সিরোসিস কি এবং এর লক্ষণ ও চিকিৎসা

Published by

সিরোসিস লিভারের একটি অত্যন্ত গভীর ক্ষত, যা ননঅ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজের একদম শেষ প্রান্তে হয়ে থাকে এবং লিভার ড্যামেজের অন্যান্য পরিস্থিতিতেও হতে পারে। সিরোসিসের ফলে লিভারে যে ক্ষত বা দাগ তৈরি হয়, তা সাধারণত সারিয়ে তোলা যায় না, তবে চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ননঅ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ ছাড়াও হেপাটাইটিস, দীর্ঘদিন ধরে মদ্যপানের অভ্যাস এবং প্রাইমারি স্ক্লেরোসিস চোল্যাংগাইটিসের ফলেও লিভার সিরোসিস হয়ে থাকে। লিভার সিরোসিস মহিলাদের থেকে পুরুষদের বেশি হয়ে থাকে।

সিরোসিসের রোগলক্ষন

সিরোসিসের প্রথম প্রথম কোনো রোগলক্ষন প্রকাশ পায় না। রোগলক্ষন দেখা দিতে দিতে সিরোসিস অনেকটা জটিল পর্যায়ে চলে যায়। রোগলক্ষন তখন দেখা দিতে শুরু করে, যখন লিভারের ক্ষত এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, যে লিভার রক্ত পরিশুদ্ধ করতে, ক্ষতিকর জিনিসকে ভাঙতে, জমাট বাঁধা প্রোটিন উৎপন্ন করতে, ফ্যাট ও ফ্যাটে দ্রবনীয় ভিটামিনের আত্মীকরন করতে পারে না। রোগলক্ষনগুলি হল—ক্ষিধে কমে যাওয়া , ক্লান্তি , পেটের ওপর দিকে হাল্কা ব্যথা , মাথাঘোরা , বমিভাব , শিরার আকার ও ফোলাভাবের বৃদ্ধি । এগুলো ছাড়াও আরও কিছু রোগলক্ষন দেখা যায় সেগুলো হল —

i.চোখ ও ত্বকের ফ্যাকাসে হলুদ ভাব (জণ্ডিস)।

ii.সঠিকভাবে চিন্তা করতে সমস্যা।

iii. সহজেই রক্তপাত হওয়া বা ত্বকে কালশিটে পড়ে যাওয়া।

iv.ত্বকে প্রচণ্ড চুলকানি হওয়া।

v.স্বাভাবিকের থেকে গাঢ় রঙের মূত্র হওয়া ।

vi.পেট ফুলে যাওয়া।

vii.পা ফুলে যাওয়া।

সিরোসিসের বিভিন্ন স্টেজ :-

i.কম্পেনসেটেড সিরোসিস : এই স্টেজটি অ্যাসিম্পটোম্যাটিক হয়, অর্থাৎ কোনো রোগলক্ষন দেখতে পাওয়া যায় না। লিভারে ক্ষত থাকতে পারে, তবে সেটা এতটাও গভীর হয় না, যে রোগ লক্ষন তৈরি করবে।

ii.ডিকম্পেনসেটেড সিরোসিস : এটা সেই পর্যায়, যেখানে জণ্ডিস এর মতো রোগলক্ষন দেখতে পাওয়া যায়। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিরোসিস প্রথমে কি কারনে শুরু হয়েছিল তা ধরা পড়ে, তাহলে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে আবার কম্পেনসেটেড সিরোসিস এ ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।

সিরোসিসের সাধারণ কারণ

লিভার সিরোসিসের বিভিন্ন কারন আছে। এর ভেতর সবথেকে কমন দুটো কারন হল ক্রনিক হেপাটাইটিস ও ক্রনিক অ্যালকোহল মিসইউজ।

হেপাটাইটিস :- হেপাটাইটিস সি হল এমন একটি ভাইরাল ইনফেকশন, যা লিভারের ক্ষতি ও প্রদাহ তৈরি করে। ইললিগাল ইঞ্জেকটেড ড্রাগের ব্যবহার, অসুরক্ষিত যৌন সংসর্গ এবং কিডনি ডায়ালিসিসের কারনে হেপাটাইটিস সি তে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। হেপাটাইটিস বি হল লিভারের আরেকটি অত্যন্ত কমন ভইরাল অসুখ। এশিয়া, আফ্রিকা, সাউথ আফ্রিকা, মিডল ইস্ট ও ইস্টার্ন ইউরোপের দেশগুলিতে হেপাটাইটিস বি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। চিকিৎসা না হলে হেপাটাইটিস বি ও সি লিভার সিরোসিস তৈরি করে।

অ্যালকোহল :- মহিলা এবং পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই মডারেট অ্যালকোহল পানও লিভার সিরোসিসের সবথেকে কমন কারন হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণ ভাবে বছরের পর বছর ধরে বেশি পরিমানে অ্যালকোহল পান, সিরোসিসের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ননঅ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ হল লিভারের রোগের এমন একটি পর্যায়, যেখানে লিভারে অতিরিক্ত ফ্যাট জমা হয় এবং এর সাথে অ্যালকোহল পানের কোনো সম্পর্ক থাকে না।

ননঅ্যালকোহলিক স্টিয়াটো হেপাটাইটিস, ননঅ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ এর থেকেও গুরুতর পরিস্থিতি। এতে লিভারে ফ্যাট তৈরির সাথে সাথে লিভার ক্ষতিগ্রস্তও হয়। এটির চিকিৎসা না হলে লিভার সিরোসিস হতে পারে।

সিরোসিসের অন্যান্য কারন

হেপাটাইটিস ডি : হেপাটাইটিস ডি তাদের ভেতর দেখা যায়, যাদের অলরেডি হেপাটাইটিস বি আছে।

অটোইমিউন হেপাটাইটিস : অটোইমিউন হেপাটাইটিস প্রদাহ তৈরি করে, যার ফলে সিরোসিস হয়ে থাকে।

পিত্তনালীতে ক্ষতি : এই নালী পিত্ত পরিবহনে সহায়তা করে। এর একটি উদাহরণ হল প্রাইমারি বাইলারি চোলাংগাইটিস। শরীরের আয়রন ও কপার (তামা) আত্মীকরনে সমস্যা। দুটো উদাহরণ হল হেলোক্রোমাটোসিস এবং উইলসন্স ডিজিজ । কিছু ওষুধ যা প্রেস্ক্রিপশন ছাড়া সহজেই কিনতে পারা যায়, সেগুলোর অতিরিক্ত ব্যবহার, যেমন : অ্যাসিটামিনোফেন, কিছু অ্যান্টিবায়োটিক এবং কিছু অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট।

কিভাবে সিরোসিস নির্নয় করা হয়

সিরোসিস নির্নয়ের জন্য চিকিৎসক শারীরিক পরীক্ষা করেন এবং সম্পূর্ণ মেডিকেল হিস্ট্রি সম্বন্ধে জানেন। চিকিৎসকের কাছে সম্পূর্ণ সৎভাবে জানাতে হবে অ্যালকোহল ব্যবহারের ব্যাপারে, হেপাটাইটিস বি / সি এর ব্যাপারে, অটোইমিউন ডিজিজ সম্বন্ধে এবং অন্য কোনো সমস্যা থাকলে। শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসক যেগুলো বোঝার চেষ্টা করবেন তা হল —

i.ত্বক বা চোখের রঙ হলুদ হয়ে যাওয়া ।

ii.হাতের তালু লাল হয়ে থাকা ।

iii.হাত কাঁপা ।

iv.লিভার বা প্লীহার আকার বৃদ্ধি ।

লিভার কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার জন্য কোন পরীক্ষা করা হয়

i.অ্যানিমিয়া আছে কিনা বোঝার জন্য কম্পলিট ব্লাড কাউন্ট টেস্ট ।

ii.কতো তাড়াতাড়ি রক্ত জমাট বাঁধছে, তা বোঝার জন্য কোয়াগুলেশন ব্লাড টেস্ট ।

iii.লিভারে একটি বিশেষ প্রোটিন উৎপন্ন হচ্ছে কি না, তা বোঝার জন্য কোয়াগুলেশন ব্লাড টেস্ট ।

iv.লিভার ফাংশন টেস্ট ।

v.লিভার ক্যান্সার স্ক্রিনিং এর জন্য আলফা ফেটোপ্রোটিন ।

লিভারের অন্যান্য টেস্টগুলি হল—

i.ইসোফেগাল ভ্যারিসিস আছে কি না বোঝার জন্য একটি আপার এণ্ডোস্কোপি টেস্ট ।

ii.লিভারের একটি আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান ।

iii.পেটের একটি এম.আর.আই

iv.পেটের একটি সি.টি স্ক্যান ।

v.একটি লিভার বায়োপসি, যা কিনা সিরোসিস বোঝার সর্বশেষ পরীক্ষা ।

সিরোসিসের ফলে তৈরি হওয়া জটিলতা

যদি লিভারের ভেতর দিয়ে রক্ত পরিবহন হতে না পারে, তাহলে এটি অন্যান্য শিরায় নিরোধ তৈরি করে, যেমন ইসোফেগাসে হয়ে থাকে। একে ইসোফেগাল ভ্যারিসিস বলা হয়।

সিরোসিসের ফলে আরও যে যে জটিলতা তৈরি হয় সেগুলো হল —

i.ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশন এর মতো ব্যাকটেরয়াল ইনফেকশন ।

ii.রক্ত জমাট বাঁধার জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিনের অভাবের ফলে অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়া ।

iii.অপুষ্টি ।

iv.কিডনি ফেলিওর ।

v.লিভার ক্যান্সার ।

vi.হেপাটিক এনসেফালোপ্যাথি, যার ফলে চিন্তাভাবনায় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। রক্তে জমা হওয়া দূষিত

পদার্থ মস্তিষ্কে পৌঁছালে এটি হয়।

vii.গলস্টোন ।

viii.স্প্লেনোমেগালি (অগ্ন্যাশয়ের আকার বৃদ্ধি পাওয়া) ।

সিরোসিসের চিকিৎসা

সিরোসিসের চিকিৎসা নির্ভর করে যে বিষয়গুলির ওপর, তা হল — সিরোসিস কেন হয়েছে? কি কি রোগলক্ষন দেখা দিয়েছে এবং রোগটি কতদূর পর্যন্ত ছড়িয়েছে। ওষুধ, জীবন যাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন এবং সার্জারীর মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।

মেডিকেশন

সিরোসিস কি কারনে হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে চিকিৎসক যে যে ওষুধগুলি দিতে পারেন, তা হল — বিটা ব্লকার্স ও নাইট্রেটস। হেপাটাইটিসের চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক এর প্রয়োগও করতে পারেন।

জীবন যাত্রার পরিবর্তন

যদি সিরোসিস এর কারন হয়, অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান করা, তাহলে চিকিৎসক প্রথমেই অ্যালকোহল পান করা বন্ধ করতে বলবেন। চিকিৎসার প্রয়োজনে যদি শরীরের ওজন কমানোর প্রয়োজন হয়, তাহলে চিকিৎসক সেটাও করতে বলবেন। রোগী যদি অ্যাসাইটিস এ ভোগেন, তাহলে চিকিৎসক লো সোডিয়াম ডায়েট পালন করতে বলবেন।

সার্জারী

সিরোসিস যদি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যেখানে আর অন্য কোনো চিকিৎসা পদ্ধতিই কাজ করবে না, তাহলে তখন একমাত্র উপায় থাকে, লিভার ট্রান্সপ্লান্ট।

সিরোসিস কি ভাবে প্রতিরোধ করা যায়?

সুরক্ষিত ভাবে যৌন সংসর্গ করলে তা হেপাটাইটিস বি ও সি কে প্রতিরোধ করতে পারে। সমস্ত শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি, যাঁরা চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজ ও মানুষকে নানা বিপদ থেকে উদ্ধার জনিত কাজের সাথে যুক্ত আছেন, তাঁদের সবাইকে অবশ্যই হেপাটাইটিস বি এর ভ্যাক্সিনেশন করাতে হবে। অ্যালকোহল পানের পরিমান কমিয়ে দেওয়া বা একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে। সুষম খাদ্যাভ্যাস তৈরি করতে হবে এবং নিয়মিত এক্সারসাইজ করতে হবে, এর ফলে সিরোসিসের গতি ধীর করে দেওয়া যায় এবং তাকে আটকে দেওয়াও যায়। অবৈধ ড্রাগের ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে হবে। কেবলমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শেই ওষুধ খেতে হবে এবং কোনো ওষুধ যেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত দিন সেবন করা না হয়।

শেষের কিছু কথা

লিভার সিরোসিস লিভারের ক্ষতিগ্রস্ততার একদম শেষ পর্যায়। লিভার আমাদের শরীরের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি অঙ্গ এবং একবার লিভারে ক্ষত তৈরি হয়ে গেলে সেই ক্ষত পূরণ করা যায় না, শুধু চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে থামিয়ে রাখা যায়। এই অবস্থায় চিকিৎসা না হলে লিভারের কার্যক্ষমতা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। পুষ্টিকর খাদ্য, নিয়মিত এক্সারসাইজ, অ্যালকোহল পান না করা বা করলেও অতি সামান্য মাত্রায় এবং নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে শারীরিক পরীক্ষা করানো — ইত্যাদি যদি জীবনযাত্রার অঙ্গ হয়, তাহলে লিভারকে সুস্থ রাখা যায়।

Dhruba Biswas

Hi, I am Dhruba and I’m a Health Blogger. My goal is to make everyone aware of physical and mental health as well as new methods and technologies in the field of medical science.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago