‘স্ট্রোক’ শব্দটির সঙ্গে আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত। মস্তিষ্কের কিছু অংশের রক্ত সরবরাহ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা এবং কাজ করা বন্ধ করে দেওয়া হল স্ট্রোকের মুল কারন। আসুন আলোচনা করা যাক এই স্ট্রোক এর লক্ষণ, কারণ এবং চিকিৎসা সম্পর্কে।

স্ট্রোক কি?

মস্তিষ্কের রক্তবাহী নালিকা কোনও কারণে ফেটে গেলে রক্তক্ষরণ হয় এবং সেই রক্ত জমাট বেঁধে যখন রক্তনালিকার গতিপথ অবরুদ্ধ হয় তখন তাকে স্ট্রোক বলে। রক্তবাহী নালিগুলি অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে মস্তিষ্কের কোষগুলিতে অক্সিজেনের পৌঁছাতে পারে না ফলে ক্রমে ক্রমে ওই কোষগুলির মৃত্যু ঘটে। চিকিৎসায় দেরি হলে ব্রেইন ডেথ পর্যন্ত হতে পারে।

স্ট্রোক এর লক্ষণগুলি কি ?

ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশে যত মৃত্যু হয় তার অন্যতম একটি কারণ হল স্ট্রোক। স্ট্রোক শুধু মৃত্যুরই কারণ নয়, বহু মানুষের পঙ্গুত্বেরও কারণও হল এই স্ট্রোক। যদি আগে থেকেই স্ট্রোক এর লক্ষণগুলি বুঝতে অনুধাবন করা যায় তাহলে বহু মানুষকেই এই বিপদের হাত থেকে উদ্ধার করা সম্ভব। নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি দেখলে দ্রুত নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

  • প্যরালিসিস
  • যে কোনও একপাশের হাত, পা কিম্বা মুখে অসাড়তা
  • মুখ বেঁকে যাওয়া / কথা জড়িয়ে যাওয়া
  • চোখে অন্ধকার দেখা অথবা অস্বচ্ছ দৃষ্টি
  • হাটতে গেলে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা
  • মাথা ঘোরানো
  • বমি

চিকিৎসায় দেরি হলে এর ফল আরও ভয়ানক হতে পারে, যেমন-

  • ব্রেইন ড্যামেজ
  • দীর্ঘকালীন পঙ্গুত্ব
  • মৃত্যু

স্ট্রোক কত প্রকার?

ইস্কিমিক স্ট্রোক

মস্তিষ্কের রক্তবাহী নালীর মধ্যে রক্তের ডেলা (ক্লট) জমে রক্তের প্রবাহ বাধা পায় যার ফলে এই স্ট্রোক হয়ে থাকে। এটি দুই ধরণের-Thrombotic Stroke বা Cerebral Thrombosis এবং Embolic Stroke বা Cerebral Embolism

হেমারেজিক স্ট্রোক

 মস্তিষ্কের দুর্বল রক্তবাহী নালী রক্ত চাপে ছিঁড়ে গিয়ে রক্তক্ষরণ ঘটলে এই স্ট্রোক হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হেমারেজিক স্ট্রোকের জন্য দায়ী অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ। এটি দুই ধরণের-  Aneurysms এবং Arteriovenous Malformations (AVMs) ।

 ট্র্যান্সিয়েন্ট  ইস্কিমিক স্ট্রোক (T I S)

মস্তিষ্কে সৃষ্ট ক্ষণস্থায়ী ক্লটের প্রভাবে এটি হয় এবং এর ফলে অল্প সময়ের জন্য হাত-পা দুর্বল হয়ে যায় আবার ঠিকও হয়ে যায়। তাই একে Mini Stroke বলা হয়।

স্ট্রোকের কারণ কি বা কাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশী ?

ডায়েট

অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস স্ট্রোকের অন্যতম কারণ। দেখা গেছে যারা লবণ, ফ্যাট জাতীয় খাবার, চর্বিযুক্ত মাংস বেশী পরিমাণে গ্রহণ করেন তাদের স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী থাকে।

কায়িক শ্রমে অনীহা

যারা সারাক্ষণ বসে কাজ করেন, যাদের কায়িকশ্রমে তীব্র অনীহা বা শারীরিক ব্যায়ামে একেবারেই করেন না তাদের স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি ক্রমেই বাড়তে থাকে।

মদ্যপান ও তামাকের ব্যবহার

যারা মদ্যপান এবং তামাক সেবনে অভ্যস্ত তাদের রক্তচাপ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশী হয় এবং মদ্যপানের কারণে রক্তে বাড়তে থাকা (ট্রাইগ্লিসারাইড) triglyceride স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে দেয়।

স্থূলতা

স্থূলতা বা ওবেসিটি বহু সমস্যার কারণ। স্ট্রোক তার মধ্যে একটি।

বয়স এবং লিঙ্গ

বয়স বেশী হলে স্ট্রোকের ঝুঁকি তো থাকেই তারপর আপনি যদি পুরুষ হন তাহলে ঝুঁকির পরিমাণ আরও বেশী। দেখা গেছে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পরিমাণ মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের অনেক বেশী।

পারিবারিক ইতিহাস

পরিবারের কারও স্ট্রোকের ইতিহাস থাকলে তাদের স্ট্রোকের আশঙ্কা থাকে।

স্ট্রোকের শনাক্তকরণ কি ভাবে করা হয়?

সাধারণত এম আর আই, সিটি স্ক্যান এবং সিটি অ্যান্জিওগ্রামের মাধ্যমে স্ট্রোকের অবস্থান ও পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। এছাড়াও প্রয়োজন মনে করলে আপনার চিকিৎসক রক্তে সুগারের পরিমাণ, প্লেটলেট এবং রক্ত তঞ্চনের পরীক্ষার কথাও বলতে পারেন।

স্ট্রোকের চিকিৎসা

কতক্ষণ আগে রোগীর স্ট্রোক হয়েছে এবং তার শারীরিক অবস্থার ওপরে ভিত্তি করে স্ট্রোকের চিকিৎসা করা হয়। স্ট্রোক হওয়ার তিন থেকে চার ঘন্টার মধ্যে রোগীকে IVtA injection দিলে তাড়াতাড়ি সুস্থ  হওয়ার সম্ভাবনা।

.ক্লট বড় হলে স্ট্রোক হওয়ার ৮ ঘন্টার মধ্যে সার্জারি করলে আশাপ্রদ ফল পাওয়া যায়।

স্ট্রোকের কারণে যদি প্যরালিসিস কিম্বা কথা বলতে গেলে জিভ জড়িয়ে গেলে দীর্ঘকালীন চিকিৎসার পাশাপাশি স্পিচ থেরাপি এবং ফিজিক্যাল থেরাপিরও প্রয়োজন পড়ে।  

ব্রেন স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায়
  • ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করুন।
  • ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
  • রক্তে কোলেস্টেরল এবং সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
  • নিয়মিত ব্রিস্ক ওয়াক অথবা শরীরচর্চা অভ্যেস করুন।
  • পরিবারে কারও স্ট্রোকের ইতিহাস থাকলে নির্দিষ্ট বয়সের পরে নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন
  • সঠিক ডায়েট অনুসরণ করুন
  • রক্তচাপ নিয়ত্রনে রাখার ওষুধ নিলে বন্ধ করবেন না

যদি আপনি কখনও বুঝতে পারেন কেউ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছে তাহলে তাকে দ্রুত নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যান কারণ স্ট্রোকের চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রথম ১ঘন্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যে কারণে এই সমটাকে Golden Hour ও বলা হয়।

Dhruba Biswas

Hi, I am Dhruba and I’m a Health Blogger. My goal is to make everyone aware of physical and mental health as well as new methods and technologies in the field of medical science.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago