সিকল্ সেল ডিজিজ-এর লক্ষণ ও চিকিৎসা

Published by

সিকল্ সেল ডিজিজ কি ?

সিকল্ সেল ডিজিজ রক্তের একটি জিনবাহিত অসুখ, যেমন থ্যালাসেমিয়া ও হিমোফিলিয়া। সিকল্ সেল ডিজিজ আবার সিকল্ সেল অ্যানিমিয়া নামেও পরিচিত। বিজ্ঞানীদের মতে, এই জিন বাহিত রোগে মানুষের দেহে ঠিক মতো রক্ত কণিকা তৈরি হয় না। তার ফলে রক্তের অক্সিজেন বহন ক্ষমতা কমতে শুরু করে।

সিকল সেল ডিজিজ কেন হয় ?

চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের ধারণা, এই রোগ জিন ঘটিত। বাবা-মা বা পূর্বপুরুষের কারোর এই ব্যাধি থাকলে, সন্তানের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। এটি এমন একটি রোগ যা রক্তে হিমোগ্লোবিন ধ্বংস করে দেয় এবং লাল লোহিত কণিকাগুলির (আর বি সি) গঠনে অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি করে। ফলে আর বি সি ভেঙ্গে যায়। ব্যাপারটা হয় এইরকম। হিমোগ্লোবিন এস (Hgb S) হচ্ছে এক ধরণের অস্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন শিশু জন্মসূত্রে বাবা মায়ের কাছ থেকে যা পায়। Hgb S লোহিত রক্তকণিকাগুলিকে অনমনীয় এবং অস্বাভাবিক আকৃতিবিশিষ্ট করে তোলে। ফলে  লোহিত রক্তকণিকাগুলি স্বাভাবিক গোলাকার না হয়ে বেঁকে কাস্তে বা সিকল্-এর মতো দেখতে হয়ে যায়। এই কারণে রক্তাল্পতার এই ধরনকে সিকল সেল অ্যানিমিয়া বা হিমোগ্লোবিন এস ডিজিজ বলে। লোহিত রক্তকণিকার অস্বাভাবিক আকৃতির জন্য রক্তে অক্সিজেন সঞ্চালন বাধা পায়। হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম থাকার কারণে দেহে অক্সিজেনের পরিমাণও কমে যায়। সব মিলিয়ে সিকল্ সেল ডিজিজ বা সিকল্ সেল অ্যানিমিয়া সৃষ্টি হয়।

উল্লেখ্য এই রোগ অবাধারিতভাবে বংশগত বা পারিবারিক সূত্রে পাওয়া। কোনও মানুষ সিকল্ সেল অ্যানিমিয়া নিয়ে না জন্মালে পরবর্তী জীবনে তাঁর এই রোগ হতে পারে না। বর্তমানে আমেরিকায় সিকল্ সেল ডিজিজে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় এক লাখ। বেশিরভাগই আফ্রিকান বংশোদ্ভূত আমেরিকান।

এই রোগটি জন্মের পর থেকেই শরীরে বাসা বাঁধে। তবে ছয় থেকে সাত মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে সাধারণত এই রোগের উপসর্গ দেখা যায় না। আট-নয় মাস বা এক বছরের পর থেকে বাচ্চাদের মধ্যে এই রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে মাত্র চার কি পাাঁচ মাস বয়সের শিশুদের মধ্যেও এই রোগের উপসর্গ লক্ষ্য করা যায়। বাবা বা মায়ের মধ্যে যে কোনও একজনের শরীরে এই রোগ থাকলে তার সন্তানেরও রোগের আশঙ্কা থেকে যায়। তাই বিয়ের আগে পাত্র ও পাত্রীর রক্ত পরীক্ষার মধ্য দিয়ে পরের প্রজন্মের মধ্যে এই রোগ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা নির্মূল করা সম্ভব।

সিকল্ সেল ডিজিজ-এর লক্ষণ

১. বুক, পেটে এবং বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা হয়। এই ব্যথা কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক সপ্তাহ অবধি অব্যাহত থাকতে পারে।

২. রক্তাল্পতা।

৩. চোখে ফ্যাকাসে ভাব ও চোখের নানাবিধ সমস্যা।

৪. শিশুদের দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে বাধা আসে। অনেক বাচ্চার বয়ঃসন্ধির লক্ষণগুলি দেরিতে প্রকাশ পায়।

৫. অতিরিক্ত ক্লান্তি ও বিরক্তি।

৬. হাত, পা ফুলে যাওয়া।

৭. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাওয়ায় ঘন ঘন বিভিন্ন অসুখে আক্রান্ত হওয়া।

৮. কিডনির সমস্যা ও ত্বকে হলদে আভা।

সিকল্ সেল ডিজিজ-এর ধরণ :-

১. হিমোগ্লোবিন এসএস ডিজিজ।

২. হিমোগ্লোবিন এসসি ডিজিজ।

৩. হিমোগ্লোবিন এসবি + (বিটা) থ্যালাসেমিয়া।

৪. হিমোগ্লোবিন এসবি জিরো (বিটা-জিরো) থ্যালাসেমিয়া।

৫. হিমোগ্লোবিন এসডি, হিমোগ্লোবিন এসই।

৬. সিকল সেল ট্রেট। 

রোগ নির্ণয়

শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের সিকল্ সেল ডিজিজ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। রক্তে হিমোগ্লোবিন এস – এর উপস্থিতি যাচাই করে এবং রোগের লক্ষণ দেখেই এই রোগ নির্ণয় করা হয়। পাশাপাশি রুটিন রক্ত পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে ডায়াগনোসিস করা হয়।

চিকিৎসা

স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টেশনের মাধ্যমে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়। ব্লাড ট্রান্সফিউশন-এর মাধ্যমে রক্তে আর বি সি অথবা লোহিত রক্তকণিকার মাত্রা বাড়িয়ে চিকিৎসা করা হয়। একাধিক ওষুধ প্রয়োগ করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়েও চিকিৎসা সম্ভব।

এখানে উল্লেখ্য সিকল্ সেল ডিজিজে ভুগলে পরে স্ট্রোক হতে পারে। যে সব শিশু এ রোগে ভোগে তাদের এগারো শতাংশের কুড়ি বছর বয়সের আগেই স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৌলতে বিশেষ রকমের আলট্রাসাউন্ড যন্ত্র ব্যবহার করে একটি টেস্টের মাধ্যমে জানা যায়, ভবিষ্যতে কোন্ কোন্ শিশুর স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা বেশি। যন্ত্রণাবিহীন এই টেস্ট করার সময় সাউন্ড ওয়েভ কাজে লাগিয়ে মস্তিষ্কে রক্তের প্রবাহ মেপে দেখা হয়। সর্বনিম্ন দু’ বছরের শিশুরও এই টেস্ট করা যেতে পারে। নিয়মিত ব্লাড ট্রান্সফিউশন করলে এই রোগে আক্রান্তদের স্ট্রোকের আশঙ্কা কমে যায়।

এ ছাড়া জন্মের আগে ভ্রূণের মধ্যে এই রোগ আছে কিনা তাও জানা সম্ভব। মায়ের গর্ভে ভ্রূণটির চারদিকে অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইড নামে যে তরল থাকে তার খানিকটা সংগ্রহ করে এই পরীক্ষা (Screening) করা হয়।

নিয়মিত স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা উচিৎ যেমন – উপযুক্ত ডায়েট, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, স্ট্রেস এড়ানো, শরীরচর্চা ইত্যাদি করে এই রোগকে দমিয়ে রাখা যায়। সাময়িক অব্যাহতি পেতে এই সব ঘরোয়া পদ্ধতি কাজে আসতে পারে।

১. ব্যথা উপশমের জন্য হিটিং প্যাড ব্যবহার করা যায়।

২. ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করতে হবে।

৩. ডায়েটে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল, শাকসবজি এবং গোটা বার্লি ও গমের মতো শস্য রাখতে হবে। এ সব খাবার আরবিসি তৈরি করে। এ ছাড়া কম ফ্যাট সহ দুধ, বাদাম, ডিম, মাছ, চর্বি ছাড়া মাংস, সয়া মিল্ক এগুলিও বেশি RBC তৈরি করতে সাহায্য করে।

৪. প্রচুর পরিমাণে জল পান করতে হবে।

৫. স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কমিয়ে ফেলতে হবে এবং নিয়মিত দৈহিক কসরত করতে হবে।

৬. শরীরে কোনও অসুবিধা দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

5 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

5 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

5 months ago