বাংলার সবচেয়ে বিষধর সাপগুলি কি কি? সাপে কামড়ালে কি করনীয় এবং কি করবেন না

Published by

প্রতি বছর প্রায় ২ মিলিয়নের বেশি বিষাক্ত সাপের কামড়ের ঘটনা ভারতবর্ষে ঘটে থাকে এবং সারা পৃথিবীতে এই সংখ্যাটা ৫.৪ মিলিয়নের সমান। ভারতবর্ষে প্রায় ৩০০ প্রজাতির সাপ আছে এবং এর ভেতর প্রায় ৬২ রকমের বিষাক্ত সাপ আছে। বিষাক্ত সাপের কামড় খুবই বিপজ্জনক। নির্বিষ সাপে কামড়ও কখনো কখনো বিপজ্জনক হয়ে ওঠে সাপের বিষের ফলে হওয়া অ্যালার্জির কারনে। বিষাক্ত সাপের কামড়ের ফলে যন্ত্রণা, ফুলে যাওয়া, মাথা ঘোরা, বমি ভাব, খিঁচুনি, প্যারালাইসিস এবং মৃত্যুও হতে পারে।

সাপে কামড়ালেই প্রথমে যেটা করা উচিত তা হল সেই জায়গাটা কে ভালো করে ধুয়ে ফেলা, আক্রান্ত জায়গাটাকে বেশি নাড়াচাড়া না করা এবং রোগীকে মানসিক ভাবে শান্ত রাখা এবং সাহস দেওয়া এবং যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের সহায়তা নিতে হবে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা হলে রোগীকে প্রানে বাঁচানো এবং অন্যান্য জটিলতা এড়ানো সম্ভব হয়।

বিষাক্ত সাপের চিহ্নিতকরন

বিষাক্ত সাপ যদি চিনতে পারা না যায় এবং নির্বিষ ও বিষাক্ত সাপের ভেতর যদি পার্থক্য করা না যায় তাহলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে সমস্যা হয়, তাই সমস্ত সাপের কামড়কেই বিষাক্ত সাপের কামড় মনে করেই চিকিৎসা শুরু করতে হবে।

ভারতবর্ষে তথা বাংলায় সবচেয়ে বিষধর সাপ এর কথা যদি বলা হয় তাহলে যে চারটি সাপের কথা উঠে আসে সেগুলি হল –

  • 1) গোখরো (Spectacled Cobra /Indian Cobra)
  • 2) কেউটে (Monocled Cobra)
  • 3) চন্দ্রবোড়া (Russell’s Viper)
  • 4) কালাচ (Common Krait)

সাপের কামড়কে চিহ্নিত করতে পারা যায় কিছু সাধারণ লক্ষনের মাধ্যমে

  • ক্ষত স্থানে দুটো ছিদ্র দেখা যাবে
  • ক্ষত স্থানে ফোলা ও লাল ভাব থাকবে
  • ক্ষত স্থানে ব্যথা থাকবে
  • রোগীর শ্বাসকষ্ট থাকবে
  • বমি ও মাথাঘোরা থাকবে
  • দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসবে
  • ঘাম হবে
  • অতিরিক্ত লালা নিঃসরন হবে
  • মুখে ও অন্যান্য অঙ্গে অসাড়তা দেখা যাবে।

বাংলার সবচেয়ে বিষধর সাপগুলি কি কি?

গোখরো (Spectacled Cobra /Indian Cobra)

এটি ফণাযুক্ত সাপ। গায়ের রঙ বাদামী। ফনার পিছনে গোরুর খুরের আকৃতির ছাপ থাকে। উত্তেজিত হলে বা ভয় পেলে ফনা তুলে হিস হিস শব্দ করতে থাকে। মাঠে–ঘাটে, চাষের জমিতে এবং বাড়িতে কোথাও ফসল জমা করা থাকলে সেখানে এদের বেশি দেখা যায়। সাধারণত রাতের বেলাতেই এদের বেশি দেখা যায়। এরা গ্রাম বাংলায় খরিস, দুধ খরিস, পদ্ম খরিস ইত্যাদি নামেও পরিচিত।

Indian Cobra

গোখরোর বিষ “নিউরোটক্সিন”এবং “কার্ডিওটক্সিন” প্রকৃতির। গোখরোর বিষ স্নায়ুর ওপর প্রভাব ফেলে বলে কামড়ের কিছুক্ষন পরেই পেশীর কাজ বন্ধ হয়ে যায় এবং তারপরে শ্বাসকষ্ট এবং হৃদপিণ্ডের ক্রিয়াকলাপ বন্ধ হয়ে যায়। ক্ষত অঙ্গে পচন শুরু হয় এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা না শুরু হলে ৪ —৬ ঘন্টার মধ্যে রোগীর মৃত্যু হয়।

কামড়ের জায়গায় তীব্র জ্বালা যন্ত্রণা হয়।  ক্ষতস্থান থেকে রক্তরস চুঁইয়ে রক্তরস পরে এবং যন্ত্রণা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং ছড়িয়ে পড়ে। তবে স্নায়ুকে অকেজো করে দেয় বলে কিছু পরে যন্ত্রনা আবার কমে যায়।

কেউটে (Monocled Cobra)

এদের শরীরের রঙ ধূসর কালো। ফনার পেছনে একটা চোখের মতো বা পদ্মের মত চিহ্ন আছে। এরাও সাধারণত রাতে বের হয়। জলা জায়গা, কৃষি জমি, শস্য খামারে এদের দেখা যায়।

কেউটে

কেউটের বিষ “নিউরোটক্সিন”এবং “কার্ডিওটক্সিন” প্রকৃতির। গোখরোর বিষ স্নায়ুর ওপর প্রভাব ফেলে বলে কামড়ের কিছুক্ষন পরেই পেশীর কাজ বন্ধ হয়ে যায় এবং তারপরে শ্বাসকষ্ট এবং হৃদপিণ্ডের ক্রিয়াকলাপ বন্ধ হয়ে যায়। ক্ষত অঙ্গে পচন শুরু হয় এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা না শুরু হলে ৪ —৬ ঘন্টার মধ্যে রোগীর মৃত্যু হয়।

কামড়ের জায়গায় তীব্র জ্বালা যন্ত্রণা হয়।  ক্ষতস্থান থেকে রক্তরস চুঁইয়ে রক্তরস পরে এবং যন্ত্রণা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং ছড়িয়ে পড়ে। তবে স্নায়ুকে অকেজো করে দেয় বলে কিছু পরে যন্ত্রনা আবার কমে যায়।

কালাচ

গায়ের রঙ কালো। মাথার অংশটা বাদে সারা শরীরে সাদা সরু আড়াআড়ি দাগ থাকে। এর কামড়ের জায়গা টা অসাড় হয়ে যায়, ফলে কোনো জ্বালা যন্ত্রণা হয় না, তাই এর কামড় বড় বিপদ ডেকে আনে। এর কামড় ১০০% বিপজ্জনক। সময়মতো অ্যান্টিভেনম ইঞ্জেকশন না নিলে মৃত্যু অনিবার্য। গ্রাম বাংলায় এই সাপটি কালচিতি, ডোমনাচিতি, শিয়রচাঁদা, শঙ্খচিতি নামেও পরিচিত।

কালাচ

কালাচের বিষও তীব্র স্নায়ুবিষ বা নিউরোটক্সিন।এই প্রকারের বিষ হওয়ার কারনে গায়ে হাত পায়ে ও গাঁটে ব্যথা হয়। যদিও জ্বালা যন্ত্রণা থাকে না। মাথাঘোরা, বমিভাব, তলপেটে ব্যথা, চোখের পাতা বন্ধ হয়ে থাকে (শিবনেত্র), মুখ পুরো খুলতে না পারা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি হয়।

এই সাপ ফনাহীন। এর কামড়ে যেহেতু ব্যথা/জ্বালা, ফোলা হয় না, তাই অনেক সময়ই রোগীর বাড়ির লোককে ডাক্তারবাবুর পক্ষে বোঝানো সম্ভব হয় না যে রোগীকে সাপে কামড়েছে।

শাঁখামুটি

এদের শরীর তিনকোনা হয়। সারা গায়ে উজ্জ্বল কালো হলুদ ডোরা কাটা দাগ থাকে। এরা কালাচ ও চন্দ্রবোরা সাপকে খেয়ে নেয়, ফলে যেখানে শাঁখামুটি থাকে সেখানে চন্দ্রবোরা ও কালাচ থাকে না। এই সাপ শান্ত প্রকৃতির হয়ে থাকে।

এদের বিষও নিউরোটক্সিন।

চন্দ্রবোড়া (Russell’s Viper)

এই সাপের দেহটা মোটা হয়ে থাকে। গায়ের রঙ বাদামী বা হলদে বাদামী হয়ে থাকে এবং সারা গায়ে গাঢ় বাদামী রঙের গোল গোল দাগ থাকে। মাথাট চওড়া ও তিনকোনা হয়। ঝোপঝাড়, পাথুরে অঞ্চল, কৃষিজমিতে এদের দেখা যায়। এটি তীব্র বিষযুক্ত। এই সাপের কামড়ের পরে খুব দ্রুত রোগীকে অ্যান্টিভেনম দেওয়া প্রয়োজন।

চন্দ্রবোড়া

এদের বিষ রক্ত ধ্বংসকারী বা “হেমোটক্সিন” প্রকৃতির। কামড়ের স্থানে তীব্র জ্বালা যন্ত্রণা হয়। দংশন স্থানের আশেপাশে ফোস্কা বা ঘা হয়। চামড়া, দাঁতের ফাঁক থেকে রক্ত বের হয়। লালা বা মূত্রের সাথেও রক্ত বের হয়। এই বিষ কিডনিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

অঙ্গুরী

এই সাপের দেহের রঙ জলপাই বা হলুদ রঙের হয়ে থাকে। তার ওপর কালো ডোরা কাটার মতো গোল গোল দাগ থাকে যা পাশের দিকে সরু হয়ে যায়। লেজ চ্যাপ্টা। জলাভূমি, বাদাবন ও সমুদ্রতটে এদের দেখতে পাওয়া যায়। এদের কামড়ে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা খুবই কম। এরা বাচ্চা প্রসব করে।

খড়গনাসা বা জল কেরাল

এদের শরীরের উপরের দিকটা ধূসর বা কালচে সবুজ রঙের হয়ে থাকে। পেটের দিকটা হলদেটে হয়ে থাকে। লেজ চ্যাপ্টা। সমুদ্র, জলাশয় বা মোহনার কাছে এরা থাকে। সাপটি তীব্র বিষধর। এরা সাধারণত মানুষকে কামড়ায় না।

প্রবাল বা কোরাল সাপ

মাথা কালো, ঘাড়ের কাছে সাদা দাগ আছে। পেটের উপরের রঙ বাদামী, পেটের রঙ লাল। লেজের নীচের দিকের রঙ নীল। লেজে দুটো বাদামী কালো দাগ আছে। গাছের পাতার ভেতর বা মাটির নীচে দেখা যায়। কামড়ালে ক্ষতস্থান টা চুলকায় ও হাল্কা ফুলে যায়। খিঁচুনি, পেটে ব্যাথা, শ্বাসকষ্ট, গিলতে সমস্যা হওয়া, মাথা যন্ত্রনা, ত্বকের রঙ পাল্টে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষনও দেখা যায়।

সাপে কাটার প্রাথমিক চিকিৎসা

সাপে কামড়ালে কি করবেন

  • কামড়ের সময়টা খেয়াল রাখতে হবে
  • শান্ত থাকতে হবে এবং কামড়ের জায়গা টা নাড়াচাড়া করা যাবে না, যাতে করে শরীরের অন্য অংশে বিষ ছড়িয়ে না পড়ে।
  • কামড়ের জায়গা টা ফুলে ওঠে, তাই ক্ষতস্থানের ওপর চেপে বসে এরকম কাপড় বা কোনো অলংকার রাখা যাবে না
  • রোগীকে হাঁটতে দেওয়া যাবে না।
  • সাপটিকে মারার বা ধরার চেষ্টা করার দরকার নেই। পারলে একটা ছবি তুলে রখা যেতে পারে। সাপকে খোঁজার জন্য সময় নস্ট করার প্রয়োজন নেই।

সাপে কামড়ালে কি করবেন না

  • কামড়ের জায়গার ওপরে কাটা ছেঁড়া করা যাবে না
  • ক্ষতস্থানে ঠান্ডা বা কোল্ড কম্প্রেস দেওয়া যাবে না
  • চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া রোগীকে কোনো ওষুধ দেওয়া যাবে না
  • ক্ষতস্থান টা রোগীর হৃদপিণ্ডের অবস্থানের ওপরে কোনোভাবেই রাখা যাবে না।
  • ক্ষতস্থান থেকে মুখ দিয়ে বিষ টেনে বার করার চেষ্টা একেবারেই কিরা উচিৎ নয়
সাপের কামড়ের চিকিৎসা

সাপের কামড়ের পরে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা শুরু করতে হবে। চিকিৎসক রোগীকে পরীক্ষা করে চিকিৎসা শুরু করবেন। সাপের কামড় কতটা বিপজ্জনক হবে তা নির্ভর করছে কামড়ের জায়গা এবং রোগীর শারীরিক অবস্থা ও বয়সের ওপর। যদি কামড় বিপজ্জনক না হয়, বা বিষাক্ত সাপের না হয়, তাহলে চিকিৎসক ক্ষতস্থান ধুয়ে টিটেনাস দিয়ে ছেড়ে দেন। বিষাক্ত সাপের কামড় হলে অ্যান্টিভেনম দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। যত তাড়াতাড়ি ইঞ্জেকশন দেওয়া হবে, তত রোগীকে দ্রুত সুস্থ করা যাবে।

সাপের কামড়ের থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়

সাপের কামড় থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রথম উপায় হল সাপ সংক্রান্ত কাজে জড়িত না থাকা এবং বনে জঙ্গলে ঘুরে না বেড়ানো। যেসব জায়গায় সাপেরা লুকিয়ে থাকতে ভালোবাসে, যেমন – ঝোপঝাড়, ভিজে কাঠের বোঝা, শস্য খামার ইত্যাদি জায়গা এড়িয়ে চলতে হবে বা সাবধানে চলা ফেরা করতে হবে। হঠাৎ করে কোনো সাপের সম্মুখীন হয়ে গেলে নিজে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, সাপটাকে তার নিজ্ব্র মতো চলে যেতে দেওয়ার সময় দিতে হবে। সাপ থাকতে পারে এমন জায়গায় যদি কাজ করতে হয় তাহলে লম্বা পা ঢাকা বুট জুতো, পা ঢাকা প্যান্ট ও চামড়ার গ্লাভস পরতে হবে। রাতের বেলায় বেরোলে আলো নিয়ে বেরোতে হবে এবং সাথে একটি লাঠি নিয়ে বেরোতে হবে এবং তা চলার আগে আগে মাটিতে ঠুকে ঠুকে চলতে হবে। রাতে মশারি টাঙিয়ে শুতে হবে এবং বাড়ির আশেপাশের ইঁদুরের গর্তগুলো বুজিয়ে দিতে হবে। এইসব কাজগুলো করলে সাপের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।

Anshula Banerjee

Hello, I am Anshula Banerjee, completed my post-graduation degree in English, along with Bachelor of Education. I live at Nadia. I am a voracious reader in various fields of knowledge that may help the readers to satisfy their urge specially in the area of health and wellness.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago