পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী হল কে জানে! ধাঁ করে দাঁত বসিয়ে দিল বিধুবাবুর পায়ে। লোকজন দৌড়ে এসে কালুকে তাড়াল। এবার কী হবে? একজন বলল কার্বোলিক অ্যাসিড ঢালো, কেউ বলল ফিনাইল দাও, বিষ মরে যাবে। একজন বলল অ্যান্টিবায়োটিক লোশন দিন জলদি! শেষোক্ত বিষয়টি বিধুবাবুর খানিকটা মনে ধরল। বিধুবাবু সঙ্গে সঙ্গে দোকান থেকে এক বোতল বাজারচলতি অ্যান্টি বায়োটিক লোশন কিনে ক্ষতস্থানে ঢেলে দিলেন! আর এটাই হল সবচাইতে বড় ভুল। বহু মানুষই কুকুর কামড়ানোর পরে প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কে অবহিত থাকেন না। এর ফলে এর ওর কথায় নানা ধরনের ভ্রান্ত চিকিৎসা করান। তার মাশুল গুনতে হয় পরবর্তীকালে। চিকিৎসকরা বলছেন কুকুর কামড়ানোর পরে প্রাথমিক চিকিৎসা বলতে একটাই সমাধান রয়েচে তা হল ‘সাবান’। জলের মধ্যে যে কোনও সাবান দিয়ে ভালো করে ফেনা করুন। ওই ফেনাসুদ্ধ জল দিন ক্ষতস্থানে।
কেন সাবান জল?
কুকুরে লালায় রেবিস থাকলে ও ভ্যাকসিন না নিলে নির্ঘাৎ জলাতঙ্ক হবে। তাই সাবান জল দিয়ে ধুয়ে ফেলা একান্ত প্রয়োজন। রেবিস ভাইরাস আরএনএ ভাইরাস। রেবিস ভাইরাসের ওপর থাকে একটা চর্বির আস্তরণ। এই আস্তরণটিই রেবিসের ঢাল এবং একই সঙ্গে এই চর্বির আস্তরণটিই ভাইরাসকে নার্ভে প্রবেশ করার সুযোগ করে দেয়। এই চর্বির আস্তরণটিকে নষ্ট করে দেয় সাবানজল। ফলে মারা পড়ে ভাইরাসটি। সম্ভব হলে পিচকিরির মতো ফোর্স দিয়ে সাবান জল দিন ক্ষতস্থানে। এর ফলে ক্ষতের অনেকটা ভিতরে ভাইরাস প্রবেশ করলেও তা মারা পড়বে! এই সামান্য কাজেই রেবিস হওয়ার ৯০ শতাংশ আশঙ্কা যাবে কমে।
জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন
টিটেনাস প্রতিরোধে রেডিমেড অ্যান্টিবডি ভ্যাকসিন মানবশরীরে প্রবেশ করানো হয়, তেমনটিই হয় জলাতঙ্কের ক্ষেত্রে।
জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন দেওয়ার নিয়ম
খুব খারাপ ধরনের কামড়ের ক্ষেত্রে ক্ষতস্থানের চারপাশে অ্যান্টিসিরামের ভ্যাকসিন দিতে হয়।
কেন এমন করতে হয়? কারণ ভাইরাস ক্ষত দিয়ে প্রবেশ করার পর নার্ভে ঢোকে ও নার্ভ বেয়ে ওপরে ওঠে এবং ব্রেনে প্রবেশ করে। ফলে ক্ষতস্থানের আশপাশে ভ্যাকসিন দিলে তা ভাইরাস ওখানেই আটকে যায়। এই বিষয়টিকে বলে প্যাসিভ ইমিউনাইজেশন।
একই সঙ্গে ওই ব্যক্তিকে বুস্টারডোজ ভ্যাকসিনও দিতে হবে যাতে তাঁর শরীরের মধ্যে স্বাভাবিক রোগপ্রতিরোধী ক্ষমতাও তৈরি করা দরকার। সুতরাং কুকুরে কামড়ালে তিনটি বিষয় অত্যন্ত জরুরি—
1. প্রাথমিক চিকিৎসা বা সাবান জল দিয়ে ক্ষতস্থান ধোয়া।
2. প্যাসিভ ইমিউনাইজেশন বা ভাইরাসকে ক্ষতস্থানের আশপাশেই আটকে রাখার প্রক্রিয়া।
3. বুস্টার ইমিউনাইজেশন বা রোগীর শরীরে স্বাভাবিক অ্যান্টিবডি তৈরির পদ্ধতি। এই ভ্যাকসিন দেওয়ার মূল কারণটিই হল, কোনওভাবে প্যাসিভ ইমিউনাইজেশন প্রক্রিয়ার ফাঁক গলে ব্রেনে ভাইরাস প্রবেশর আগেই মেন ইমিউনাজেশন সক্রিয় হয়ে উঠবে ও ভাইরাসকে ব্রেনে প্রবেশের আগেই ধ্বংস করে দেবে।
ভ্যাকসিন কাজ করে কীভাবে?
আগে জলাতঙ্কের টিকা তৈরির পদ্ধতি ছিল অন্যরকম। ভেড়ার ব্রেনে জলাতঙ্কের ভাইরাস প্রবেশ করিয়ে সেখান থেকে তৈরি হতো ভ্যাকসিন। তবে এই ভ্যাকসিনে ভেড়ার ব্রেনের নানা উপাদান থেকে যাওয়ায় শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিত ও রোগীর এনকেফেলাইটিস দেখা দেওয়ার আশঙ্কা এড়ানো যেত না। এই ব্যর্থতার হাত ধরেই চিকিৎসাজগতে আসে টিস্যু কালচার পদ্ধতি। এর ফলে আর কোনও প্রাণীর দেহে জীবাণু প্রবেশ করিয়ে ভ্যাকসিন তৈরি করা হয় না। টেস্ট টিউবের মধ্যে সেল প্রবেশ করিয়ে সেখানে ভাইরাস দিয়ে তৈরি করা হয় ভ্যাকসিন। এই ধরনের ভ্যাকসিনে অন্য কোনও প্রাণী বা মানুষের কোষ বা কোষের অংশ থাকে না। তাই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার আশঙ্কাও থাকে না।
দাঁত না বসলে ভ্যাকসিন নিতে হবে না?
দাঁত বসলে তবেই ভাইরাস প্রবেশ করবে আর দাঁত না বসলে ভাইরাস প্রবেশ করবে না এমন হতে পারে না। কারণ ভাইরাস দাঁতে থাকে না। ভাইরাস থাকে প্রাণীর লালায়। দাঁত দিয়ে কামড়ানো মানে ভাইরাস শরীরের আরও গভীরে প্রবেশ করার সুযোগ পেল। আঁচড় দিলেও শরীরে ভাইরাস ঢুকতে পারে। কারণ কুকুর,-বিড়ালের প্রাণীরা তার থাবা চাটে। ফলে আঁচড় দিলে ত্বকে মাইক্রোস্কোপিক ইনজুরির মাধ্যমেই শরীরে ভাইরাস ঢুকতে পারে। এমনকী কাপড়ের ওপর দিয়ে কামড়ালেও নিতে হবে ভ্যাকসিন। রেবিসে একবার আক্রান্ত হলে প্রাণহানির আশঙ্কা ১০০ শতাংশ।
জলাতঙ্ক রোগের উপসর্গ
ভাইরাস ব্রেনে পৌঁছে গেলে তা এককথায় ব্রেনের দখল নেয়। ব্রেনের ভয়ঙ্কর ক্ষতি করে। ফলে সুস্থ ব্যক্তির মধ্যে নানান ধরনের উপসর্গ দেখা যায়—
- রোগীকে বিভ্রান্ত মনে হয়। অনিদ্রা দেখা দেয়। রোগী অস্বাভাবিক আচরণ করেন।
- মুখে লালা ক্ষরণ বেড়ে যায়।
- গলার পেশিগুলিতে সংকোচন ঘটে। রোগী খাবার বা জল গিলতে পারেন না। কথা বলতে পারনে না। শ্বাসকষ্ট হয়। প্রচণ্ড ব্যথা হয়। সামান্য জল পানের চেষ্টা করলেও পেশি সংকুচিত হতে থাকে। রোগী জল দেখলেও আতঙ্কে ভুগতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত রোগী কোমায় চলে যান ও মৃত্যু ঘটে।
নিয়মিত ভ্যাকসিনের ডোজ
কুকুর, বিড়াল, শিয়াল, ইঁদুর, বাঁদুর, ইঁদুরের, বেজি, বানরের মধ্যেও থাকে জলাতঙ্কের ভাইরাস। ফলে এই ভাইরাস নির্মূল করা অত্যন্ত জটিল ব্যাপার! তবে রেবিস ভ্যাকসিন নিখরচায় সকল সরকারি হাসপাতালেই দেওয়া হয়। তবে যাঁরা পশু চিকিৎসক বা পশু চিকিৎসালয়ে কাজ করছেন তাঁদের অবশ্যই বছরে একবার বা পাঁচবছর অন্তর জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন নিতে হবে।