মাইগ্রেন কাকে বলে ?
মাইগ্রেন একধরনের তীব্র মাথাব্যথা। ল্যাটিন শব্দ Hemicrania (হেমি মানে অর্ধেক এবং ক্রানিয়া অর্থ মাথার খুলি) মানে মাথার এক দিকে ব্যথা। এই শব্দটির ফরাসি অপভ্রংশ মাইগ্রেন ইংরিজি ভাষায় গৃহীত হওয়ার পর তীব্র ও টানা মাথাব্যথার অভিধা হিসেবে দুনিয়া জুড়ে পরিচিত হয়ে গেছে। বাংলাতেও ‘আধকপালি’ ব্যথা একটি পরিচিত শব্দ। মাথার একটা দিকে মাইগ্রেন হয় বলে শোনা গেলেও দুদিকেও হতে দেখা যায়। যাদের মাইগ্রেন হবার প্রবণতা আছে, তাদের কতকগুলো ব্যাপার থেকে দূরে থাকাই ভালো। প্রবল শব্দ, আলো, গন্ধ, বাতাসের চাপের তারতম্য ও কিছু খাবার যেমন চকলেট, আঙুরের রস, পনির ইত্যদির প্রভাবে নতুন করে ভয়ঙ্কর মাথাব্যথা শুরু হতে পারে।
পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি চার জন মহিলার মধ্যে এক জন মাইগ্রেনের সমস্যায় ভোগেন। অন্য দিকে, প্রতি বারো জন পুরুষের মধ্যে এক জন জীবনের কোনও না কোনও পর্যায়ে মাইগ্রেনের জেরে কষ্ট পান।
মাইগ্রেনের উপসর্গ
সাধারণত মাইগ্রেন হলে বমিবমি ভাব, ফটোফোবিয়া ও চোখে ভুল দেখার মতো উপসর্গ সৃষ্টি হয়।
মেনস্ট্রুয়াল মাইগ্রেন :- মাসিক ঋতুস্রাবের সময়ে অনেক মেয়ের তীব্র মাথাব্যথা হয়। এই মাথাব্যথার লক্ষণ মাইগ্রেনের সাধারণ সব উপসর্গের মতোই। তবে মেনস্ট্রুয়াল মাইগ্রেন সাধারণত পিরিয়ডের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। পিরিয়ড শুরু হওয়ার সময় এবং দুটি ঋতুচক্রের মাঝের সময়ে এই ধরনের মাইগ্রেন দেখা যেতে পারে।
মাইগ্রেনের কারণ
মাইগ্রেন কেন হয় এখনও স্পষ্ট জানা সম্ভব হয়নি। তবে কিছু গবেষণায় জানা গিয়েছে, মস্তিষ্কের ভেতরে কয়েকটি রাসায়নিকের সক্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মাইগ্রেনের সমস্যা ফিরে ফিরে আসে। তবে কোন কোন রাসায়নিকের জন্য এই অসুবিধা চাগাড় দেয় এখনো পরিষ্কার বোঝা যায়নি। গবেষণা চলছে। একটি পরিবারের একাধিক সদস্যের মধ্যে মাইগ্রেন হতে পারে। অতএব বংশে এই রোগ থাকলে, পরিবারের যে কারো হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অবসাদ ও মাইগ্রেন
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান মাইগ্রেনের সঙ্গে অবসাদের একটা যোগসূত্র আবিষ্কার করেছে। দেখা যাচ্ছে, যে সব মানুষ পুরনো মাইগ্রেন রোগে কষ্ট পান তাঁরা প্রায়শই অবসাদে ভোগেন। অবসাদের পাশাপাশি অনেক সময় তাঁদের প্রবল উদ্বেগ বা Anxiety Disorder হয়। দীর্ঘ সময় ধরে মাইগ্রেনে ভুগছেন এমন অনেকের ভাবনাচিন্তা ও সৃজন করার ক্ষমতাও লোপ পায়। মাইগ্রেন রোগীদের কড়া আলো সহ্য হয় না বলে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকতে ভালো লাগে। এই কারণে তাঁরা জীবনকে ঠিকমতো উপভোগ করতে পারেন না। অসহ্য যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁরা অতিরিক্ত মদ্যপান অথবা নিষিদ্ধ ওষুধ খেতে শুরু করেন। কারো কারোর মধ্যে আবার কোনও একটি ওষুধ বেশি পরিমাণে খাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। মুঠো মুঠো পেনকিলার খেয়েও রেহাই পেতে চান অনেকে। ফলে অসংখ্য গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
পুরনো মাইগ্রেন এমন একটা রোগ যাকে এক সময় ‘Transformative’ বলা হত অর্থাৎ এই অসুখ মানুষের দেহে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারে বলে চিকিৎসকদের ধারণা ছিল। যে মাথাব্যথা পনেরো দিন, এক মাস এমন কি তিন মাসেরও বেশি স্থায়ী হয়, তাকেই বলা হয় মাইগ্রেন। খুব স্বাভাবিক যে যারা ব্যথায় একটানা কষ্ট পান তাঁরা অবসাদে ভুগতে শুরু করবেন। গবেষণা বলছে, যে সব রোগী কোমরের নিচের অংশের ব্যথা সহ অন্য ধরণের টানা ব্যথায় ভোগেন তাঁদের তুলনায় মাইগ্রেন রোগীদের অবসাদগ্রস্ত হওয়ার হার বেশি। এজন্য সিদ্ধান্তে আসাই যায় যে মাইগ্রেন ও মেজাজের খাপছাড়া পরিবর্তনের মধ্যে কোনও সম্পর্ক আছে যা ক্রমাগত মাথাব্যথার জন্য নাও হতে পারে।
এই সম্পর্কটা ঠিক কিরকম তা অস্পষ্ট তবে অনেকভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। অবসাদ জাতীয় মেজাজের যে কোনও খাপছাড়া পরিবর্তনের পেছনে মাইগ্রেনের কোনও ভূমিকা থাকতে পারে আবার উল্টোটাও হতে পারে। কখনো কখনো আলাদা করে মাইগ্রেন ও অবসাদ কিন্তু পরিবেশ থেকেও সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তবে এই সম্পর্ক সবটাই অস্পষ্ট তা হতে পারে। দুটি রোগের ভেতরে যে সম্পর্ক থাকবেই এমন কথাও নিঃসন্দেহে বলা যায় না।
যাদের ঘন ঘন মাইগ্রেন হয় তাঁরা জীবন থেকে কোনও আনন্দ পান না এমন কথা নিজেরাই বলেন। মাইগ্রেনের সঙ্গে অবসাদ (depression) অথবা উদ্বেগ থাকলে কাজকর্ম ভালো না পারা ও কোনও ব্যাপার থেকে আনন্দ না পাওয়া খুব স্বাভাবিক। অনেক অবসাদের রোগী আবার বলেন, অবসাদের পরে তাঁদের মাথা ব্যথা বেড়ে যায়।
এখানে মনে রাখতে হবে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে কষ্টকর টানা মাথাব্যথাকে মাইগ্রেন উইথ অরা বা ক্লাসিক মাইগ্রেন বলা হয়। মাইগ্রেন উইথ অরা-য় ভুগলে রোগী চোখের সামনে আলোর ঝলকানি বা কালো কালো দাগ দেখতে পান। কারো কারো আবার হাতে ও মুখে অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়। যাঁরা এই ধরণের জটিল মাইগ্রেনে ভোগেন, অন্য মাইগ্রেন রোগীদের তুলনায় তাঁদের অবসাদগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
![](https://www.healthinside.in/wp-content/uploads/2023/04/dpsn.jpg)
মাইগ্রেনের চিকিৎসা
পুরনো মাইগ্রেনের সঙ্গে অবসাদ যুগপৎ দেখা দিলে অবসাদের ওষুধের মাধ্যমে দুটি সমস্যারই চিকিৎসা সম্ভব। তবে ফিল গুড হরমোন সেরোটোনিনযুক্ত যে সব বাছাই করা SSRI ওষুধ দেওয়া হয় সেগুলোকে ট্রিপ্টান ওষুধের সঙ্গে মিশিয়ে যেন প্রয়োগ করা না হয়। এই দুই ধরণের ওষুধ এক সঙ্গে প্রয়োগ করা হলে তারা পরস্পরকে প্রভাবিত করে সেরোটোনিন সিনড্রোম নামে একটি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে যা বিরল কিন্তু বিপজ্জনক। মাথায় খুব বেশি সেরোটোনিন থাকলে এই প্রাণঘাতী পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। SSRI এবং একই রকম SSNRI গোত্রের ওষুধপত্র অবসাদের প্রচলিত ওষুধ যেগুলো সেরোটোনিন ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়।
মাইগ্রেনের ওষুধ
ট্রিপ্টান হল এমন ধাঁচের আধুনিক ওষুধ যেগুলো দিয়ে মাইগ্রেনের চিকিৎসা করা হয়। মাথায় সেরোটোনিনের যে সব গ্রাহক কোষ রয়েছে সেগুলোকে ঠিকমতো কাজ করতে সহায়তা করে এই সব ওষুধ যার ফলে রক্তনালীগুলোর স্ফীতি কমে যায় এবং মাইগ্রেনের কষ্ট দূর হয়। আপাতত প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে সাত ধরণের ট্রিপ্টান জাতীয় ওষুধ পাওয়া যায়। আরো একটি ওষুধ আছে যা ট্রিপ্টান প্রেসক্রিপশনের সঙ্গে একযোগে সহজলভ্য ব্যথার ওষুধ ন্যাপ্রোক্সেন সমেত একত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে। ট্রিপ্টান ওষুধের ব্র্যান্ড নামগুলো হল- অ্যামার্জ, অ্যাক্সার্ট, ফ্রোভা, ইমিট্রেক্স, ম্যাকজাল্ট, রেলপাক্স, ট্রেক্সিমেট, জেকুইটি ও জোমিগ।
এই সব ওষুধ একাধিক ভাবে প্রয়োগ করা যায়- মুখে খাওয়া যায়, নাকের মাধ্যমে স্প্রে করা যায়, ইঞ্জেকশন এবং চামড়ায় স্কিন প্যাচ-এর সাহায্যে দেওয়া যায়। একটি অলাভজনক ক্রেতা সুরক্ষা সংস্থা সব ট্রিপ্টান ওষুধের দাম ও কার্যকারিতা পর্যালোচনা করে জানাচ্ছে, Generic Sumatriptan কিনলে রোগীদের সবচেয়ে সুবিধা।
প্রতিরোধ
এখনকার চিকিৎসকেরা মাইগ্রেন প্রতিরোধ করে রোগীদের নিস্কৃতি দেওয়ার কথাও ভাবছেন। উল্লেখ্য মাইগ্রেন হওয়ার পর চিকিৎসার ক্ষেত্রে ট্রিপ্টান জাতীয় ওষুধ কাজ দেয়। এ জাতীয় ওষুধ তীব্র মাথাব্যথা হওয়া আগের থেকে আটকাতে পারে না। বেটা ব্লকার, কয়েকটি অবসাদের ওষুধ, মৃগীরোগ প্রতিরোধ করার ওষুধ এবং CGRP receptor antagonists জাতীয় ওষুধের মাধ্যমে মাইগ্রেন প্রতিরোধ করা যায়। এগুলোর সতর্ক প্রয়োগ করে জানা সম্ভব কি কি কারণে মাইগ্রেন চাগাড় দেয়। সমস্যা চাগিয়ে ওঠার কারণ চিহ্নিত করতে পারলে সেগুলিকে পাশ কাটিয়ে মাইগ্রেন প্রতিরোধ করা সোজা হয়ে পড়ে।
সাবধানতা এবং খাদ্য ও জীবনযাত্রা
বেশি দুশ্চিন্তা না করাই ভালো। মানসিক উদ্বেগ কমাতে যোগব্যায়াম ও ধ্যান কাজে আসে। এবার একটু দেখে নেওয়া যাক, কি কি জিনিস সেবন করলে মাইগ্রেন হয়ে যেতে পারে। বিশেষ কিছু খাবার, ক্যাফেইন বা ক্যাফেইনযুক্ত খাদ্য ও সুরাপান মাইগ্রেনের কারণ হতে পারে। এ ছাড়া চড়া রোদে টানা সময় কাটানো, অনেকক্ষণ পরপর খাওয়া, বিমানে ভ্রমণের পর ক্লান্তি (জেট ল্যাগ), দেহে জল কমে যাওয়া বা ডিহাইড্রেশন এবং অস্বাভাবিক মানসিক চাপ থেকেও মাইগ্রেন হওয়ার আশঙ্কা থাকে।