জীবনের সুন্দর সুস্থ গতিশীলতা বজায় রাখতে প্রয়োজন শক্তির, আর এই শক্তি আসে আমাদের দৈনন্দিন খাবার দাবারের মাধ্যমে । এই শক্তির এক বিরাট অংশ ( ৯০০ থেকে ১৩০০ ক্যালরি যা দৈনন্দিন ক্যালরি চাহিদার ৫০-৬০ শতাংশ ) আসে কার্বোহাইড্রেট থেকে । প্রতিদিন খাবার খাওয়ার পর , ডাইজেশন এর ফলে কার্বোহাইড্রেট সরলীকৃত হয়ে গ্লুকোজে পরিনত হয় এবং রক্তের মাধ্যমে বাহিত হয় । এই রক্তে থাকা গ্লুকোজকে কোষে পৌঁছে দিয়ে জীবনধারণের প্রয়জনীয় শক্তির সরবরাহ করতে সাহায্য করে ইনসুলিন নামে এক প্রোটিন জাতীয় হরমোন । শরীরে এই হরমনের অভাব দেখা দিলে অথবা কোন কারনে কোষের রিসেপ্টর কার্যক্ষমতা হারালে রক্ত থেকে গ্লুকোজ কোষে প্রবেশ করতে পারে না ,ফলস্বরুপ রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায় যাকে ডাক্তারি পরিভাষায় ডায়াবেটিস মেলিটাস বা মধুমেহ বলা হয় । ইনসুলিন হরমোনের সম্পর্কে এক স্পষ্ট ধারনা দিতে এই লেখাটি আপনাদের কে বিশেষ ভাবে সাহায্য করবে ।
ইনসুলিন হল অগ্নাশয়ের আইলেটস অব ল্যঙ্গারহান্স গ্রন্থির বিটা কোষ থেকে ক্ষরিত একপ্রকার প্রোটিন জাতীয় হরমোন যা রক্ত থেকে কোষে গ্লকুজ শোষণে সাহায্য করে এবং রক্তে গ্লুকোজের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে । তাছাড়া বডির মেটাবলিজম , লিভারে গ্লুকোজকে সংরক্ষণে সহায়তা করে । অগ্নাশয় থেকে যখন ইনসুলিন পর্যাপ্ত পরিমানে উৎপন্ন হতে পারে না তখন রক্তে গ্লুকোজ ( শর্করার) এর মাত্রা বেড়ে যায় , আর এর নিয়ন্ত্রনের জন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রোগী ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে সিনথেটিক ইনসুলিন ( কৃত্রিম ইনসুলিন ) গ্রহন করেন ।
রোগীয় অবস্থা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী একজন ডায়াবেটিক চিকিৎসক ( এন্ডোক্রিনোলজিস্ট ) বিভিন্ন ধরনের সিনথেটিক ইনসুলিনের ব্যবস্থা করেন, এগুলি হল –
রেপিড এক্টিং ইনসুলিন – রেপিড এক্টিং ইনসুলিন বা ফাস্ট এক্টিং ইনসুলিন ডায়াবেটিক আক্রান্ত রোগীদের কে প্রয়োজন অনুযায়ী ইঞ্জেকশানের মাধ্যমে দেওয়া হয় । এটি খুব তাড়াতাড়ি সাধারনত কয়েক মিনিটের মধ্যে রক্তে মিশে যায় এবং ইঞ্জেকশান নেওয়ার চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত এর প্রভাব স্থায়ী হতে পারে । এই কারনে এটি খাবার গ্রহনের ঠিক আগে দেওয়া হয় ।
শর্ট এক্টিং ইনসুলিন – এটিও খুব তাড়াতাড়ি রক্তে মিশে যায় তবে রেপিড এক্টিং ইনসুলিন এর তুলনায় একটু দেরিতে এটি কাজ করতে শুরু করে । সাধারণত ইঞ্জেকশানের মাধ্যমে নেওয়ার ৩০ থেকে ৬০ মিনিটের মধ্যে কাজ শুরু করে এবং এটির প্রভাব ২ থেকে ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হয় ।
ইন্টারমেডিয়েট এক্টিং ইনসুলিন – এর অপর নাম ‘আইসোফেন’ অথবা এনপিএইচ ’(নিউট্রাল প্রোটামাইন হেজডর্ন) ইনসুলিন । এটির প্রভাব রোগীর দেহে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা স্থায়ী হতে পারে এবং এটি ইঞ্জেকশানের মাধ্যমে নেওয়ার ১ থেকে ২ ঘণ্টা পর কাজ শুরু করে । এই ইনসুলিন টি টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে জনপ্রিয় কারন এটি ইনসুলিন রেজিস্টেন্স এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে ।
লং এক্টিং ইনসুলিন – এই ইনসুলিন সবচেয়ে বেশি দেরিতে রক্তে মিশে , রোগী ইনজেকশন মাধ্যমে এই ইনসুলিন নেবার মোটামটি ৪ ঘণ্টা পর এটি কাজ করতে শুরু করে এবং এর স্থায়িত্ব ২৪ ঘণ্টা বা তার বেশি হয় ।
মেটাবলিজম এ ইনসুলিন – প্রতিদিনের খাবার দাবার থেকে পাওয়া গ্লুকোজ রক্তে মিশে যাওয়ার পর অগ্নাশয় ইনসুলিন ক্ষরণ করে যাতে কোষগুলি রক্তের গ্লুকোজকে সেলুলার মেটাবলিজমের জন্য ব্যবহার করতে পারে ।
রক্তে গ্লুকোজের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রন – ইনসুলিন রক্তে গ্লুকোজের ঘনত্ব কে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে । রক্তে গ্লুকোজের পরিমান কমার সঙ্গে সঙ্গে ইনসুলিনের পরিমানও কমে যায় যাতে ব্যক্তির হাইপোগ্লাইসেমিয়া না হয় এবং রক্তে গ্লুকোজের পরিমান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইনসুলিনের পরিমানও বেড়ে যায় । এই ভাবে ইনসুলিন রক্তে গ্লুকোজের ভারসাম্য বজায় রাখে ।
লিভারে অতিরিক্ত গলুকজের সংরক্ষণ – ইনসুলিন রক্তস্থিত অতিরিক্ত গ্লুকোজ লিভারে গ্লাইকোজেন রুপে সঞ্চয়ের জন্য প্রয়োজনীয় এবং অন্যান্য এনজাইমগুলিকে সক্রিয় করে। এর মধ্যে দুটি এনজাইমকে গ্লাইকোজেন সিনথেস এবং ফসফ্রফ্রোকটোকাইনেজ বলা হয়। লিভারে ইনসুলিনের এই সাধারণ ভূমিকা গ্লুকোজ সংরক্ষণের জন্য দায়ী।
কোনও কারনে অগ্নাশয় পর্যাপ্ত পরিমানে ইনসুলিন উৎপন্ন করতে না পারে তবে রক্তে গ্লুকোজের পরিমান বেড়ে যায় যাকে টাইপ ১ ডায়াবেটিস বলা হয় । এই ক্ষেত্রে রোগীকে ইনসুলিন ইনজেকশন নেওয়ার কথা বলা হয়ে থাকে । আবার অনেক ক্ষেত্রে রক্তে পর্যাপ্ত ইনসুলিন থাকে কিন্তু কোষগুলি ইনসুলিন রেসিস্টেন্স হওয়ার কারনে গ্লুকোজকে ব্যবহার করতে পারে না , এই অবস্থা কে টাইপ ২ ডায়াবেটিস বলা হয়ে থাকে । টাইপ ২ ডায়াবেটিসেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইনসুলিন ইনজেকশন নেওয়ার কথা বলা হয়ে থাকে ।
কখনো কখনো ইনসুলিন প্রয়োজনের তুলনায় বেশী উৎপন্ন হয় এবং রক্তে গ্লুকোজের অভাব সৃষ্টি করে যাকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বলা হয় । এক্ষেত্রে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা প্রতি ডিসিলিটার (মিলিগ্রাম / ডিএল) 70 মিলিগ্রাম বা একটি লিটারে 3.9 মিলিমোল (মিমোল / এল), বা তার চেয়ে নীচে নেমে যায় । হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলে শরীরে বিভিন্ন রকমের অস্বাভাবিক অবস্থা যেমন খিঁচুনি,চেতনা লোপ, অস্পষ্ট দৃষ্টি , ক্ষুধা,উদ্বেগ ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে । অবস্থা স্বাভাবিক ভাবে ফিরিয়ে আনার জন্য সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ গ্লুকোজ যুক্ত খাবার বা পানীয় দেওয়া যেতে পারে ।
ইনসুলিন তখন হয় যখন কোন ব্যক্তির পেশী, ফ্যাট এবং লিভারের কোষগুলি ইনসুলিনের পক্ষে ভাল প্রতিক্রিয়া দেয় না এবং শক্তির জন্য রক্ত থেকে গ্লুকোজ ব্যবহার করতে পারে না। এটি তৈরির জন্য, অগ্ন্যাশয় আরও ইনসুলিন তৈরি করে এবং সময়ের সাথে সাথে রক্তে গ্লুকোজের পরিমান বাড়িয়ে দেয় । ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স সিন্ড্রোমে স্থূলত্ব, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরলের মতো সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ।তবে অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলত্ব ছাড়াই ইনসুলিন রেজিস্টেন্স হওয়া সম্ভব।
ইনসুলিন রেজিস্টেন্সের কারণ কী সঠিক ভাবে তা পরিষ্কার নয়, তবে টাইপ 2 ডায়াবেটিসের পারিবারিক ইতিহাস, ওজন বেশি হওয়া এবং বেশী বসে বসে কাজ ( সেডেন্টারি লাইফস্টাইল ) করা ইনসুলিন রেজিস্টেন্সের ঝুকি বাড়ায় । ইনসুলিন রেজিস্টেন্সের জন্য কারো যে অতিরিক্ত ওজনের হতে তার কোন মানে নেই । আর কারো স্থুলত্য দেখেই বোঝা যায় না যে ব্যক্তির ইনসুলিন রেজিস্টেন্সে আছে কি না ।
সাধারনত , ইনসুলিন রেজিস্টেন্সের কোনও লক্ষণ নেই । রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা উপর দিকে পরিচালিত হলেই লক্ষণগুলি দেখা দিতে শুরু করে। যখন এটি ঘটে, তখন যে সব লক্ষণগুলি দেখা দিতে পারে –
শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানোর মাধ্যমে , পর্যাপ্ত ঘুম , স্ট্রেস বিহীন জীবন যাপন , এক্সারসাইজের মাধ্যমে ইনসুলিন রেজিস্টেন্সেকে এড়ানো সম্ভব । তাই যদি আপনি ডায়াবেটিসের রোগী নাও হন, তবু নিজের জীবন সুস্থভাবে বাঁচতে প্রতিদিন এগুলি সঠিক ভাবে অভ্যাস করুন ।
মাত্রাতিরিক্ত ইনসুলিন গ্রহন করলে উদ্বেগ ,কনফিউশন ,অস্থির ঘুম , অতিরিক্ত ক্ষুধা, অস্বাভাবিক ক্লান্তি ,দুর্বলতা , দুঃস্বপ্ন সহ অন্যান্য লক্ষণ দেখা দিতে পারে ।
কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…
ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…
সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…
পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…
কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…
ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…
This website uses cookies.
Read More
Leave a Comment