টিনিটাস কি? এই রোগের কারণ ও মুক্তির উপায়

Published by

টিনিটাস কি? কেন হয় এই রোগ?মুক্তির উপায়ও বা কি?নিম্নে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।

টিনিটাস কি?

কোন বাহ্যিক উৎস ছাড়াই একটি বা দুটি কানে অস্বাভাবিক ভোঁ-ভোঁ শব্দ অথবা  গুঞ্জনের আওয়াজ হওয়ার ঘটনাকে ডাক্তারি পরিভাষায় টিনিটাস বলা হয়।এটি হতে পারে গর্জনের মত শব্দ,বা টিকটিক অথবা হিসহিস শব্দ। মৃদু অথবা জোরালো শব্দও হতে পারে। তবে, টিনিটাস কোনো রোগের প্রকার নয়।

টিনিটাসের কারণ কী?

টিনিটাস সাধারণত বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখতে পাওয়া যায়, এবং এটি পুরুষ ও মহিলা উভয়কেই আক্রান্ত করতে পারে। টিনিটাসের একাধিক কারণ থাকতে পারে:

  • কানে সংক্রমণ।
  • সাইনাসে সংক্রমণ।
  • হরমোনের পরিবর্তন।
  • থাইরয়েড হরমোনের অস্বাভাবিক মাত্রা।
  • কানে আঘাত।
  • অবসাদ
  • ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
  • খোল জমে কান বন্ধ হয়ে যাওয়া।

বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে, টিনিটাস শ্রবণশক্তি হারানোর প্রথম লক্ষণ হিসাবে দেখা দিতে পারে। যে সব ব্যক্তিরা কোলাহল পূর্ণ পরিবেশে কাজ করেন, যেমন কলকারখানা। যারা নিয়মিত গান বাজনার বা এইরূপ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন; অল্প সময়ের জন্য টিনিটাসে ভুগতে পারেন অথবা অতিরিক্ত শব্দের ফলে শ্রবণ ক্ষমতার হ্রাস পাওয়ার সমস্যায় দীর্ঘস্থায়ী উপসর্গে ভুগতে পারেন।

টিনিটাস বিষণ্ণতা এবং অন্যান্য মানসিক অসুস্থতার উপসর্গরূপেও দেখা দিতে পারে।

অত্যন্ত সাধারণ এই সমস্যাটি কখনো কখনো কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই হতে পারে।

কি ভাবে নির্ণয় করা হয় টিনিটাস?

সমস্যার উৎস যদি অস্পষ্ট থাকে, তবে আপনাকে শ্রুতি ও স্নায়ু পরীক্ষার জন্য কোনও অটোলজিস্ট বা অটোলারিঞ্জোলজিস্ট (উভয়ই কানের বিশেষজ্ঞ) বা একজন অডিওলজিস্ট- এর কাছে যেতে পারেন। এই পরীক্ষায় একটি শ্রবণ পরীক্ষা নেওয়া হয় সাধারণত যাকে অডিওগ্রাম বলে । এমআরআই বা সিটিস্ক্যান বা এই জাতীয় কোনও পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন ডাক্তাররা।

টিনিটাসের চিকিৎসা ও মুক্তির উপায়

যদি আপনার টিনিটাস শরীরের অন্তর্নিহিত কোনো সমস্যার উপসর্গরূপে দেখাযায় তাহলে প্রথমেই মুক্তির উপায় হিসেবে রোগের চিকিৎসা করাতে হবে। তবে চিকিৎসার পরেও যদি টিনিটাসটি থেকে যায়, বা যদি এটি উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে আসে তবে ডাক্তাররা বিভিন্ন বিকল্প কোনো পদ্ধতির পরামর্শ দেন এবং সেগুলিকে নন-মেডিকেল পদ্ধতি বলেই গণ্য করা হয়; যা অবাঞ্ছিত শব্দকে কমাতে সহায়তা করে। কখনও কখনও টিনিটাস কোনও চিকিৎসা ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে চলে যায়। তবে এটি বোঝা উচিত যে কোনো টিনিটাসই সম্পূর্ণরূপে নির্মূল বা হ্রাস করা যায় না, সে যে কারণেই হোক ৷

টিনিটাসের সমস্যা যদি বাড়তে থাকে বা এই নিয়ে যদি কোনোরূপ সমস্যা হয় তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

যদি আপনার টিনিটাসের কারণ অতিরিক্ত পরিমাণে কানে খোলজমা হয়, সেক্ষেত্রে ডাক্তাররা কিউরেট নামক একটি ছোট বাঁকানো যন্ত্র দিয়ে কান পরিষ্কার করে দেবেন, বা হালকা গরম জল দিয়ে সাবধানতার সাথে তা বাইরে বের করে দেবেন।কানে যদি সংক্রমণ হয় তবে সেই সংক্রমণ কমানোর জন্য অ্যান্টিবায়োটিক এবং ইচিং বা চুলকানো থেকে মুক্তি পেতে হাইড্রোকর্টিসোন যুক্ত কানের ড্রপ দেওয়া হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।

টিউমার, সিস্ট বা অটোস্ক্লেরোসিস (কানের হাড়ে ক্যালসিয়াম জমা হওয়া) এর ক্ষেত্রে সার্জারি করা প্রয়োজন।যদিও এটি বিরলতম ঘটনা৷

যদি টিনিটাসটি টেম্পোরোম্যান্ডিবুলার জয়েন্টসিন্ড্রোমের কারণে হয় (যাকে কখনও কখনও TMJ ও বলা হয়) সেক্ষেত্রে আক্রান্তরোগীকে কোনো অর্থোডনিস্ট বা কোনো ডেন্টাল বিশেষজ্ঞের থেকে পরামর্শ নেওয়ার জন্য বলা হয়।

টিনিটাসেরঔষধ

টিনিটাসের চিকিৎসার জন্য অনেকগুলি ওষুধ নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে।কারও কারও ক্ষেত্রে , অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি ওষুধের সর্ব নিম্নডোজ দেওয়াহয়।যেমনঃ- Valium অথবাঅ্যান্টি- ডিপ্রেস্যান্টসযেমনঃ- Elavil, এগুলি টিনিটাস হ্রাস করতে সহায়তা করে।

এছাড়াও মধ্যকর্ণে একটি স্টেরয়েড ব্যবহারের সাথে একটি অ্যান্টি-অ্যাংজাইটিদেওয়াহয়,যেমনঃ- Alprazolam. অনেকের ক্ষেত্রেই এই ওষুধ কার্যকরী হয়েছে বলে ডাক্তাররা মনে করেন।

Misoprostol নামক একটি হরমোন টিনিটাসের চিকিৎসায় বেশকিছু ক্ষেত্রে সহায়ক হয়।

কয়েক প্রকার অস্বাভাবিক হৃদ-কম্পনের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত Lidocaine নামক ওষুধটি বেশ কিছু লোকের জন্য টিনিটাস উপশম করতে সাহায্য করেছে।তবে কার্যকর হওয়ার জন্য অবশ্যই এই মধ্যকর্ণে প্রয়োগ করতে হবে।তবে অনেক ক্ষেত্রেই এই ওষুধটি ব্যবহারে কিছু ঝুঁকি থেকে যায়, যার জন্য ডাক্তাররা সাধারণত এই ওষুধটি টিনিটাস থেকে মুক্তির জন্যব্যবহার করার পরামর্শ দেন না।

হিয়ারিং এইড বা কানে শোনার যন্ত্র

টিনিটাসের সাথে সাথে যদি শ্রবণ শক্তিও হ্রাস পায় তবে হিয়ারিং এইড অন্যতম সহায়ক।

টিনিটাস রিট্রেইনিং থেরাপি (টিআরটি)

টিআরটি মস্তিষ্কের একটি সংকেতকে অভ্যাসগত করার প্রাকৃতিক সক্ষমতার উপর নির্ভর করে, এক্ষেত্রে একটি অবচেতন স্তরে ছড়িয়ে দেওয়া যাতে সচেতন ধারণাটি না পৌঁছায়। অভ্যাস বা ‘হ্যাবিচুয়েশন’ এর ক্ষেত্রে কোনো সচেতন প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয় না।এগুলির মধ্যে রোগীরা প্রায়শই প্রচুর শ্রবণীয় শব্দের অভ্যাস করে – এয়ার কন্ডিশনার, কম্পিউটারের ফ্যান, রেফ্রিজারেটর এবং রিমঝিম বৃষ্টি, সেগুলির মধ্যে অন্যতম।

টিআরটি-র দুটি অংশ রয়েছে:

১. টিনিটাস যুক্ত ব্যক্তি যেখানেই যাবেন কোনো নিউট্রাল শব্দ তার আশে পাশে বাজানোর ব্যবস্থা করা।

২. টিনিটাস যুক্ত ব্যক্তিকে পরপর কাউন্সেলিং করানো।

এই পদ্ধতিতে টিনিটাসের চিকিৎসা করলে সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে ১২ থেকে ২৪ মাস অব্ধি সময় লাগে। অভিজ্ঞ হাতে চিকিৎসা হলে এই পদ্ধতিতে টিনিটাসের চিকিৎসা অত্যন্ত সফল হয়।

কগনিটিভ থেরাপি

এটি কাউন্সেলিংয়ের একটি রূপ যা টিনিটাসে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তিকে তাদের প্রতিক্রিয়া সংশোধন করতে সহায়তা করে।

এটি একটি রিল্যাক্সেশন পদ্ধতি যা আক্রান্ত ব্যক্তিদের টিনিটাসের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া পরিবর্তন করে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টে সহায়তা করে।

দাঁতের চিকিৎসা

কিছু বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা মনে করেন যে টিনিটাসটি টেম্পোরোম্যান্ডিবুলার জয়েন্ট (টিএমজে) এর সমস্যার কারণে সৃষ্ট হতে পারে, যেখানে চোয়ালের হাড় মাথার সাথে সংযুক্ত থাকে, এবং তাকানের সামনে। তাই তারা পরামর্শ দেন যে দাঁতের চিকিৎসা টিনিটাসের লক্ষণগুলি থেকে মুক্তি দিতে পারে, কারণ চোয়ালের মাংসপেশি এবং নার্ভ,  কানের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে সংযুক্ত রয়েছে।

কোক্লিয়ার ইমপ্লান্ট্যাস

কানে লাগানোর জন্য ব্যবহৃত এইডিভাইসগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মাত্রায় বধিরতার চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। এর মাধ্যমে কানটি মস্তিষ্কে বৈদ্যুতিক সংকেত পাঠায়, এভাবেই ডিভাইসটি কাজ করে।তবে এই পদ্ধতিটি শুধুমাত্র টিনিটাসের জন্যই অবলম্বন করা হয়না, বরং এটি কেবল শ্রবণের সমস্যার জন্য ব্যবহৃত হয়।

আর কি উপায়ে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব?

যদিও টিনিটাসের চিকিৎসার জন্য কোনও ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট বা অন্য কোনো বিকল্প থেরাপি কার্যকরী প্রমাণিত হয়নি, তবে কেউ কেউ জিংকোবিলোবা অথবা জিংককিংবা ম্যাগনেসিয়ামের মতো খনিজগুলি ব্যবহার করেন।যদিও ব্যক্তি বিশেষে এবংই মিউনিটির পার্থক্যের জন্য এর ফলাফলও ভিন্ন হয়।

এছাড়াও আকুপাংচার , চুম্বক অথবা হিপ্নোসিস-এর মাধ্যমেও সুফল পেয়েছেন কেউকেউ।

তবে যেকোনো পদ্ধতি অবলম্বন করার আগে অতি অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

টিনিটাসকে প্রতিরোধ করা কীভাবে সম্ভব?

জোরে আওয়াজের সংস্পর্শে বেশিক্ষণ থাকলে, টিনিটাসের উপসর্গগুলি প্রকাশের ঝুঁকি বৃদ্ধিপায়, তাই শ্রবণের ক্ষেত্রে এই সুরক্ষা অবলম্বন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

যদি এমন উচ্চ আওয়াজের মধ্যে আপনি থাকেন যেখানে সাধারণ ভাবে কথা বলা না যায়, তাহলে অবশ্যই ওই স্থানত্যাগ করুন এবং প্রয়োজনে ইয়ারপ্লাগ ব্যবহার করুন।

Srikona Sarkar

As a Student of Science, I found the subject of both mental and physical wellness quite intriguing in my school days, Which was further sharpened with the completion of Graduation in Molecular Biology in my College. As The whole world, right now is battling with the greatest pandemic of human civilization, I cannot help myself from helping out people by providing the exact solution for their mental and physical profoundness so that, they can always discover a new tunnel of hope and light, even when their movement is restricted within the boundary of the walls.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago