপটিভ পিলের মতো ওষুধ দিলেও এই সমস্যা থেকে মুক্তি  পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো সঠিক ডায়েট এবং নিয়মিত শরীরচর্চা।

পিসিওএস-এর সঠিক ডায়েট চার্ট

মূলত লো ক্যালোরি ডায়েট প্ল্যান এই সিনড্রোমের জন্য উপযুক্ত। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ১০০০-১২০০ ক্যালোরি থাকা প্রয়োজন। এর ফলে ব্লাড সুগার এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখবে। নিয়ন্ত্রণে থাকবে ওজনও।

সবুজের আধিক্য

ডায়েটে থাকুক প্রচুর পরিমাণে সবুজ শাকসব্জি। অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট সমৃদ্ধ খাবার খান, যেমন রাঙা আলু, টম্যাটো, গাজর, পটল খাদ্য তালিকায় অবশ্যই রাখতে হবে। লেটুস, পালং, কলমি শাক তালিকায় থাকুক, এগুলিতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে। এছাড়াও, যার মধ্যে ভিটামিন সি, কে, বি, পটাসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন সমৃদ্ধ শাক সবজি রাখতেই হবে ডায়েটে। আসলে এই সিনড্রোমে যাঁরা ভুগছেন তাঁদের খাদ্যতালিকায় আয়রন থাকা ভীষণ জরুরি। এছাড়াও সবুজ শাকসবজি  পটাসিয়াম ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোনের ভালো উৎস। যা ওজন কমাতে সাহায্য করে। অবশ্যই দিনে দু’বার চিনি ছাড়া গ্রিন টি খান নিয়মিত৷

লো কার্ব

ভাত বা রুটি বাদ থাক ডায়েট থেকে। একান্ত প্রয়োজন হলে ক্যালরি ব্যালেন্স করে খান৷ মুগ, মুসুর সহ বিভিন্ন ধরনের ডাল খান। সব্জি দিয়ে ডালের স্যুপ তৈরি করে খেতে পারেন। অনেকের ক্ষেত্রেই পিসিওএস এর জন্য প্রোটিন কন্টেইন বাড়াতে হয় শরীরে, সেক্ষেত্রে  রাজমা, মটর ইত্যাদি পরিমিত পরিমাণে যোগ করুন ডায়েটে।

লো ফ্যাট, হাই প্রোটিন

কাতলা বা বোয়াল জাতীয় তৈলাক্ত বড় মাছ কখনোই নয়, ভিটামিন বি ও ডি যুক্ত মাছ খান। প্রোটিন সমৃদ্ধ মাছ অথবা চিকেন থাকুক রোজকার ডায়েটে।এছাড়াও আমন্ড, আখরোট ইত্যাদি নিয়মিত খাদ্য তালিকায় রাখুন। অলিভ অয়েল শুধু ওজন কমানো নয়, শরীরের অন্যান্য রোগের সাথেও লড়াই করতে সাহায্য করে। স্যামন, টুনা খেতে পারলে খুব ভালো, এ দেশে এসবের ব্যবহার কম হওয়ায় সেভাবে বাজারজাত হয় না।

মরসুমি ফল

ফলে প্রচুর পরিমণে ভিটামিন, মিনারেল, ফাইবার থাকে। তাই পিসিওএসের সমস্যা থাকলে প্রতিদিন আম, আপেল, লেবু, পেয়ারা, তরমুজ, পেঁপে এবং শুকনো খেজুর এছাড়া যেকোনো মরসুমি ফল অবশ্যই খাদ্য তালিকায় রাখুন। জুস না করে গোটা ফলটাই খাওয়ার চেষ্টা করুন। ফ্রুট স্যালাড বানিয়েও খেতে পারেন। আপেল বা শসা খোসা না ছাড়িয়ে খেলে সম্পূর্ণ পুষ্টিগুণ বজায় থাকে৷

দুধ বা দুগ্ধজাত খাদ্য

দুধ খেতে সমস্যা না থাকলে নিয়মিত এক গ্লাস (আনুমানিক ২০০-২৫০ মিলি) দুধ খান। বাড়িতে পাতা টকদই খুবই উপকারী এক্ষেত্রে। দুধ ফুটিয়ে ছানা বানিয়েও খাওয়া যেতে পারে। ১৫০ মিলি দুধের সাথে ৫০-৬০ গ্রাম ওটস মিশিয়ে সারারাত রেখে, ব্রেকফাস্টে খেতে পারেন, সাথে থাক মরসুমি ফল। ওজন নিয়ন্ত্রণে এটি ভীষণ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দুধের বদলে পনীর ও থাকতে পারে ডায়েটে। এক চামচ দেশি ঘি যোগ করতেই পারেন খাদ্যতালিকায়, এতে স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা গুড ফ্যাট থাকে৷ বাটার অল্প পরিমাণে চলতে পারে, কিন্তু মার্জারিন একেবারেই খাবেন না। পনির চলতে পারে।

এসবের বাইরেও কয়েকটি জিনিসের ব্যবহার পিসিওএস নিয়ন্ত্রণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমনঃ

  • পাতিলেবু
  • দারচিনি গুঁড়ো
  • জিরা
  • চিয়া সিড
  • পামকিন সিড
  • ফ্ল্যাক্স সিড

এগুলি বিভিন্ন ভাবে ডায়েটে ব্যবহার করা যায়। সিড গুলি সারারাত জলে ভিজিয়ে রেখে স্মুদির সাথে মিশিয়ে সহজেই খাওয়া যায়।

পাতিলেবু যেকোনো খাবারের সাথেই খাওয়া যায়। ঈষদুষ্ণ জলের সাথে মিশিয়েও খাওয়া যায়।

এক চামচ জিরা এক গ্লাস জলে ফুটিয়ে খাওয়া যেতে পারে।

দারচিনি গুঁড়ো এক চামচ করে রোজ সকালে খান।

কি কি খাওয়া অনুচিতঃ

পিসিওএস এর ক্ষেত্রে কি কি খাওয়া উচিত নয়, এটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কঠোর ভাবে সেগুলি খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে৷

  • চিনি দেওয়া চা, যে কোনো রকম মিষ্টি৷
  • প্রসেসড ফুড।
  • ময়দা বা যেকোনো রিফাইন্ড খাদ্যবস্তু, নুডলস, পাস্তা।
  • অতিরিক্ত তেলে ভেজা যেকোনো খাবার।
  • প্যাকেটজ্যাত খাদ্য, যেমনঃ চিপ্স, কেক, মিষ্টি জাতীয় বিস্কুট৷
  • যেকোনো প্রকার ফাস্ট ফুড।
  • রেড মিট বা খাসীর মাংস।
  • কফি, চকোলেট। তবে ব্ল্যাক কফি এবং ডার্ক চকোলেট খেতে পারেন৷
  • ধূমপান এড়িয়ে চলুন।

 মদ্যপান বন্ধ করুন। পিসিওএস এর সাথে সাথে অতিরিক্ত মদ্যপান বন্ধ্যাত্বের সমস্যাও প্রকট করে।

সর্বোপরি মনে রাখতে হবে, জীবনযাত্রায় পরিবর্তনই একমাত্র এগিয়ে দেবে রোগমুক্তির পথে৷ দিনে ৩-৪ লিটার জল, পর্যাপ্ত ঘুম, প্রতিদিন কমবেশি ৩০ মিনিটের ব্যায়াম, এবং সাথে সঠিক ডায়েট নিয়ন্ত্রণে রাখবে পিসিওএস এর সমস্যা।

Srikona Sarkar

As a Student of Science, I found the subject of both mental and physical wellness quite intriguing in my school days, Which was further sharpened with the completion of Graduation in Molecular Biology in my College. As The whole world, right now is battling with the greatest pandemic of human civilization, I cannot help myself from helping out people by providing the exact solution for their mental and physical profoundness so that, they can always discover a new tunnel of hope and light, even when their movement is restricted within the boundary of the walls.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago