এন্ডোমেট্রিওসিস কেন হয় ? এন্ডোমেট্রিওসিস এর লক্ষণ এবং গর্ভধারণে এর প্রভাব

Published by

চিকিৎসা বিজ্ঞানের একদম শুরু থেকেই ঋতুমতী মেয়েরা যে অসহ্য পেটে ব্যথায় কষ্ট পেতেন, তার কারণ ছিল এন্ডোমেট্রিওসিস। এমনকি আজও ঋতুচক্র চলাকালীন অধিকাংশ মহিলারা যে অসহ্য পেটের যন্ত্রণায় কষ্ট পান, তার জন্যও দায়ী এই এন্ডোমেট্রিওসিস। এন্ডোমেট্রিওসিস কেন হয় তার সুনির্দিষ্ট কারণ সম্পর্কে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এখনও অব্ধি বিশ বাঁও জলে। সঠিক ওষুধের সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি তাই৷

ঋতুচক্রের শুরু থেকেই শুরু হতে পারে এন্ডোমেট্রিওসিস, এমনকি তা চলতে পারে মেনোপজ পর্যন্ত। ইউটেরাসের ভেতরে এন্ডোমেট্রিয়াম নামে একটি স্তর বা লাইনিং থাকে। বয়ঃসন্ধিতে একটি মেয়ে যখন ঋতুমতী হয়, নানা হরমোনের প্রভাবে তার জরায়ু বা ইউটেরাসের মধ্যে নানা ওলটপালট হয়। গর্ভে সন্তান এলে বা ঋতুনিবৃত্তি পর্যন্ত হরমোনের ওঠাপড়ায় জরায়ুর নানাবিধ পরিবর্তন হয়।

এন্ডোমেট্রিওসিস তাহলে কী?

এএন্ডোমেট্রিওসিস দেখা যায় প্রজননক্ষম মহিলাদের মধ্যে। সমীক্ষায় পাওয়া রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী,আমাদের দেশে বছরে গড়ে ১০ লক্ষ মহিলা এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এই রোগটি কিন্তু মোটেই সামাজিক অবস্থান, আর্থিক পরিস্থিতি বা নির্দিষ্ট কোনো জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মেনোপজ হয়নি, এমন যে কোনো মহিলার এই রোগটি হতে পারে। নয় থেকে প্রায় আটচল্লিশ বা পঞ্চাশ বছর বয়স অবধি মহিলাদের জরায়ুতে যে এন্ড্রোমেট্রিয়াল লাইনিং থাকে, তার কোষ জরায়ুর বাইরে ফেলোপিয়ান টিউব, ডিম্বাশয় বা পাউচ অব ডগলাসে লেপ্টে থাকলে তাকে এন্ডোমেট্রিওসিস বলে।

এন্ডোমেট্রিওসিস হলে কোনো কোনো মহিলার গর্ভধারণের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। আবার অনেকেই এই রোগ নিয়ে গর্ভধারণ করতে পারেন। তবে গর্ভবতী হলে ব্যথা একদম কমে যায়, কারন তখন ঋতুস্রাব বন্ধ থাকে। শিশু জন্মানোর ছ’মাস বা এক বছর পরে ব্যথা ফের মাথচাড়া দিয়ে ওঠে।

এন্ডোমেট্রিওসিস কেন হয় বা কারণ গুলি কী কী?

নারীদের শরীরে ঋতুচক্রের সময় ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের প্রভাবে এন্ডোমেট্রিয়াম বা জরায়ুর ভেতরের লাইনিং পুরু হয়ে যায়। এর ফলে ফার্টিলাইজড ওভাম বা ডিম্বানু যাতে সহজে গেঁথে যায়, সেই ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। গর্ভধারণ না হলে, এই পুরু হয়ে যাওয়া এন্ডোমেট্রিয়াম খসে পড়ে। এবং সেটি ঋতুস্রাব হিসেবে বেরিয়ে আসে। এন্ডোমেট্রিওসিস হলে জরায়ুর ভেতরের এই দেওয়াল বা লাইনিং পেলভিসের বিভিন্ন অংশে এমনকি অস্বাভাবিক স্থানে খুঁজে পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে পেলভিস বা শ্রোণিদেশে ঘটে যাওয়া অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের বাইরে বেরনোর কোনও পথ থাকে না। তাই ঋতু্স্রাবের সময়ে প্রতিবর্ত ব্লিডিং হয়। এটি জমে গিয়ে তৈরি হয় প্রদাহ বা ইনফ্ল্যমেশন, তার সঙ্গে ব্যথা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক হল, এর ফলে অভ্যন্তরীণ জননাঙ্গও বিপর্যস্ত হতে পারে।

জরায়ুর পেশির দেওয়ালেও এই একই সমস্যা হতে পারে। একে অ্যাডিনোমায়োসিস বলে।

এন্ডোমেট্রিওসিস এর লক্ষণ বা উপসর্গ কী কী?

মহিলাদের ঋতুচক্রের সময়ে এন্ডোমেট্রিয়াম যেমন ফুলে ওঠে, তেমনই বাইরে (ফেলোপিয়ান টিউব, ডিম্বাশয় বা পাউচ অব ডগলাস)এ সব অঙ্গের উপরে রক্তভরা পিণ্ড তৈরি হয়।

এন্ডোমেট্রিওসিস এর লক্ষণ

•  তলপেট ও পেলভিসে অসহ্যভব্যথা। ঋতুস্রাবের শুরুর তিন-চারদিন আগে থেকেই যন্ত্রণা শুরু হয়৷

ঋতুচক্রের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত৷

• যৌন মিলনের সময় বা পরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা এবং অস্বস্তি।

• কোমর, তলপেট, পিঠে এক টানা ব্যথা চলতে থাকে।

• মূত্রথলি বা পায়ুদ্বারে ব্যথা।

• এন্ডোমেট্রিওসিসের সবচেয়ে বড় জটিলতা হল বন্ধ্যাত্ব। অর্থাৎ সন্তানধারণে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

• এই রোগ এক জন নারীর স্বাভাবিক স্বাস্থ্য ও জীবন নষ্ট করে দেয়। এর ফলে সহজেই ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। ফলে আসে ক্লান্তি, হতাশা এবং মানসিক অবসাদ।

কিভাবে নির্ণয় করা হয় এন্ডোমেট্রিওসিস?

• ক্লিনিক্যালি অর্থাৎ পেটের কোথায় ব্যথা আছে তা জানতে প্যারাভ্যাজাইনাল পরীক্ষা করা হয়। পাউচ অব ডগলাসে রক্ত জমে দানা আকারে তৈরি হলে জরায়ুর স্বাভাবিক নড়াচড়ায় ব্যাঘাত ঘটে।

• আলট্রাসাউন্ড ও ডায়াগনস্টিক ল্যাপারোস্কপি। আলট্রাসাউন্ড এক ধরনের স্ক্যান। এর মাধ্যমে এন্ডোমেট্রিওসিস হয়েছে কি না তা নিশ্চিত ভাবে জানা না গেলেও দ্বিতীয়টি হল এন্ডোমেট্রিওসিস নির্ধারণের নিশ্চিত উপায়। নাভির মধ্যে ছোট্ট একটা ফুটো করে, টেলিস্কোপের মতো দেখতে যন্ত্র, যাকে ল্যাপারোস্কোপ বলে, তা পেটে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এই পরীক্ষা এন্ডোমেট্রিওসিস রয়েছে কি না তা নিশ্চিত করে। জেনারেল অ্যানাস্থেসিয়ার মাধ্যমে করা হয় এটি।

গর্ভধারণের ক্ষেত্রে এন্ডোমেট্রিওসিস এর প্রভাব কী?  এর ফলে কিভাবে আসে বন্ধ্যাত্ব?

জরায়ু বা ইউটেরাসের গায়ে যে আবরণ উপস্থিত থাকে, তাকে এন্ডোমেট্রিয়াম বলে। ঋতুচক্রের সময় এই এন্ডোমেট্রিয়ামের গঠন সম্পূর্ণ হয়ে যায়। ওভাম নিষিক্ত না হলে, এই এন্ডোমেট্রিয়াম নামক পাতলা পর্দাটি জরায়ু থেকে ছিঁড়ে পিরিয়ডসের সময় রক্তস্রাবের মাধ্যমে আমাদের শরীর থেকে বের হয়ে যায়। এই এন্ডোমেট্রিয়ামই যখন জরায়ুর ভিতরে ছাড়াও জরায়ুর বাইরে, ওভারি, ফ্যালোপিয়ান টিউব এমনকি মলাশয়ের দেওয়ালেও আবরণ তৈরি করে, তখন তাকে এন্ডোমেট্রিওসিস বলা হয়। এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত মহিলাদের পিরিয়ডসের সময় স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি রক্তপাত হয়। কারণ, এই সময় জরায়ুর দেওয়াল ছাড়া অস্বাভাবিক স্থানে গজিয়ে ওঠা এন্ডোমেট্রিয়াম ছিঁড়ে রক্তের সাথে বেরিয়ে আসে। আবার ওভারিতে ‘চকোলেট সিস্ট’ হওয়ার কারণই হলো এই এন্ডোমেট্রিওসিস রোগ। এর ফলে, মহিলাদের স্বাভাবিক জনন ক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং গর্ভধারণে অসুবিধা হয়। ফলত দেখা দেয় বন্ধ্যাত্বের মতো সমস্যা।  তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এন্ডোমেট্রিওসিস থেকে মুক্তি পেয়ে সন্তানধারণ করা সম্ভব হয়।

এন্ডোমেট্রিওসিসের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে কী কী চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়?

অস্ত্রোপচার ছাড়া ওষুধের মাধ্যমে এন্ডোমেট্রিওসিস এর চিকিৎসাতে মোটামুটি ভাবে ছ’মাস সময় লাগে। তবে অবশ্যই গুরুতর ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় অস্ত্রোপচারের।

নন স্টেরয়েড অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি ড্রাগ — এটি প্রয়োগ করা হয়, ব্যথা উপশমের জন্য।

ওরাল কনট্রাসেপ্টিভ পিল — প্রতিমাসে ২১টি এই ওষুধ দেওয়া হয় কারণ এতে থাকা ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোন যৌথ ভাবে ওভ্যুলেশন দমিয়ে দেয়। ফলে অল্প সময়ের জন্য ঋতুস্রাব হয়। ফলত তাতে ব্যথাও কম হয়।

‘ইন্ট্রাইউটেরাইন ডিভাইসেস’ — এটি একটি ছোট্ট যন্ত্র, যা জরায়ুতে প্রবেশ করালে তা ধীরে ধীরে প্রোজেস্টেরন হরমোন নিঃসরণে সাহায্য করে।

জিএনআরএইচ অ্যাগোনিস্ট (গোনাডোট্রপিন রিলিজিং হরমোন অ্যাগোনিস্ট) — এই ওষুধটি ডিম্বাশয় থেকে ইস্ট্রোজেন উৎপাদন বন্ধ করে। তাই অস্থায়ী মেনোপজ তৈরি হয়। এটি কিন্তু জন্মনিরোধক চিকিৎসা পদ্ধতি নয়।

ল্যাপরোস্কোপিক সার্জারি — এর মাধ্যমে আক্রান্ত অঞ্চলগুলি বাষ্পীভূত করে দেওয়া হয়। এন্ডোমেট্রিওটিক নডিউলগুলি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কেটে বাদ দেওয়া হয়। এটি একটি জটিলতম অস্ত্রোপচার। তবে অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন, এন্ডোমেট্রিওটিক নডিউলগুলির সঙ্গে খাদ্যনালি জড়িয়ে গেলে কিন্তু তা প্রাণহানিও করতে পারে।

ল্যাপারোটমি — এন্ডোমেট্রিওসিস যদি বৃহদাকারে ও অনেকটা অঞ্চল জুড়ে হয়, তবে এই ল্যাপারোটমি করতে হয়। এ ক্ষেত্রে নাভির নীচের অংশ থেকে পেট কাটতে হয়। এই সার্জারির সময় কোনো ব্যক্তি ভবিষ্যতে সন্তানধারণে ইচ্ছুক না হলে, ডিম্বাশয় বাদ দেওয়া হয়।

হিস্টেরেক্টমি — এই রোগে কিন্তু জরায়ু বাদ দেওয়া বা হিস্টেরেক্টমি করতে হতে পারে। তাই এই অস্ত্রোপচারের পর আর কোনোভাবেই সন্তানধারণ সম্ভব নয়।

সতর্কতাঃ

• এন্ডোমেট্রিওসিস থাকাকালীন কোনো মহিলা সন্তানধারণ করতে চাইলে, অবশ্যই করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে তার আগে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়াই ভাল।

• নিয়মিত খেলাধুলো বা শরীরচর্চা করলে এন্ডোমেট্রিওসিসের যন্ত্রণা তুলনামূলক  কম হয়।

• দুশ্চিন্তা, মানসিক অবসাদ – এসব থেকে দূরে থাকতে হবে৷

• পর্যাপ্ত ঘুম একান্ত জরুরি।

• দুগ্ধজাত দ্রব্য, রেডমিট, কফি ইত্যাদি খাবার এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। • ঋতুচক্রের সময় পেটে ব্যথা অনুভব করলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

Srikona Sarkar

As a Student of Science, I found the subject of both mental and physical wellness quite intriguing in my school days, Which was further sharpened with the completion of Graduation in Molecular Biology in my College. As The whole world, right now is battling with the greatest pandemic of human civilization, I cannot help myself from helping out people by providing the exact solution for their mental and physical profoundness so that, they can always discover a new tunnel of hope and light, even when their movement is restricted within the boundary of the walls.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago