ঋতুচক্র কি? ঋতুচক্র বা মাসিক চক্রের বিভিন্ন পর্যায়

Published by

ঋতুচক্র কি- সারাবছরই প্রতি মাসে বয়ঃসন্ধি এবং মেনোপজের মধ্যেকার এই সময়টায়, একজন মহিলার শরীর নানাবিধ পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়, গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত হতে। হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই ঘটনা গুলিকে ঋতুচক্র বলা হয়।

প্রতিবার ঋতুচক্র বা মাসিক চক্রের সময়, ওভারি বা ডিম্বাশয় থেকে একটি ডিম্বাণু নির্গত হয় ৷ এবং জরায়ুতে একটি আস্তরণ তৈরি হয়। যদি কোনপ্রকার গর্ভাবস্থা সৃষ্টি না হয় তবে জরায়ুর সেই আস্তরণটি নষ্ট হয়ে যায়। তারপর পুনরায় এই চক্র শুরু হয়।

একজন মহিলার এই ঋতুচক্রটি চারটি ধাপে বিভক্তঃ

প্রতিটি পর্বের সময়সীমা প্রত্যেকের ক্ষেত্রে পৃথক হতে পারে এবং সময়ের সাথে সাথে এটি পরিবর্তন হওয়াও সম্ভব।

1.মাসিক পর্ব

মেয়েদের শরীরে প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট সময়ে ওভারি বা ডিম্বাশয় থেকে এগ বা ওভাম বা ডিম্বাণু নির্গত হয়। এই ওভামকে যদি স্পার্ম নিষিক্ত করে তবেই ভ্রূণ তৈরি হয়। এই পরিণত ডিম্বাণু নির্গত হওয়ার সময় এলেই শরীর আসন্ন ভ্রূণের কথা ভেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করে।

ওভারি থেকে এই ডিম্বাণু নিঃসরণের সময় এলেই জরায়ুর দেওয়াল মোটা হতে শুরু করে এবং একটি আস্তরণের সৃষ্টি হয়। একে ডাক্তারি পরিভাষায় বলা হয় লাইনিং অফ ইউটেরাস। ভ্রূণ তৈরি হলে সে এই জরায়ুর গায়েই স্থাপিত হয়। ওভারি বা ডিম্বাশয় থেকে নির্গত ওভাম মোটামুটি ১২-২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। এই সময় যদি ফ্যালোপিয়ান টিউবে উপস্থিত শুক্রাণু বা স্পার্ম এই ওভামকে নিষিক্ত করে, তবেই ভ্রূণ তৈরি হয়। এই সময়ের মধ্যে যদি কোনও নিষেক না ঘটে, তা হলে এর প্রায় ১৪-১৫ দিন পরে জরায়ুর লাইনিং ছিঁড়ে বা নষ্ট হয়ে রক্ত ও মিউকাসের সাথে বেরিয়ে আসে। একেই আমরা মাসিক বা পিরিয়ড বলি।

পিরিয়ডের সাধারণ লক্ষণ গুলি হলোঃ                                                                                  

  • কোমর, তলপেটে মাসল ক্র্যাম্প
  • স্তনের স্পর্শকাতরতা
  • মুড সুইং
  • বিরক্তি
  • মাথাব্যথা
  • ক্লান্তি
  • লোয়ার ব্যাক পেইন

গড়ে, 3 থেকে 7 দিন একজন মহিলার মাসিক চক্র স্থায়ী হয়। তবে ব্যক্তিবিশেষে শারীরবৃত্তীয় পার্থক্যের জন্য স্থায়ীত্বকালের পার্থক্য হয়।

2.ফলিকিউলার পর্ব

এই ফলিকুলার ফেজ মাসিকের একদম প্রথম দিন থেকে শুরু হয়। এই সময় আমাদের হাইপোথ্যালামাস, পিটুইটারি গ্রন্থিকে বার্তা পাঠায় ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন (FSH) নিঃসরণ করার জন্য। এই হরমোন ডিম্বাশয় বা ওভারিকে উত্তেজিত করে। আর এর প্রভাবেই ওভারি ৫-২০ টি ফলিকল তৈরি করে।  প্রত্যেকটি ফলিকলের মধ্যে একটি করে অপরিণত ডিম্বাণু থাকে।

এই সব ফলিকলের মধ্যে থাকা ডিম্বাণুর মধ্যে যেটি সবথেকে উন্নতমানের হয়, সেইটিই একটি পরিণত ডিম্বাণুতে রূপান্তরিত হয়। বাকি ফলিকল শরীরেই মিলিয়ে যায়। ডিম্বাণু পরিণত হয়ে গেলে তার নির্দেশেই শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের ক্ষরণ শুরু হয়। এই হরমোনই অনাগত ভ্রূণের বসবাসের উপযোগী করে তুলতে জরায়ুর দেওয়াল মোটা করতে শুরু করে। গড় হিসেব করলে, ফলিকিউলার ফেজ ১৬দিন অব্ধি স্থায়ী হয়। তবে ব্যক্তিবিশেষে তা ১১-২৭ দিন অব্ধিও থাকে। শরীর অনুযায়ী এই সময়ের তারতম্য হতেই পারে।

3.ওভ্যুলেশন পর্ব

ক্রমাগত বাড়তে থাকা ইস্ট্রোজেন হরমোন পিটুইটারি গ্রন্থিকে উত্তেজিত করে এবং এর ফলে লিউটিনাইজিং হরমোন নিঃসৃত হয়। আর এই সময়েই শুরু হয় ওভ্যুলেশন প্রক্রিয়া। প্রতিমাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ে মহিলাদের ডিম্বাশয় থেকে একটি পরিণত ওভাম বা ডিম্বাণু নির্গত হয়। একেই ওভ্যুলেশন(Ovulation) বলে। এই ওভাম ওভারি থেকে নিঃসৃত হয়ে ফ্যালোপিয়ান টিউবের মধ্যে চলে আসে। এই সময় কোনও ভাবে যদি ফ্যালোপিয়ান টিউবে শুক্রাণু বা স্পার্ম উপস্থিত থাকে, তা এই ওভামকে নিষিক্ত করে। এভাবেই ভ্রূণ তৈরি হয়। যারা সন্তান ধারণ করার চেষ্টা করছেন, তাদের এই সময়ে নিয়মিত সহবাস করতে বলেন ডাক্তাররা। ওভামের আয়ু একদিন বা ২৪ ঘণ্টা হলেও শুক্রাণু একজন মহিলার দেহে ৩-৬ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।

সাধারণত, একটি নির্দিষ্ট মাসিক চক্রের ১৪ দিনের মধ্যে ওভ্যুলেশন হয়ে থাকে,যদি তাদের ঋতুচক্রটি ২৮ দিনের হয়। তবে, সবার শরীর সমান হয় না তাই, এই সময়েরও এদিক-ওদিক হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারও কারও ক্ষেত্রে ১২-১৯ অব্ধিও হতে পারে।

4.লুটিয়ল পর্ব

ওভ্যুলেশন ফেজে ফলিকল থেকে পরিণত ডিম্বাণু বেরিয়ে আসে। ডিম্বাণু বেরিয়ে গেলে ওই ফলিকলটি করপাস লিউটিয়ামে পরিণত হয়। এই করপাস লিউটিয়াম প্রোজেস্টেরন হরমোন নিঃসরণ করা শুরু করে। সাথে সাথে স্বল্প পরিমাণে ইস্ট্রোজেন হরমোনও তৈরি হয়। এই হরমোনগুলি জরায়ুর লাইনিং ঠিক রাখে, যাতে ভ্রূণ তৈরি হয়ে গেলে তার কোনও অসুবিধা না হয়। গর্ভাবস্থার সৃষ্টি হলে শরীরে হিউম্যান গোনাডোট্রপিন হরমোন উৎপন্ন হয়। প্রেগনেন্সি টেস্টে এই হরমোনের উপস্থিতি দ্বারাই গর্ভাবস্থা নিশ্চিত করা হয়। এবার যদি, কোনও নিষেক সম্পন্ন না হয়, তাহলে করপাস লিউটিয়াম নষ্ট হয়ে যায়। একটি মাসিক চক্র যদি ২৮ দিনের হয়, তা হলে মোটামুটি ২২ দিনের আশেপাশে এই প্রক্রিয়া ঘটে। এর ফলে, শরীরে প্রোজেস্টেরন হরমোনের মাত্রা কমে যায় এবং জরায়ুর লাইনিং ছিঁড়ে যায়। এই লাইনিং-ই রক্ত, মিউকাস ইত্যাদির সাথে মিশে বাইরে বেরিয়ে আসে। এবং এটিই আমাদের মাসিকের প্রধান উপসর্গ বা রজঃশ্রাব। এই লুটিয়ল ফেজ  ১১ থেকে ১৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

অনেকসময় এই পর্বে মাসিক শুরু হওয়ার আগে শরীরে হরমোনের মারাত্মক ওঠাপড়া চলে। এরই প্রভাবে দেখা দিতে পারে মুড সুইংস, মাথা ধরা, ক্লান্তি এবং অকারণ বিরক্তির মতো উপসর্গ। একে প্রি মেনস্ট্রুয়াল সিন্ড্রোম (PMS) বলা হয়। এক্ষেত্রে কিছু উপসর্গও দেখা যায়। যেমনঃ

  • ব্লটিং
  • স্তনের ফোলাভাব, ব্যথা বা স্পর্শকাতরতা।
  • ঘন ঘন মুড পরিবর্তন
  • মাথাব্যথা
  • ওজন বৃদ্ধি
  • যৌন ইচ্ছায় পরিবর্তন
  • বারবার ক্ষিদে পাওয়া
  • ঠিক মতো ঘুম না হওয়া
কয়েকটি সাধারণ সমস্যা

প্রত্যেক মহিলার ঋতুচক্র আলাদা হয়। কারও ক্ষেত্রে প্রতি মাসে একই দিনে পিরিয়ড হয়। কারও ক্ষেত্রে তা অনিয়মিত। যেমন কারও ক্ষেত্রে অতিরিক্ত রক্তপাত হয় আবার অনেকেরই দীর্ঘদিন পিরিয়ড স্থায়ী হয় ৷

কারও ক্ষেত্রে মাসিক চক্রটি জীবনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এসে পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন, মেনোপজের সময় এগিয়ে এলে পিরিয়ড  অনিয়মিত হয়ে যায়।

কয়েকটি বিষয়, যার কারণে স্বাভাবিক ঋতুচক্র বিঘ্নিত হয়। বলা ভালো, এতে ঋতুচক্রের স্বাভাবিক উপসর্গ গুলি দেখা যায় না।

যেমনঃ

জন্ম নিয়ন্ত্রণ

কন্ট্রাসেপটিভ পিল পিরিয়ডের স্থায়ীত্বকাল হ্রাস করে, এবং এর ফলে রক্তপাতের পরিমাণ অনেক কমে যায়।

গর্ভাবস্থা

গর্ভাবস্থায় পিরিয়ডগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত। সুতরাং পিরিয়ড মিস হওয়া, গর্ভাবস্থা বা প্রেগনেন্সির প্রথম লক্ষণ।

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম (PCOS)

এইরূপ হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ডিম্বাশয়ে ডিম্বাণুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি হতে বাধা দেয়। পিসিওএস এর ফলে অনিয়মিত ঋতুস্রাব এবং পিরিয়ড বন্ধও হয়ে যায়।

 ইউটেরাইন ফাইব্রয়েডস

মহিলাদের জরায়ুতে একটি অস্বাভাবিক বৃদ্ধির (নন-ক্যান্সারাস) ফলে পিরিয়ড স্বাভাবিকের চেয়ে দীর্ঘ হয় এবং অতিরিক্ত রক্তপাত ও দেখা যায়।

 ইটিং ডিসঅর্ডার

অ্যানোরেক্সিয়া, বুলিমিয়া এবং অন্যান্য খাওয়ার ব্যাধিগুলি মাসিক চক্রকে ব্যাহত করে এবং পিরিয়ড বন্ধ করে দিতে পারে।

ঋতুস্রাবে সমস্যা দেখা দিলে সাধারণত যে লক্ষণ গুলি দেখা যায়ঃ

  • পিরিয়ড মিস হওয়া বা আপনার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়া৷
  • অনিয়মিত পিরিয়ড।
  • সাত দিনেরও বেশি রক্তপাত চালু থাকা।
  • পিরিয়ড ২১ দিনের আগে হওয়া বা ৩৫ দিনের পরে হওয়া।
  • অতিরিক্ত ভারী রক্তপাত।

ঋতুস্রাব সম্বন্ধীয় এই ধরণের সমস্যা গুলি দেখা দিলে অবিলম্বে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। 

প্রত্যেক মহিলার ঋতুচক্র আলাদা হয়। একজনের ক্ষেত্রে যা স্বাভাবিক তা অন্য কারও জন্য স্বাভাবিক নাও হতে পারে।

প্রত্যেকের নিজের ঋতুচক্র সম্বন্ধে সঠিক ধারণা থাকা প্রয়োজন৷ 

Srikona Sarkar

As a Student of Science, I found the subject of both mental and physical wellness quite intriguing in my school days, Which was further sharpened with the completion of Graduation in Molecular Biology in my College. As The whole world, right now is battling with the greatest pandemic of human civilization, I cannot help myself from helping out people by providing the exact solution for their mental and physical profoundness so that, they can always discover a new tunnel of hope and light, even when their movement is restricted within the boundary of the walls.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago