পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম (পিসিওস)- লক্ষণ, কারণ ও চিকিৎসা

Published by

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম (পিসিওএস) এমন একটি শারীরিক অবস্থা যা শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতার জন্য সৃষ্টি হয়। যেখানে স্ত্রী হরমোন স্তর প্রভাবিত হয় এবং স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিমাণে পুরুষ হরমোন উৎপাদিত হয়। অর্থাৎ ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরণ মাত্রা কমে যায় এবং এর ফলে নিয়মিত রজঃচক্রে পরিবর্তন আসে এবং অনেক ক্ষেত্রেই সৃষ্টি হয় বন্ধ্যাত্বের মতো সমস্যা৷

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম (পিসিওএস) কি?

হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে এই সমস্যা হয়। ওভুলেশন পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট সময় অন্তর জরায়ুর ডিম্বথলি থেকে ডিম্বাণু নিঃসৃত হয়। ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন (FSH) আর লিউটিনাইজিং হরমোন (LH) ডিম্বাণুর এই নিঃসরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। পিসিওএস-এ  (Polycystic Ovarian Syndrome) ডিম্বথলির সংখ্যা জরায়ুতে বাড়তে থাকে, কিন্তু তা থেকে ডিম্বাণু নিঃসরণ হয় না। এর ফলে অনিয়মিত পিরিয়ড বা পিরিয়ড না হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

ডিম্বাণু নিঃসরণ না হওয়ায় নারী শরীরে অ্যান্ড্রোজেন নামক হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায়। এবং কমে যায় ইস্ট্রোজেন আর প্রোজেস্টেরন  হরমোনের ক্ষরণ। বাড়তে থাকে টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা।  সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ডিম্বথলিগুলোই জরায়ুতে সিস্ট তৈরি করে। একাধিক সিস্ট তৈরি হয় বলে এই রোগের এমন নামকরণ।

নারীর মেনস্ট্রুয়াল এজ অর্থাৎ মোটামুটি ১২ থেকে ৫০ বছর বয়সের (অনেকের ক্ষেত্রেই বয়সের ব্যতিক্রম দেখা যায়) মধ্যে এই রোগ দেখা দিতে পারে।

পিসিওএস এর প্রধান সমস্যা “সিস্ট” নয়, বরং হরমোনের সমস্যার কারণে ” সিস্ট ” তৈরী হয়।

কোনো মহিলা পিসিওএস-এ আক্রান্ত কিভাবে বোঝা যায়?

নিচের যে কোন দুটি থাকলে পিসিওএস হয়েছে বলে মনে করা হয় :

১. অনিয়মিত অথবা একদমই পিরিয়ড না হওয়া

২. মুখের বা শরীরের চুল বৃদ্ধি অথবা রক্তে অতিরিক্ত মাত্রায় টেস্টোস্টেরন বৃদ্ধি পাওয়া।

৩. আল্ট্রাসাউন্ডে পলিসিস্টিক ওভারি থাকা।

অতএব, যদি ইউএসজি রিপোর্টে পিসিও থাকে কিন্তু যদি আপনার অনিয়মিত পিরিয়ড না হয়  এবং আপনার অত্যধিক লোম বৃদ্ধি না হয়, তবে আপনার পিসিওএস নেই। আপনার কেবল পলিসিস্টিক ওভারি রয়েছে।

বর্তমানে ভারতবর্ষে ২০% মহিলা পিসিওএসে আক্রান্ত ৷ এবং তার মধ্যে ১২% টিনএজার।

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম-এর লক্ষণগুলি কি কি?

সাধারণত যে লক্ষণ গুলি দেখা যায়ঃ

(১) অনিয়মিত পিরিয়ড

(২) পিরিয়ডে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ

(৩) মুখ এবং দেহে অতিরিক্ত চুল বৃদ্ধি বা হিরসুটিজম

(৪) ত্বকে ব্রণ হওয়া

(৫) অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি

(৬) মাথায় চুল পড়ে যাওয়া বা অ্যালোপেশিয়া

(৭) ত্বকের কালচে ভাব

(৮) হরমোনের পরিবর্তনের জন্য প্রায়শই  মাথাব্যথা হওয়া৷

৯) মানসিক অবসাদ

১০) স্লিপ অ্যাপনিয়া

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম- এর কারণ

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোমের পিছনে মুলত তিনটি কারনই দেখা যায়ঃ

  • চিকিৎসাশাস্ত্রে পিসিওএস-এর কারণ নিয়ে নানা মত রয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, নারী শরীরে থাকা পুরুষ হরমোনের অত্যাধিক ক্ষরণই নারী হরমোনগুলোকে তাদের কাজে বাধা দেয়। যার ফলে পিসিওএস-এর সমস্যা হয়।
  • গবেষণায় দেখা গিয়েছে, পরিবারের অন্য কারও(বিশেষত মায়ের) পিসিওএস থাকলে মেয়ের মধ্যে সেই একই রোগ দেখা দিতে পারে, অর্থাৎ জেনেটিক ডিজিজ। তবে কোনও একটা জিন নয়, বরং একাধিক জিন এর পিছনে দায়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • ইনসুলিনের উৎপাদনে হেরফেরের (Insulin Resistance) কারণেও দেখা দিতে পারে পিসিওএস। যদি ইনসুলিন উৎপাদনের গ্ৰন্থি অর্থাৎ প্যাংক্রিয়াসের উপর চাপ পড়ে, এর ফলে হঠাৎ করে ইনসুলিনের উৎপাদন অনেকটা বেড়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইনসুলিন উৎপাদনে এই বৃদ্ধি বাড়িয়ে দেয় পুরুষ হরমোনের ক্ষরণ। তাই ইনসুলিনের তারতম্য পিসিওএস-এর একটি কারণ হতে পারে‌।
কিভাবে পিসিওএস নির্ণয় করা হয়?

ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর তিনি আক্রান্ত মহিলার মেডিকেল হিস্ট্রি জানতে চাইবেন, এবং ওজন, বিএমআই, মাসিক চক্র, খাদ্য, এবং ব্যায়াম ইত্যাদির মতো তথ্য তালিকা পর্যালোচনা করবেন। পারিবারিক ইতিহাস, বিশেষত হরমোনজনিত সমস্যা এবং ডায়াবেটিস সংক্রান্ত তথ্য জানতে চাইবেন।

একটি পেলভিক পরীক্ষা বা পিসিওএস আল্ট্রাসাউন্ড, ওভারির কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কিনা দেখার জন্য করা হতে পারে। যদি সিস্ট এবং বেড়ে যাওয়া ডিম্বাশয়ের মতো পিসিওএস–এর লক্ষণগুলি উপস্থিত থাকে, সেগুলি পরীক্ষাতে প্রকাশ পায়।

এর বাইরে ডাক্তার টেস্টোস্টেরন, প্রোল্যাক্টিন, ট্রাইগ্লিসারাইডস, কোলেস্টেরল, থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন (TSH), ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন (FSH),  লিউটিনাইজিং হরমোন ( LH) এবং ইনসুলিনের মাত্রা সহ অন্যান্য পরীক্ষা করার জন্য রক্ত পরীক্ষা করতে বলবেন।

এছাড়াও লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা, রক্তে গ্লুকোজ মাত্রা পরীক্ষা, এবং থাইরয়েড ফাংশন পরীক্ষা; পিসিওএস নির্ণয়ের জন্য মূলত এই পরীক্ষাগুলিরই প্রয়োজন হয়।

পিসিওএস এর চিকিৎসা পদ্ধতি কি?

পিসিওএসের নির্দিষ্ট কোন প্রতিকার নেই, তবে এটি ওজন হ্রাস, স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম এবং ওষুধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হতে পারে।

ওজন হ্রাস

পিসিওএস থেকে মুক্তি পাওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায়টি হলো ওজন কমানো এবং বডি মেটাবলিজম ঠিক রাখা৷ এর জন্য প্রয়োজন সঠিক ডায়েট এবং নিয়মিত শরীর চর্চা।

ডায়েট

পিসিওএস নিয়ন্ত্রণে লো-কার্বযুক্ত খাবারকেই (যেমন- ফল, সবুজ শাক-সবজি, গোটা শস্য) ডায়েট হিসেবে বেছে নিতে পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।

ফাস্টফুড জাতীয় খাবার এই সমস্যায় আক্রান্ত মহিলাদের জন্য মোটেই ভালো নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, পিসিওএস-এ আক্রান্তদের ক্ষেত্রে ওজন বেড়ে যাওয়ার এক স্বাভাবিক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, যা সঠিক সময়ে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। ওজন বৃদ্ধির ফলে পিসিওএস-এর সমস্যা তুলনায় বাড়তে থাকে। তাছাড়া কার্ডিওভাসকুলার রোগের প্রবণতাও বাড়ে। এর পাশাপাশি ডায়েটে থাকা কিছু ভিটামিন ও সাপ্লিমেন্ট, যা হরমোনের মাত্রা ঠিক রাখতে সাহায্য করে। ভিটামিন ই, ফ্ল্যাক্সসিড, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন বি ইত্যাদি।

শরীরচর্চা

নিয়মিত শরীরচর্চা যেমন ওজনকে নিয়ন্ত্রণে রাখে, তেমনই ওভুলেশন পদ্ধতিতেও সাহায্য করে। পাশাপাশি ইনসুলিনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতেও ব্যায়াম অনেক বেশ কার্যকরী। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট বাড়িতেই ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ বা যোগাসন ক্রমে  পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোমের প্রকোপ থেকে মুক্তি দেয়। ডাক্তাররা পরামর্শ দেন  বিএমআই ২৫-এর নীচে নিয়ে আসতে পারলে ওভারিয়ান সিস্টের সমস্যা থেকে অনেকটাই মুক্তি মেলে।

ওষুধের ব্যবহার

জন্মনিয়ন্ত্রক ওষুধ

এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে এবং পিরিয়ড নিয়মিত রাখতে অনেক চিকিৎসক জন্মনিয়ন্ত্রক ট্যাবলেট  খাওয়ার পরামর্শ দেন। এটি ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের ক্ষরণ বাড়াতে সাহায্য করে। দুই হরমোনের ক্ষরণই অ্যান্ড্রোজেনের ক্ষরণ কমিয়ে ডিম্বাণু নিঃসরণে সাহায্য করে।

মেটফরমিন

এই জাতীয় ওষুধ সাধারণত টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। পিসিওএস এর ক্ষেত্রে মেটফরমিন (Glucophage, Fortamet) শরীরে ইনসুলিনের মাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

হেয়ার রিমুভাল ট্রিটমেন্ট

পিসিওএস এর ক্ষেত্রে একটি মূল সমস্যা হলো মুখ সহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে অবাঞ্ছিত পশম বা লোমের বৃদ্ধি। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে Eflornithine (Vaniqa) ক্রিমটি ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও লেসার পদ্ধতিতে শরীরের অবাঞ্ছিত লোম দূর করা হয়।

সার্জারি

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালে বাড়তে পারে সিস্টের সংখ্যা। অত্যাধিক সিস্ট সৃষ্টি করে বন্ধ্যাত্বের মতো সমস্যার। সেক্ষেত্রে মেডিকেশনের বদলে চিকিৎসকরা বেছে নেন সার্জারির পথ। ল্যাপারোস্কপি সার্জারির মাধ্যমে জরায়ু থেকে সিস্টটিকে অপসারণ করা হয়।

একটি বিষয় সবসময় মনে রাখা দরকার, তা হলো পিসিওএসের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে ওষুধের থেকেও অনেক বেশি কার্যকরী সংযত জীবনযাত্রা। সঠিক ডায়েট, নিয়মিত শরীরচর্চা, পর্যাপ্ত ঘুম এবং মনকে ভালো রাখা, এর ফলেই মেলে রোগমুক্তি।

Srikona Sarkar

As a Student of Science, I found the subject of both mental and physical wellness quite intriguing in my school days, Which was further sharpened with the completion of Graduation in Molecular Biology in my College. As The whole world, right now is battling with the greatest pandemic of human civilization, I cannot help myself from helping out people by providing the exact solution for their mental and physical profoundness so that, they can always discover a new tunnel of hope and light, even when their movement is restricted within the boundary of the walls.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago