সুস্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টি খুবই প্রয়োজনীয়। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বিপাক ক্রিয়ার ভীষণ ক্ষতি করে এবং তার ফলে যেমন ওজন বৃদ্ধি ঘটে, তেমন শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেমন, যকৃৎ, কিডনি ইত্যাদিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়াও আরো যেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা হল আমাদের ত্বক।
খাদ্য ও আমাদের শরীর সম্পর্কে যত গবেষণা হয়েছে, তত জানা গিয়েছে যে, ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে এবং তার তারুণ্য ধরে রাখতে সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্যের একটি ভীষণ বড় ভূমিকা আছে। ত্বকের সুস্বাস্থ্য ও তারুণ্য ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় 11 টি ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধির খাবার সম্পর্কে আলোচনা করা হল—
১) তৈলাক্ত মাছ : তৈলাক্ত মাছ, যেমন – সালমন, ম্যাকারেল, হেরিং, ইলিশ, পমফ্রেট, ইত্যাদি ত্বকের সুস্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ উপযোগী। এই মাছগুলো ওমেগা – ৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের অত্যন্ত উপযুক্ত উৎস এবং ওমেগা –৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সুন্দর ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ত্বকের জন্য খুব দরকারী।
ত্বকের তারুণ্য, আর্দ্রতা ধরে রাখতে গেলে শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে ওমেগা – ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকা দরকার। এমনকি শরীরে ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের ঘাটতি ত্বকের শুষ্ক ভাবের জন্য দায়ী হয়ে থাকে।
মাছের ভেতর থাকা ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিড প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে রাখে, ফলে ব্রন ও লালভাব দূর করতে সাহায্য করে এবং সূর্যের ক্ষতিকর UV-ray থেকেও ত্বককে রক্ষা করে এবং এই ray এর বিরুদ্ধে ত্বকের সহনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে।
তৈলাক্ত মাছ ভিটামিন ই এর একটি ভালো উৎস। ভিটামিন ই ত্বকের সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ত্বকের জন্য খুব প্রয়োজনীয়। ফ্রি র্যাডিক্যালস এর হাত থেকে ত্বককে রক্ষা করাও ভিটামিন ই এর একটা বড়ো কাজ। এই ধরনের মাছ প্রোটিনেরও ভালো উৎস। প্রোটিন ত্বকের তারুণ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
সবশেষে বলা যায়, যে এই তৈলাক্ত মাছে বেশি পরিমানে জিঙ্ক থাকে। জিঙ্ক ত্বকের সামগ্রিক উন্নতি ঘটাতে এবং ত্বকের নতুন কোশ জন্মাতে প্রধান ভূমিকা পালন করে।
২) অ্যাভোক্যাডো : অ্যাভোক্যাডো ভালো ফ্যাটে সমৃদ্ধ, যা সমগ্র শরীরের সুস্থতার সাথে সাথে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ত্বকের জন্য প্রয়োজনীয়। ত্বককে নমনীয় ও আর্দ্র রাখার জন্য এই ফ্যাট খুব দরকার হয়। সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মির ফলে আমাদের ত্বকে বলিরেখা ও বয়সের ছাপ দেখা যায়। অ্যাভোক্যাডোতে যে ধরনের ফ্যাট পাওয়া যায় তা ত্বককে সূর্যের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচতে সাহায্য করে। অ্যাভোক্যাডো ভিটামিন ই এরও খুব ভালো উৎস এবং এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে পরিপূর্ণ যা ত্বককে সামগ্রিক ভাবে রক্ষা করে।
ভিটামিন ই এর সাথে সাথে ভিটামিন সিও ত্বকের সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়। ভিটামিন সি কোলাজেন তৈরিতে সহায়তা করে, যা কিনা ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখার প্রধান উপাদান। ১০০ গ্রাম অ্যাভোক্যাডো রোজের প্রয়োজনের ১৪% ভিটামিন ই এবং ১১% ভিটামিন সি এর চাহিদা পূরণ করে।
৩) আখরোট : আখরোটে এসেন্সিয়াল ফ্যাটি অ্যাসিড আছে, যা আমাদের শরীর নিজে থেকে তৈরি করতে পারে না। অন্যান্য সমস্ত বাদামের থেকে আখরোটে ওমেগা–৩ ও ওমেগা–৬ ফ্যাটি অ্যাসিড সবথেকে বেশি পরিমানে থাকে। অতিরিক্ত পরিমানে ওমেগা–৬ ফ্যাটি অ্যাসিড খাদ্যে থাকলে ত্বকের প্রদাহ যেমন, সোরিয়াসিস দেখা দিতে পারে, অন্যদিকে ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিড শরীরের ও ত্বকের প্রদাহ নিয়ন্ত্রন করে। আখরোটে ওমেগা–৩ ও ওমেগা–৬ ফ্যাটি অ্যাসিডের অনুপাত খুব সুন্দর থাকায় ওমেগা–৬ ফ্যাটি অ্যাসিডের সমস্যাগুলির সাথে সুন্দর ভাবে লড়াই করতে পারে।
এছাড়া আখরোটের অন্যান্য পুষ্টিগুন আছে, যা ত্বককে ভালো রাখার জন্য প্রয়োজনীয়। আখরোটের একটি প্রধান উপাদান হল জিঙ্ক। ত্বকের তারুণ্য বজায় রাখতে এবং দ্রুত ক্ষত নিরাময় করতে এবং প্রদাহ ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে জিঙ্ক প্রয়োজন হয় ।
৪) সূর্যমুখীর বীজ : সাধারন ভাবে বীজ ও বাদামে থাকা পুষ্টি ত্বকের সামগ্রিক স্বাস্থ্যোজ্জ্বলতার জন্য প্রয়োজনীয়। ২৮ গ্রাম সূর্যমুখীর বীজে দৈনিক প্রয়োজনের ৪৯% ভিটামিন–ই, ৪১% সেলেনিয়াম, ১৪% জিঙ্ক এবং ৫.৫ গ্রাম প্রোটিন থাকে।
৫) মিস্টি আলু : উদ্ভিদ থেকে আমরা বিটা ক্যারোটিন পেয়ে থাকি। এই বিটা ক্যারোটিন আমাদের শরীরে প্রবেশ করে ভিটামিন–এ তে পরিনত হয়ে থাকে। কমলালেবু, গাজর, পালং শাক, মিস্টি আলুতে বিটা ক্যারোটিন থাকে। ১০০ গ্রাম বেকড মিস্টি আলুতে যে পরিমান বিটা ক্যারোটিন থাকে তা ভিটামিন-এ এর দৈনন্দিন চাহিদার থেকে ৬ গুন বেশি পরিমানে থাকে। বিটা ক্যারোটিন এর মতোই ক্যারোটিনয়েডও সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মির প্রভাব থেকে ত্বককে রক্ষা করে এবং প্রাকৃতিক সানস্ক্রিনের মতো কাজ করে। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বককে সানবার্ন থেকে রক্ষা করে এবং তার সাথে ত্বকের শুষ্কতা, বলিরেখা থেকেও রক্ষা করে।
খুব বেশি পরিমানে বিটা ক্যারোটিন গ্রহণ করলে ত্বকের রঙে একটা উষ্ণ, কমলা আভা তৈরি হয় ফলে সামগ্রিক ভাবে ত্বককে তরুন ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল দেখায়।
৬) লাল ও হলুদ বেল পেপার : মিস্টি আলুর মতোই বেল পেপারও বিটা ক্যারোটিন এর একটি বড় উৎস, যা শরীরে ভিটামিন-এ উৎপন্ন করে। এগুলি ভিটামিন–সি এরও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ উৎস, যা শরীরে কোলাজেনের উৎপাদন করে।
৭) ব্রকোলি : ব্রকোলি ভিটামিন-এ, ভিটামিন–সি, জিঙ্ক ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের ভিটামিন ও মিনারেলস এ পরিপূর্ণ। ব্রকোলিতে লুটেইন নামক বিটা ক্যারোটিন থাকে, যা ত্বককে অক্সিডেটিভ ড্যামেজ যেমন, শুষ্কতা, বলিরেখা ইত্যাদি থেকে রক্ষা করে।
এছাড়াও ব্রকোলির ফুলে সালফোরাফেন নামক বিশেষ প্রকার উপাদান থাকে, যা অ্যান্টিক্যান্সার হিসাবে কাজ করে এবং ত্বকের বিভিন্ন প্রকারের ক্যান্সারের থেকেও রক্ষা করে। এটি দুই রকম ভাবে কাজ করে, যেমন— ক্ষতিকর ফ্রি–র্যাডিক্যালস কে নিষ্ক্রিয় করে এবং সেই সাথে শরীরের রক্ষাকারী ও প্রতিরোধী ক্ষমতাকে ত্বরান্বিত করে। গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি যে পরিমাণে ত্বকের কোশগুলিকে মেরে ফেলে, সালফোরাফেনের উপ্সথিতি তাকে অনেকাংশেই কমিয়ে দিচ্ছে এবং অবশ্যই এটি কোলাজেন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
৮) টমাটো : টমাটো ভিটামিন-সি এর গুরুত্বপূর্ণ উৎস এবং লাইকোপেন (lycopene) সহ সমস্ত ধরনের ক্যারোটিনয়েড এ পরিপূর্ণ।
এটা প্রমাণিত যে এরা প্রত্যেকেই ত্বককে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষা করে এবং বলিরেখা থেকেও ত্বককে রক্ষা করে। টমাটো তে প্রচুর পরিমানে ক্যারোটিনয়েড পাওয়া যায় এবং এর সাথে ফ্যাট জাতীয় খাদ্য, যেমন চিজ, অলিভ অয়েল খাওয়া দরকার, কারন ফ্যাট শরীরে ক্যারোটিনয়েড এর শোষনে সহায়তা করে।
৯) সয়াবিন : সয়াবিনে যে উদ্ভিজ্জ উপাদানটি থাকে সেটি হল আইসোফ্ল্যাবন্স (Isoflavones), যা শরীরে ইস্ট্রোজেন কে নকল করতে পারে অথবা তাকে ব্লক করে দিতে পারে। শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সাথে সাথে এটি ত্বকেরও উন্নতি ঘটায়।
সমীক্ষায় দেখা গেছে যে মেনোপজের পরবর্তীতে মহিলাদের ত্বকের শুষ্কতা রোধ করতে এবং কোলাজেন বৃদ্ধিতে সয় বেশ সহায়তা করে এবং ক্ষতিকর ইউ–ভি রে থেকে রক্ষা করে ত্বকের ক্যান্সার থেকে বাঁচায়।
১০) ডার্ক চকোলেট : যাঁরা চকোলেট খেতে ভালোবাসেন তাঁদের জন্য এটি একটি অত্যন্ত আনন্দের খবর। ত্বকের ওপর কোকোর প্রভাব খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে পরিপূর্ণ যা ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখে, শুষ্কতা নিয়ন্ত্রন করে, রক্ত চলাচলের মাত্রা বৃদ্ধি করে এবং ত্বকের সেনসিটিভিটি কেও নিয়ন্ত্রনে রাখতে সাহায্য করে।
তবে আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে তেমন চকোলেটই আমার খাওয়ার জন্য বেছে নেব, যাতে ৭০% কোকো থাকবে এবং শর্করার পরিমাণ খুবই সামান্য থাকবে।
১১) গ্রিন টি : গ্রিন টি ত্বকে বয়সের ছাপ পড়া ও ত্বকের সামগ্রিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। Catechins নামক পদার্থটি গ্রিন টি তে প্রচুর পরিমানে থাকে, যা বিভিন্ন ভাবে ত্বকের সামগ্রিক উন্নতিতে সাহায্য করে। অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে পরিপূর্ণ খাদ্যের মতোই গ্রিন টি ত্বককে সান ড্যামেজ থেকে রক্ষা করে। গ্রিন টি ত্বকের আর্দ্রতা ও ইলাস্টিসিটি বৃদ্ধি করে এবং সেই সাথে ত্বকের শুষ্কতা নিয়ন্ত্রন করে। তবে মাথায় রাখতে হবে, যে গ্রিন টি দুধ ছাড়া খেতে হবে, কারন গ্রিন টি তে দুধ মেশালে তার অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পরিমান কমে যায়।
আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে আমাদের খাদ্যাভ্যাস আমাদের ত্বকের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। তাই সমস্ত ভিটামিন ও মিনারেলে পরিপূর্ণ খাবার আমাদের বেছে নিতে হবে। স্বাস্থ্যকর খাদ্য স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ত্বকের প্রধান শর্ত।