সিজোফ্রেনিয়া কাকে বলে ?
সিজোফ্রেনিয়া একটি মানসিক রোগ। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির চিন্তাধারা এবং অনুভূতির প্রকাশের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে না। উদ্ভট ভাবনাচিন্তা, অলীক কিছু দেখা, অসংলগ্ন কথাবার্তা এবং অন্যরা যা শুনতে পায় না এমন কিছু শোনা এই রোগের উপসর্গ। সিজোফ্রেনিয়া শব্দের অর্থ এরকম- স্কিজ মানে মন, ফ্রেনিয়া মানে ভাঙা। চিকিৎসকেরা লক্ষ্য করেছিলেন, এই রোগ হলে মন ভেঙে যায়। আক্রান্ত ব্যক্তি কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তাঁর মনোযোগও স্থির থাকে না। চিকিৎসকরা বলছেন, সাধারণত কুড়ি বছর বয়সের শুরুর দিকে মানুষ এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। পঁয়তাল্লিশের পর এটা কমে যায়। সাধারণত পঞ্চাশ বছরের পর কেউ এই রোগে আক্রান্ত হয় না এবং পঞ্চান্ন বছরের পর নতুন করে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা খুব কম।
সিজোফ্রেনিয়া রোগের লক্ষণ
এক্ষেত্রে রোগী এমন কিছু শুনতে পায় বা দেখতে পায় বাস্তবে যেটির অস্তিত্ব নেই। যুক্তিবিহীন কথা বলা বা লেখা আপৎকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে ঔদাসিন্য নিজের যত্ন না নেওয়া কোন কাজে মনোযোগ না থাকা আবেগ ও অনুভূতি কমে যাওয়া।
সিজোফ্রেনিয়া রোগের কারণ
সিজোফ্রেনিয়ার কারণগুলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।
i.জৈব বা বায়োলজিকাল :- বায়োলজিকাল কারণগুলির তাৎপর্য বেশি। এখানেও কিন্তু বেশ কয়েকটি বিষয় একসঙ্গে সক্রিয়। প্রথমেই যদি জিনগত কারণ নিয়ে কথা বলি, লক্ষ্য করে দেখা গেছে যে এই রোগ বংশগত। সাধারণত দেখা গেছে, একশো জন মানুষের মধ্যে এক জনের সিজোফ্রেনিয়া হতে পারে। যে পরিবারে দাদার সিজোফ্রেনিয়া থাকে, সেই পরিবারের বোনের বা ভাইয়ের সিজোফ্রেনিয়া হওয়ার দশ শতাংশ আশঙ্কা থাকে। যে পরিবারে মা বা বাবার মধ্যে একজনের সিজোফ্রেনিয়া রয়েছে, তাদের সন্তানদের সিজোফ্রেনিয়া হওয়ার আশঙ্কা বারো থেকে চোদ্দ শতাংশ। যে পরিবারে বাবা-মা দুজনেই সিজোফ্রেনিয়া রোগী, তাদের সন্তানের সিজোফ্রেনিয়া হওয়ার আশঙ্কা শতকরা পঞ্চাশ ভাগ। অন্য দিকে দেখা গেছে, মনোজাইগোটিক টুইন অর্থাৎ একই ডিম্বাণু থেকে যদি যমজ সন্তান হয় এবং তাদের মধ্যে একজনের যদি সিজোফ্রেনিয়া থাকে, তাহলে আরেকজনের হওয়ার আশঙ্কা শতকরা পঞ্চাশ ভাগ। অতএব এটা স্পষ্ট যে সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার পেছনে বংশগতি অর্থাৎ ক্রোমোজোম বা জিনের প্রভাব আছে।
আমরা জানি, আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে চালায়। আবেগ, অনুভূতি, রুচি, পছন্দ সব কিছুকেই মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে। মস্তিষ্কে এমন কিছু রাসায়নিক (কেমিকাল) তৈরি হয় যেগুলি নিউরোট্রান্সমিটার বা নিউরোক্যামিক্যাল বলে পরিচিত। সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের ক্ষেত্রে ডোপামিন নামের একটি রাসায়নিক অতি সক্রিয় হয়ে ওঠে। ডোপামিনের বেশি ক্ষরণ সিজোফ্রেনিয়ার একটি অন্যতম কারণ। মস্তিষ্কের সাব কর্টিকাল অঞ্চলে অতিরিক্ত ডোপামিন ক্ষরণ হ্যালুসিনেশন এবং ডিল্যুশনের মতন উপসর্গ বাড়িয়ে দেয়।
ভুলে গেলে চলবে না যে মনোরোগের বৈজ্ঞানিক কারণ ও চিকিৎসা রয়েছে। যেমন ইনসুলিনের ঘাটতি থেকে ডায়াবেটিস হয়, তেমনি অতিরিক্ত ডোপামিন নিঃসরণ হলে সিজোফ্রেনিয়া হয়। শরীরে ইনসুলিনের ভারসাম্য সৃষ্টি করতে ডাক্তার নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে চিকিৎসা করেন। একই ভাবে ডোপামিন ক্ষরণ কমিয়ে সিজোফ্রেনিয়ার উপযুক্ত চিকিৎসা করা যায়। কয়েকটি ক্ষেত্রে সিজোফ্রেনিয়া রোগীর মস্তিষ্কের গঠনে কিছু পরিবর্তন চলে আসে। এই সব সিজোফ্রেনিয়াকে নেগেটিভ সিম্পটম সিজোফ্রেনিয়া বলা হয়। টাইপ টু সিজোফ্রেনিয়াতে রোগী অন্যদের সঙ্গে মিশতে পারে না, বেশি কথাবার্তা বলে না এবং সারা দিন এমনভাবে কাটায় যেন কোনও দিকে নজর নেই। এগুলো রোগের বায়োলজিকাল দিক বলে গণ্য।
মনস্তাত্ত্বিক বা সাইকোলজিকাল :- সাইকোলজিক্যাল কারণের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো পরিবার। পারিবারিক পরিবেশ সিজোফ্রেনিয়ার একটি কারণ হতে পারে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। হয়তো নির্দিষ্ট কোনও বিষয়ে মা ও বাবা দুধরণের কথা বলে। একই বিষয়ে দুজনে দুরকম কথা বলায় শিশুর মন নির্দিষ্ট এক দিকে পরিচালিত না হয়ে বিভাজিত হয়ে যায়। কার কথা শুনে চলা উচিৎ সে ব্যাপারে শিশু সংশয়াপন্ন হয়ে যায়। এই ব্যাপার অব্যাহত থাকলে শিশু ভবিষ্যতে সিজোফ্রেনিয়ার শিকার হয়ে যেতে পারে।
সামাজিক কারণ :- আবার দেখা গেছে, যাদের জীবনে স্থিতিশীলতার অভাব থাকে, সামাজিক চাপে তারা সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, মাদকাসক্তি এমন কি পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপের সামনে অসহায়তা থেকেও অনেক সময় সিজোফ্রেনিয়া হতে পারে।
চিকিৎসা
ওষুধ দিয়েই রোগটিকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রথমে অ্যান্টিসাইকোটিক মেডিসিন দেওয়া হয়। তারপরে সাইকোথেরাপির কথা ভাবতে হবে। চিকিৎসা চলাকালীন সিজোফ্রেনিয়ার বেশিরভাগ রোগী কয়েক দিন ভালো আবার কয়েক দিন খারাপ থাকে। অর্থাৎ বেশিরভাগ রোগী সম্পূর্ণ নিরাময় হন না। অবশিষ্ট পনেরো থেকে কুড়ি শতাংশ রোগী সুস্থ হয়ে যান। সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়। চিকিৎসকেরা বলছেন, সঠিকভাবে চিকিৎসা করলে পঞ্চাশ শতাংশ রোগী স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেন। তবে রোগীকে ডাক্তারের সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে। আবার রোগীর প্রতি তাঁর পরিবারের সদস্যদের মনোভাবও গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের সহযোগিতা ও ভালো ব্যবহার ছাড়া রোগী সুস্থ হতে পারবেন না।