শিশু নিগ্রহ – প্রতিরোধের আগে প্রয়োজন সচেতনতা

Published by

শিশু নিগ্রহ  একটি অত্যন্ত জঘন্যতম অপরাধ।দিনের পর দিন এই অপরাধ বেরেই চলেছে।এর প্রতিরোধ করা ভীষণ জরুরি কিন্তু তার আগে প্রয়োজন সচেতনতা ও শিশুর প্রতি খেয়াল রাখা।

মোনালিসার বয়স ১১ বছর। সদ্য ক্লাস সিক্স। স্বভাবে ভীষণ দুরন্ত, দিনভর ছুটোছুটিতে বাবা-মা রীতিমতো নাজেহাল। কিন্তু ইদানীং মোনালিসা বড্ড চুপচাপ, মনে হচ্ছে কোনো কারণে ভীষণ ভয় পাচ্ছে। রাতে জেগে থাকে ৷ ঘুমোলেও প্রায়ই চিৎকার করে উঠছে। সারাক্ষণ মাকে আঁকড়ে ধরে রাখছে, এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে মোনালিসার মা রিক্তার অফিস কার্যত বন্ধ ৷ খাওয়া-দাওয়াও প্রায় বন্ধ। কিন্তু কেন এমনটা হচ্ছে, বারবার জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর না পেয়ে বাবা-মা মনোবিদের সঙ্গে দেখা করলেন। চিকিৎসক জানালেন, কোনো কারণে মোনালিসা ভয় পেয়েছে। চলতে থাকে লাগাতার কাউন্সেলিং। মনোবিদের আশঙ্কা সত্যি করেই মোনালিসা একসময় জানায় যে তার নিজের কাকার শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় আদর করে প্রায়শই, যেটা ওর একদম ভালো লাগেনা ৷  বাবা-মা কেউ সহজে মানতেই চাইলেন না। কিন্তু যা সত্যি তা তো সত্যিই! এটাই তার আচমকা স্বভাবগত পরিবর্তনের কারণ।

অন্যদিকে শঙ্খ-র বয়স সবে সাত পেরলো , সে একজন অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু। ভালো করে কথা বলতেও পারেনা এখনও অব্ধি। তার মা-বাবা দুজনই চাকরি করেন। সকালে শঙ্খকে বিশেষ স্কুলে দিয়ে তাঁরা অফিসে যান। দুপুরে একজন আয়া ওকে স্কুল থেকে বাড়ি নিয়ে আসেন। বাবা ফেরেন বিকেলে, মায়ের ফিরতে রাত ৮-৯টা। ফিরে আসার পর থেকে পুরো সময়টাই তারা শঙ্খকে দেন। হঠাৎই কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে শঙ্খ ভীষণ খিটখিটে হয়ে উঠছে, আগের চেয়ে অনেক বেশি রাগ করছে, কখনো নিজেকে আঘাত করছে, কখনো মা-বাবাকে আঘাত করার চেষ্টা করছে। বাধ্য হয়েই মা-বাবা তাকে নিয়ে মনোবিদের কাছে গেলেন। মনোবিদ সময় নিয়ে শঙ্খ কে পরীক্ষা করে তার গায়ে বেশ কিছু শারীরিক আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেলেন ৷ পরে আয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, শঙ্খ  দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে বিরক্ত করে বলেই তিনি মাঝেমধ্যে তাকে লাঠি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করতেন, বাদ যায়নি শরীরের গোপনাঙ্গও। সেখান থেকেই শঙ্খ-র আচরণে এমন অদ্ভুত পরিবর্তন।

শিশু নিগ্রহকি বলছেন শিশু অধিকার রক্ষা কমিশনের প্রতিনিধিরা?

শিশু অধিকার রক্ষা কমিশনের আধিকারিকেরা বিভিন্ন সময়ে তাদের নানা বিবৃতিতে জানাচ্ছেন, এগুলোই একমাত্র উদাহরণ নয়, ধারাবাহিক ভাবে কমিশনে এমন অনেক অভিযোগ জমা পড়ে, যেখানে স্পর্শ-আতঙ্কে ভুগছে শিশুরা। সে জন্য কমিশনের তরফে প্রাইমারি, আপার প্রাইমারি লেভেলে বিভিন্ন স্কুলে ‘গুড টাচ ব্যাড টাচ’ সম্পর্কে সচেতনতা কর্মসূচি পালন করা হয়। অনেক সময় বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যৌথ ভাবে স্কুলে স্কুলে গিয়ে প্রচার করার কাজ শুরু হয়েছে। এমনকী, ‘গুড টাচ ব্যাড টাচ’-এর বিষয়টি স্কুল ডায়েরিতে উল্লেখ করার জন্য সিলেবাস কমিটির কাছে কমিশন প্রস্তাবও পাঠিয়েছে। আসলে কে কী ভাবে স্পর্শ করছে, বাচ্চারা সেটা ভালোভাবেই বুঝতে পারে। কিন্তু বাবা-মায়ের কাছে তা বলতে বেশির ভাগ সময়েই তারা ভয় পায়। কিন্তু এটা যে সঙ্কোচ বা লজ্জার বিষয় নয়, সেটাই কর্মসূচিতে বাচ্চাদের বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। এবং অভিভাবকদেরও এটা বোঝা একান্ত প্রয়োজন। চুপ না থেকে এই বিষয় নিয়ে সরব হলেই এ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব।’’

অটিস্টিক বাচ্চাদের ক্ষেত্রে গুরুতর হয় সমস্যা

প্রতিটি শিশুর সক্ষমতা অনুযায়ী তাকে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, বিশেষ করে স্পর্শকাতর অঙ্গগুলোর নাম জানাতে হবে। জানাতে হবে কেন তা স্পর্শকাতর।

‘স্ট্রেনজার ইস ডেনজার’ মনে রাখতে হবে এই শব্দবন্ধটি। অর্থাৎ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অপরিচিত কারও কাছেই শিশুকে নিরাপদ মনে করা চলবে না।

শিশুকে মা বাবা তার শরীরের বিভিন্ন অংশে স্পর্শ করে বোঝাতে হবে তার শরীরের কোথায় স্পর্শ করলে সেটা ঠিক, আর কোথায় স্পর্শ করা ঠিক নয়৷ অর্থাৎ সন্তানদের ওয়াকিবহাল করতে হবে ‘গুড টাচ’, ‘ব্যাড টাচ’ সম্পর্কে। এক্ষেত্রে শিশুর আচরণের পরিবর্তনগুলো মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করা একান্ত প্রয়োজনীয়। শিশু হঠাৎ রেগে গেলে, কান্নাকাটি করলে, ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে উঠলে, মা-বাবাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইলে, শিশুর হাঁটাচলার সমস্যা হলে, শরীরে আঁচড় কামড় বা কোনোরকম আঘাতের দাগ দেখা গেলে, বিশেষ কাউকে দেখে ভয় পেলে, মনমরা হয়ে থাকলে বা অন্য কোনো আচরণের হঠাৎ পরিবর্তন হলে অবশ্যই সতর্ক হন। এবং অবশ্যই এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করুন ৷

অটিজম বা অন্যান্য বিশেষ ভাবে অক্ষম শিশুদের ব্যক্তিগত কাজগুলো শেখাতে হবে, যাতে  টয়লেটে যাওয়া বা নিজের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে অপরের সাহায্য না লাগে।

অটিস্টিক বা বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের নিরাপত্তা রক্ষায় কী করণীয়?

এইরকম বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বয়স ও সক্ষমতা অনুযায়ী যৌন বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান টুকু অবশ্যই দিতে হবে। নারী-পুরুষের সম্পর্ক, গর্ভধারণ, পিরিয়ড বা প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে স্বপ্নদোষ বিষয়ক ধারণা দিতে হবে। কোনো অবৈজ্ঞানিক বা ভ্রান্ত বিশ্বাস যেন তাদের মনে বাসা বাঁধতে না পারে।

যদি অটিজম বা অন্যান্য বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু শারীরিক, মানসিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে, তবে বিষয়টি গোপন করবেন না। তার  চিকিৎসার একান্ত প্রয়োজন। তার জন্য শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মনোবিদের সাহায্যও জরুরি। আর অবশ্যই বিষয়টি চাইল্ড লাইনের হেল্প লাইন নম্বরে জানাতে হবে।

 ইশারা ভাষা শেখানো বা ভাষার ব্যবহার শেখানোর সময় মনে রাখতে হবে যে তারা যেন যেকোনো ভাবেই হোক নির্যাতনের বিষয়টি মৌখিক বা ঈশারায় বোঝাতে সক্ষম হয়।

যে সব বাবা মায়েদের পক্ষে সম্ভব তারা সন্তানকে কখনোই একা রাখবেন না। বিশেষ করে কোনো থেরাপি নিতে গেলেও সে সময় সন্তানের সঙ্গে থাকবেন। কারও কথায় প্রভাবিত হয়ে সন্তানকে একা ছাড়বেন না।

প্রতিরোধ না সচেতনতা – কোনটার প্রয়োজন আগে?

‘গুড টাচ ব্যাড টাচ’-এর সমস্যা বরাবরই রয়েছে। কিন্তু সেই সমস্যা কি ক্রমশ চিরাচরিত স্নেহস্পর্শের ধারণাতে আঘাত হানছে না? এ নিয়ে সংশয় তৈরি হয় অনেকের মনেই । জড়ো হচ্ছে সঙ্কোচ, দ্বিধা আর পারস্পরিক দূরত্ব৷ কারো কারো মতে পাল্টে যাচ্ছে বাচ্চাকে আদরের সংজ্ঞাও৷ তাই অন্যের বাচ্চাকে আদর করার আগে এখন দু’বার ভাবছেন অনেকেই। আগে যেমন অনায়াস যাতায়াত ছিল সম্পর্কের মধ্যে, কোথাও গিয়ে ব্যাঘাত ঘটছে তাতেও।  সামাজিক সম্পর্কের মধ্যেও ছায়া ফেলছে সঙ্কোচ। পরিবেশ পরিস্থিতি অনৈতিক চিন্তাভাবনা অনেকাংশে দায়ী এর জন্য। একটি প্রতিবেদনে সমাজতত্ত্বের একজন অধ্যাপক লিখেছিলেন, ‘‘শরীর হল মানুষের শেষ দুর্গ। সেই দুর্গেই ক্রমাগত আঘাত আসছে, চারদিক থেকে। ফলে পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে এখন সাধারণ স্নেহস্পর্শকেও মানুষ সন্দেহের চোখে দেখছে।’’

‘গুড টাচ ব্যাড টাচ’কে আবার আলাদা ভাবে ব্যাখ্যা করছেন মনোবিদরা। একজন চার পাঁচ বছরের বাচ্চা ‘গুড টাচ’ ‘ব্যাড টাচ’ এর পার্থক্য  কোনটা, সেটা নাও বুঝতে পারে। তাদের শেখানো উচিত, কোনটা নিরাপদ, কোনটা নিরাপদ নয়। পারিপার্শ্বিক বিষয় সম্বন্ধে বাচ্চাদের আতঙ্কিত নয় বরং সতর্ক করা উচিত।

সবক্ষেত্রেই যে বাচ্চারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে সেটা মিথ্যে নয়। কিন্তু চারপাশে ঘটে চলা এই ঘটনায় পাল্টে যাচ্ছে বাচ্চাদের আদরের ধারণা।

একটি বিষয় মনে রাখতে হবেই। প্রথমেই দোষীকে জানান যে তার দোষ সম্বন্ধে আপনি জানেন। তিনি যেন এই অন্যায় দ্বিতীয় বার করার সাহস না করেন ৷ এও বলুন প্রয়োজনে আপনি আইনের সাহায্য নেবেন।

একটি বহু প্রচলিত প্রবাদ হলো “Prevention is better than cure”. অর্থাৎ একটি বিষয় আমাদের মাথায় রাখতেই হবে শিশুদের শারীরিক নিগ্রহ কে রুখে দিতে সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা। প্রথমেই সচেতন হতে হবে বাবা মাকে ৷ কারণ একটি বাচ্চার প্রাথমিক শিক্ষা প্রাপ্তি হয় সেখান থেকেই। বাবা মা সচেতন হলেই সতর্ক হবে শিশুটিও।

Srikona Sarkar

As a Student of Science, I found the subject of both mental and physical wellness quite intriguing in my school days, Which was further sharpened with the completion of Graduation in Molecular Biology in my College. As The whole world, right now is battling with the greatest pandemic of human civilization, I cannot help myself from helping out people by providing the exact solution for their mental and physical profoundness so that, they can always discover a new tunnel of hope and light, even when their movement is restricted within the boundary of the walls.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago