এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

Published by

প্রেগন্যান্সি শুরু হয় একটি নিষিক্ত ডিম্বাণু দিয়ে। সাধারণভাবে একটি নিষিক্ত ডিম্বাণু ইউটেরাসের দেওয়ালে আটকে যায়। মুশকিল হল এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে একটি নিষিক্ত ডিম্বাণু ইউটেরাসের প্রধান গহ্বরের বাইরে প্রতিস্থাপিত হয় ও সেখানেই বেড়ে ওঠে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ফ্যালোপিয়ান টিউবের অন্দরে ঘটে যায় এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি। মনে রাখতে হবে ফ্যালোপিয়ান টিউবই কিন্তু ওভারি থেকে ইউটেরাসে নিষিক্ত ডিমকে নিয়ে যায়। ফ্যালোপিয়ান টিউবের অন্দরে তৈরি হওয়া এই ধরনের এক্টোপিক প্রেগন্যান্সিকে বলে টিউবাল প্রেগন্যান্সি। অবশ্য ফ্যালোপিয়ান টিউব ছাড়াও শরীরের অন্যান্য অংশেও এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে ওভারি, অ্যাবডোমিনাল ক্যাভিটি বা পেটের খালি অংশ, ইউটেরাসের নীচের অংশ বা সারভিক্সেও (এই অংশটি ইউটেরাসের সঙ্গে ভ্যাজাইনার যোগাযোগ রক্ষা করে।) এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি হতে দেখা যেতে পারে।

এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি কখনওই সফল প্রেগন্যান্সি হতে পারে না। কারণ নিষিক্ত ডিম কখনওই বাঁচতে পারে না। নিষিক্ত ডিম ক্রমশ কোষ বিভাজনের মাধ্যমে বড় হয়ে ওঠে। ফ্যালোপিয়ানের টিউবের আকার ইউটেরাসের চাইতে অনেক ছোট বা ফ্যালোপিয়ান টিউব ইউটেরাসের মতো বড় হতেও পারে না। এর ফলে নিষিক্ত ও বর্ধিত ডিম্বাণু একসময় এতটাই বড় হয়ে যায় যে তা ফ্যালোপিয়ান টিউবের উপর বিরাট চাপ প্রয়োগ করে। ফ্যালোপিয়ান টিউব ফেটে যায়। রক্তপাতের ফলে রোগিণীর প্রাণহানি ঘটে।

এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির লক্ষণ

সমস্যার বিষয় হল, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে কোনও লক্ষণ থাকে না। আরও মুশকিল হল, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এক্টোপিক প্রেগন্যান্সিতে মহিলাদের স্বাভাবিক প্রেগন্যান্সির মতোই লক্ষণ দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে পিরিয়ড বন্ধ হওয়া, ব্রেস্ট –এ টান টান ভাব ও বমি বমি ভাবের কথা বলা যায়।

এমনকী প্রেগন্যান্সি টেস্ট করালেও তা পজিটিভ রেজাল্ট দেখাতে পারে। তারপরেও এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি কখনওই স্বাভাবিক প্রেগন্যান্সি নয় ও তা চালিয়ে যাওয়া যায় না।

প্রাথমিকভাবে তাই কেউ এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি সন্দেহও করেন না। এই সুযোগে ফ্যালোপিয়ান টিউবের অন্দরে ডিম্বাণু বেড়ে ওঠে ও একসময় ফেটে যায়। তাই প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ আসলেও কতকগুলি উপসর্গের দিকে অবশ্যই নজর দেওয়া দরকার।

এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির বোঝার প্রাথমিক শর্ত
প্রথম উপসর্গই হল ভ্যাজাইনা পথে অল্প অল্প রক্তপাত। এর সঙ্গে পেলভিক অংশে ব্যথা হতে পারে।

ফ্যালোপিয়ান টিউব থেকে রক্তপাত হতে থাকলে আরও কিছু উপসর্গ শরীরে দেখা যেতে পারে যেমন— ঘাড়ে ব্যথা। পায়খানা আটকে রাখতে না পারা ইত্যাদি। উপসর্গ নির্ভর করে ঠিক কোথায় ব্লাড জমা হয়েছে তার উপর। এছাড়া ঠিক কোন স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার উপরেও বেদনার উপসর্গ খানিকটা হলেও নির্ভর করে।

আপৎকালীন পরিস্থিতি চিনুন
ফ্যালোপিয়ান টিউবে নিষিক্ত ভ্রূণ বেড়ে উঠতে থাকলে, একসময় ফ্যালোপিয়ান টিউব র‌্যাপচার বা ফ্যালোপিয়ান টিউব ফেটে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা যেতে পারে। এর ফলে পেটের গহ্বরে রক্ত জমা হয়ে যায়। জীবন নিয়ে পড়ে যায় টানাটানি। এমতাবস্থায় রোগিণীর মাথা খুব ভারী হয়ে যেতে পারে। তিনি অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারেন। রোগিণী শকেও চলে যেতে পারেন।

কখন নেবেন চিকিৎসকের পরামর্শ
কিছু উপসর্গ রয়েছে যা দেখা দেওয়া মাত্র দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন বা হাসপাতালে ভর্তি হন—

  • প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট পজিটিভ এবং পেটে তীব্র ব্যথা শুরু হয়েছে। একইসঙ্গে ভ্যাজাইনা পথে রক্তপাত হচ্ছে।
  • মাথা এতটাই ভারী হয়ে আছে যে রোগিণী অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন বা জ্ঞান হারিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
  • কাঁধে অসহ্য ব্যথা।
  • ব্লাড প্রেশার খুব কমে গেলে।

এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির কারণগুলি

এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির মধ্যে সবচাইতে পরিচিত সমস্যা হল টিউবাল প্রেগন্যান্সি। ফ্যালোপিয়ান টিউবে ভ্রূণের বেড়ে ওঠার পিছনে মূল কারণ হল ফ্যালোপিয়ান টিউব দিয়ে ইউটেরাসে ডিম্বাণু পৌঁছানোর সময় কোনও একটা জায়গায় গিয়ে বাধা পাওয়া। অর্থাৎ নিষিক্ত ডিম আটকে যেতে পারে যদি ফ্যালোপিয়ান টিউব আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে বা ফ্যালোপিয়ান টিউবের গঠনে কোনও সমস্যা থাকে। ফ্যালোপিয়ান টিউবের এমন সমস্যার পিছনে দায়ী থাকতে পারে হরমোনাল ইমব্যালেন্স, সংক্রমণ ইত্যাদি। জন্মগত সমস্যাও থাকতে পারে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। আবার নিষিক্ত ডিম্বাণুর অস্বাভাবিকত্বও হতে পারে কারণ।

কাদের ঝুঁকি বেশি?

  • একাধিক যৌনসঙ্গী থাকলে বাড়তে পারে এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির সমস্যা। কারণ নানা ধরনের যৌন সংক্রমণ ঘটার আশঙ্কা থাকে একাধিক যৌন সঙ্গী থাকলে।
  • বিশেষ করে অনিরাপদ যৌনমিলনের কারণেও ঘটতে পারে এমন সমস্যা। তাই যৌনমিলনের সময় অবশ্যই নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখুন।
  • ধূমপান করবেন না। ধূমপানের অভ্যেস থাকলে প্রেগন্যান্সির আগে তা ত্যাগ করুন।
  • মদ্যপানের অভ্যেসও ছাড়তে হবে।

রোগ নির্ণায়ক পরীক্ষা

প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ এলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

এক্ষেত্রে রক্তের হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন হর্মোনের (এইচসিজি) মাত্রা নির্ধারণের প্রয়োজন। সাধারণত প্রেগন্যান্সি এলে রক্তে এইচসিজি-এর মাত্রা বেড়ে যায়। রক্তে এইচসিজি-এর মাত্রা খুব কম থাকলে চিকিৎসক এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি সন্দেহ করতে পারেন।

এছাড়া আলট্রাসাউন্ড টেস্ট করাতেও দিতে পারেন চিকিৎসক। আলট্রাসাউন্ডে শরীরের অন্দরের ছবি খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। ফলে কোথায় নিষিক্ত ডিম্বাণু বেড়ে উঠছে তাও ভালোভাবে দেখা যায়। সাধারণত ফার্স্ট ট্রাইমেস্টার বা ১২ সপ্তাহের মধ্যেই এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি ধরা পড়ে।

এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির চিকিৎসা

মেথোট্রেক্সেট দিয়ে এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির চিকিৎসা করা যায়। তবে তার জন্য ফলোআপ চিকিৎসারও প্রয়োজন রয়েছে। তাই দরকার পড়লে ল্যাপারোস্কোপির সাহায্যে এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির সমস্যার নিরাময় করতে হয়।

Dhruba Biswas

Hi, I am Dhruba and I’m a Health Blogger. My goal is to make everyone aware of physical and mental health as well as new methods and technologies in the field of medical science.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

5 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

5 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

5 months ago