প্রস্টেট ক্যানসারের কারণ,লক্ষণ ও চিকিৎসা

Published by

প্রস্টেট পুং জননতন্ত্রের অন্তর্গত একটি ছোট গ্রন্থি, যা মূত্রথলির নিচে থাকে। এটি বীর্য তৈরি ও পরিবহনে সাহায্য করে।

প্রস্টেট ক্যানসার কী ?

প্রস্টেট পুং জননতন্ত্রের অন্তর্গত একটি ছোট গ্রন্থি, যা মূত্রথলির নিচে থাকে। এটি বীর্য তৈরি ও পরিবহনে সাহায্য করে। এই গ্ল্যান্ড থেকে ডাই হাইড্রো টেস্টোস্টেরন (DHT) নামের অ্যানড্রোজেন হরমোন ক্ষরণ হয়। এই ধরণের হরমোনের মাত্রায় হেরফের হলে মূত্রনালীতে সমস্যা হয়। এই সমস্যা বাড়তে বাড়তে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই অঞ্চলের ক্যানসারকে প্রস্টেট ক্যানসার বলে।

প্রস্টেট ক্যানসারের কারণ

প্রস্টেট ক্যানসারের কারণ জানতে গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। এখনও পর্যন্ত এটুকু জানা গিয়েছে যে সাধারণত হরমোনের সমস্যার জন্যই এই ক্যানসার হয়। অন্যান্য কারণগুলি সম্পর্কে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের এখনো স্পষ্ট ধারণা হয়নি।

প্রস্টেট ক্যানসার স্পষ্ট বোঝার দিক থেকে একটি বড় অসুবিধা রয়েছে। শুধুমাত্র পুরুষদেহে এই ধরনের ক্যানসার কোনও উপসর্গ ছাড়াই ঘাপটি মেরে বসে থাকে। সাধারণত আগের থেকে কোনও লক্ষণ বোঝা যায় না। এই সমস্যা থাকলেই পুরুষটি অসুস্থ, এমন কিছু বোঝা কঠিন। তবে ছেলেদের বয়স ষাট-পঁয়ষট্টি পেরিয়ে যাওয়ার পরেই সাধারণত এই ক্যানসারের প্রকোপ দেখা যায়। চল্লিশের নিচে পুরুষদের  প্রস্টেট ক্যানসার হওয়া বিরল ব্যাপার।

প্রস্টেট ক্যানসারের লক্ষণ

এই ধরনের ক্যানসার বিনা লক্ষণেই সৃষ্টি হয়। তাই এমনিতে বুঝে ওঠা কঠিন। তা সত্বেও কিছু লক্ষণ প্রস্টেট ক্যানসারের ইঙ্গিত দেয়। সেগুলি নিচে বর্ণনা করা হল-

১.প্রস্রাবের পথে অসুবিধা তৈরি হয়।

২. প্রস্টেট গ্ল্যান্ড অনেক বড় হয়ে যেতে পারে।

৩. প্রস্টেট ক্যানসার অন্যান্য অঙ্গেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। সে ক্ষেত্রে রোগ মেরুদণ্ড পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে যার ফলে ব্যথা হয়। অনেক রোগী সেই ব্যথাকে গুরুত্ব দেন না। ব্যথাকে অবহেলা করার জন্য প্যারালিসিস বা পক্ষাঘাত পর্যন্ত হতে পরে।

৪. খুব কম ক্ষেত্রে প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তপাত হয়।

এত কিছুর পরেও মনে রাখা উচিৎ যে প্রস্রাবের পথে বাধা হওয়া মানেই প্রস্টেট ক্যানসার নয়। ওই জায়গায় কোনও টিউমার হলে প্রস্রাবের পথে বাধা তৈরি হতে পারে। তার ফলে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যেতে পারে। 

এই টিউমার দু’ধরনের হতে পারে। প্রথমটি হল বিনাইন বা ক্ষতিবিহীন টিউমার। দ্বিতীয় হল ম্যালিগন্যান্ট বা বিপজ্জনক টিউমার। সাধারণত হরমোনের তারতম্য থেকে বিনাইন টিউমার তৈরি হয়। কারো কারো আবার কিডনির সমস্যা থেকেও বিনাইন টিউমার তৈরি হয়।

অন্য টিউমার হল ম্যালিগন্যান্ট টিউমার। টেস্ট করে ম্যালিগন্যান্ট টিউমারের অস্তিত্ব টের পাওয়া গেলে, ক্যানসার হয়েছে বলে চিকিৎসকেরা সিদ্ধান্তে আসেন।

রোগনির্ণয়

এই রোগের অন্যতম প্রধান লক্ষণ হল প্রস্রাবে অসুবিধা। প্রস্রাবে বাধা সৃষ্টি হলে দেরি না করে  ইউরোলজিস্টের কাছে যেতে হবে। তিনি রোগীকে পরীক্ষা করে আল্ট্রা সোনোগ্রাফি (ইউএসজি) করতে বলবেন। এই পরীক্ষায় প্রস্টেটের মাপ বোঝা যাবে। প্রস্টেট বড় হয়ে গেছে কিনা বোঝা যাবে। যদি দেখা যায় প্রস্টেট অস্বাভাবিক রকম বড় হয়েছে তাহলে ইউরোলজিস্ট অবশ্যই হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল টেস্ট করানোর নির্দেশ দেবেন।

হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল টেস্ট আসলে ইউএসজি গাইডেড বায়োপসি। এই টেস্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানে ট্রান্স-রেক্টাল আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান অ্যান্ড বায়োপ্সি (TRUS বা ট্রাশ) বলে পরিচিত। হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল টেস্টের গোড়াতেই এই ধরনের বায়োপসি করা হয়।

এই টেস্ট করার সময় প্রথমে রেক্টামের পিছন দিয়ে ছবি তুলে প্রস্টেটের মাপ দেখা হয়। তার পরে সেই ছবি দেখে বায়োপসি করার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা বেছে নেওয়া হয়। এই দুটি পর্যায়ের পরের ধাপে, বেছে নেওয়া জায়গাটিতে একটি ছুঁচ পাঠানো হয়। ছুঁচটি ওই নির্দিষ্ট জায়গা থেকে টিস্যু বার করে নিয়ে আসে। পরের ধাপে প্যাথলজিক্যাল টেস্টের মাধ্যমে দেখে নেওয়া হয় ওই কোষগুলি ক্যানসারে আক্রান্ত কিনা।

এখানেই অবশ্য রোগ নির্ণয় পদ্ধতির শেষ নয়। হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল বায়োপসিতে ক্যানসারে আক্রান্ত কোষের খোঁজ পেলেই প্রস্টেট ক্যানসার হয়েছে, নিশ্চিত করে এমন বলা যায় না। এর পরেও চিকিৎসকেরা জোরালো প্রমাণ খোঁজেন।

রোগনির্ণয় করতে সুবিধার জন্য আরও একটি টেস্ট করা হয়। এটিকে বলা হয় রক্তের প্রস্টেট স্পেসিফিক অ্যান্টিজেন (পিএসএ) টেস্ট যার মাধ্যমে রক্তে এই ধরনের অ্যান্টিজেনের খোঁজ করা হয়। এই টেস্ট করে প্রস্টেটের হরমোনের তারতম্য ধরতে পারা যায়। পিএসএ-এর ফলাফল চারের উপরে থাকলেই তীব্র সমস্যা বলে মনে করা হয়। তবে পিসএসএ চারের উপরে থাকলেই প্রস্টেট ক্যানসার হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে এমন কিন্তু নয়। বায়োপসি  করে ক্যানসার আক্রান্ত কোষের খোঁজ না মিললে ক্যানসারের চিকিৎসা শুরু হবে না। ক্যানসার সম্পর্কে জোরদার প্রমাণ পাওয়ার জন্য পিএসএ টেস্ট করা হয়। পিএসএ চারের উপরে থাকলে বিনাইন টিউমার ধরে চিকিৎসা শুরু হবে।

অনেকের ধারণা রেডমিট মানে পাঁঠার মাংস খেলে প্রস্টেট ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। আসলে প্রস্টেট ক্যানসার নিয়ে একাধিক গবেষণা চলেছে। কিছু গবেষণার ফলে রেডমিটের সঙ্গে প্রস্টেট ক্যানসারের সংযোগের ইঙ্গিত মিলেছে। এই সংযোগ ঠিক কী রকম, দেখে নেওয়া যাক।

আমরা জানি যে হরমোনের সমস্যা থেকে প্রস্টেট ক্যানসার দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত রেডমিট খেলে ফ্যাট বাড়বে আর ফ্যাট বাড়লে হরমোনের ক্ষরণও বাড়বে। সাধারণত এই জন্যই বলা হয়, রেডমিট খেলে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। তবে প্রস্টেট ক্যানসারের চিকিৎসায় আজকাল খাবারের উপরে খুব একটা নিয়ন্ত্রণ জারি করা হয় না।

প্রস্টেট ক্যানসার অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে। তার ফলে অনেক সময় রোগীর প্যারালিসিস পর্যন্ত হয়ে যায়।

রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা

এই রোগ নির্ণয় করার জন্য বেশ কিছু পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়।

প্রথমে ইউরোলজিস্ট নিঃসন্দেহ হয়ে যান রোগীর প্রস্টেট ক্যানসারের হয়েছে কিনা। তার পরের ধাপে দেখতে হবে রোগ কত দূর ছড়িয়েছে। নির্দিষ্ট করে শরীরের কোথায় কোথায় ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে তার খোঁজ করা হবে। এই ধরণের ক্যানসার সাধারণত হাড়কেই নিশানা করে। সে জন্য সমস্ত শরীরের হাড়ের স্ক্যান করতে বলবেন চিকিৎসক। এর ফলে বোঝা যাবে ক্যানসার আর কোন কোন অঙ্গে থাবা বসিয়েছে।

ইউরোলজিস্ট পরীক্ষার পরে ক্যানসারের প্রমাণ পেলে সার্জারির কথা বলবেন। প্রথম অবস্থায় ধরা পড়লে অস্ত্রোপচার করে ফেললেই রোগ নিরাময় হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সার্জারি করা না গেলে প্রথমে একটি জায়গা নির্দিষ্ট করে টেলিথেরাপি দেওয়া হয়। তাতে কাজ না হলে ব্রাকি থেরাপি করা হয়। প্রস্টেট ক্যানসার হাড়ে ছড়িয়ে পড়লে ‘রে’ দেওয়া হয়।

হরমোন থেরাপির মাধ্যমেও প্রস্টেট ক্যানসারের চিকিৎসা হয়। অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসরণ হলে প্রস্টেট ক্যানসার হু হু করে বেড়ে যায়। হরমোন থেরাপি করে এরকম কয়েকটি হরমোনের মাত্রা কমিয়ে দেওয়া হয়। এই থেরাপি আবার দুরকমের। একটি হল সার্জারি। আর একটি ধাপ হলো ওষুধ খাওয়া।

হরমোন থেরাপিতে যে সার্জারি করা হয় তা অন্য ধরণের। এই অস্ত্রোপচারে হরমোন থেরাপির অংশ হিসেবে সম্ভব হলে অন্ডকোষ বা টেস্টিকেল বাদ দেওয়া হয়। এই চিকিৎসাকে বলা হয় অরকিডেকটোমি। অণ্ডকোষ বাদ যাওয়ার পরে রক্তে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা দ্রুত কমতে শুরু করে। উল্লেখ্য অরকিডেকটোমি করলে প্রস্টেট ক্যানসার সেরে যায় না। তবে এভাবে সার্জারি করা হলে এই ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে আসে এবং উপসর্গ কম তীব্র হয়।

বাইরে থেকে হরমোনের ওষুধ দিয়ে প্রস্টেটের হরমোনের মাত্রাকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনা হয়। তবে এখনো অবধি আমাদের দেশে এই চিকিৎসা বেশ ব্যয়সাধ্য। অনেক সময় সরকারি হাসপাতাল থেকেও এই ওষুধ দেওয়া হয়। এত কিছুর পরেও যদি ক্যানসার সেরে না যায়, তা হলে কেমোথেরাপি দিতে হয়।

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া

অনেকেই আশঙ্কায় ভোগেন যে এত রকম পদ্ধতির সাহায্যে চিকিৎসা করলে শরীরে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন আর আগের মতন তীব্র পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয় না। 

ভয় নয়, চিকিৎসা বিজ্ঞানে আস্থা থাকুক। গোড়ার দিকে প্রস্টেট ক্যানসার ধরা পড়লে পুরো সেরে যায়। তবে দেরিতে ধরা পড়লেও এই রোগকে রুখে দেওয়া যায়। প্রস্টেট ক্যানসার অনেক দূর ছড়িয়ে পড়লেও সাধারণত ঘাতক রূপ ধারণ করে না। উপযুক্ত চিকিৎসা, মনের জোর ও কাছের লোকেদের সহায়তা পেলে প্রস্টেট ক্যানসার নিয়েও রোগী বছরের পর বছর বেঁচে থাকতে পারেন।

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago