বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে, প্রতিটি মানুষের জীবনেই আমূল পরিবর্তন আসে। নতুন মানুষের সান্নিধ্য, ভালোবাসা-ভালোলাগার মধ্য দিয়ে মানষিক, শারীরিক ও ইমোশনাল এটাচমেন্ট তৈরি হয়। তার সাথে নতুন জীবনের কর্তব্য-দায়িত্ব, অভ্যাস, ব্যবহার এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে নতুন পরিবারের নতুন সদস্যদের সাথে সহাবস্থান ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় বিবাহের সাথে জড়িত। কিন্তু, বিভিন্ন কারনে কিছুদিন অথবা কিছু বছর পর যখন বিবাহ বিচ্ছেদ এর মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি ঘটে তখন তা তীব্র মানষিক পীড়া দেয়।
পারিবারিক সমস্যা, আর্থিক সমস্যা, বোঝাপড়ার অভাব, মন ও মতের অমিল, পরোকীয়া জনিত সম্পর্কের জটিলতার কারনে ডিভোর্সের আগে থেকেই মানষিক অস্থিরতা ভোগ করতে হয়। ডিভোর্সের পর সামাজিক ও পারিবারিক প্রবঞ্চনা, জীবনধারার পরিবর্তন, ভালোবাসার মানুষটির সান্নিধ্য হারানো জনিত বিষয়গুলি সেই অস্থিরতাই বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। ফলে ভুক্তভোগীদের মনে হয় জীবনের সমস্ত আনন্দ, আশা শেষ হয়ে গেছে। অনেকে মানসিক অবসাদ ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে শেষপর্যন্ত জীবনের ইতি টানার সিদ্ধান্তও গ্রহন করেন। কিন্তু, মনে রাখুন, কোন সমস্যাই স্থায়ী হয়না। কিছুসময় পর সব ঠিক হয়ে যায়। তাই ডিভোর্স হলেও তাতে আপনার আশা আকাঙ্ক্ষা শেষ হয়না।
বিবাহ বিচ্ছেদের যন্ত্রণা কাটিয়ে পুনরায় জীবনকে উপভোগ করার কিছু টিপস-
মেনে নিনঃ-বিচ্ছেদ ঘটবে এই চিন্তা কোনো বিবাহিত দম্পতির কল্পনাতেও আসেনা। সবাই ভাবে ছোট বড়ো সমস্যা তো সব সম্পর্কেই হয়। সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ভাবনা অনুযায়ী সব ঠিক হয়না, শেষমেষ ডিভোর্স হয়। সেসময় আরেকবার কি সবকিছু ঠিক করার শেষ একটা চেষ্টা করা যেতনা? জাতীয় চিন্তা ভাবনা বারবার মনে আসে। আসলে, এই ধরনের ভাবনার উদ্রেক হওয়া খুবই স্বাভাবিক। যে সমস্ত রঙিন কল্পণা বিয়ের সময় থাকে সেইসব ভেঙে যাওয়ার ফলে ডিপ্রেশন দেখা দেয়। তাও, নিজেকে মিথ্যে সান্ত্বনা দেওয়ার বদলে মেনে নিন আপনার বিয়ে ভেঙে গেছে বা ভাঙতে চলেছে। ব্যাপারটি, মেনে নেওয়া অবশ্যই কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ। কিন্তু, সত্যিটা যত তাড়াতাড়ি আপনি মানতে পারবেন তত তাড়াতাড়ি জীবনের পরের পদক্ষেপ গ্রহন করতে পারবেন।
নিজের অনুভূতি গুলোকে জায়গা দিনঃ- টক্সিক ও অত্যাচারী সঙ্গীর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক থাকলে ডিভোর্সের পরে আপনি একাধারে মুক্তি ও শান্তি অনুভব করবেন। তেমনই আবার কেন আপনাকেই এই ধরনের যন্ত্রণার সম্মুখীন হতে হয়েছিল সেই ভেবে দুঃখ পাবেন। আবার অনেকক্ষেত্রে স্টকহোম সিনড্রোম জাতীয় ডিসওর্ডারে ভোগে অনেকে। ভুক্তভোগীরা সঙ্গীর বর্বরোচিত অত্যাচারকে ভালোবাসা প্রকাশের ধরন বলে জাস্টিফাই করে মনকে সান্ত্বনা দেন। সঙ্গী তৃতীয় ব্যক্তির জন্য বিশ্বাসঘাতকতা করলে রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ, হতাশা অনুভব করার পাশাপাশি আগের থেকেও বেশি ভালোবাসার চেষ্টাও অনেকের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। কেন এতো ভালোবাসার পরেও একসাথে থাকা গেলনা, সেই ভেবে দুঃখ ও ঈর্ষার পাশাপাশি মানষিক অস্থিরতা দেখা যায়। প্রতিটি অনুভূতি ধ্রুবসত্য। ডিভোর্সের পর এই অনুভূতি গুলোকেও জায়গা দিন। যা হওয়ার ছিল, হয়ে গেছে। নতুন জীবনে অভ্যস্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে এই সমস্ত অনুভূতি ধীরে ধীরে মুছে যাবে। এক্ষেত্রে বেশি উপকার পাওয়ার জন্য মেডিটেশন করুন। নিজের যত্ন নিন, কাছে পিঠে ঘুরতে যান।
প্রিয় মানুষগুলির সান্নিধ্যে থাকুনঃ- চুড়ান্ত মানষিক বিপর্যয়ের সময়ে ইমোশনাল সাপোর্টিভ মানুষগুলির সান্নিধ্যে থাকা আপনার সামগ্রিক উন্নতির জন্য ভীষণ প্রয়োজনীয়। ডিভোর্সের মানষিক যন্ত্রণা অতিক্রম করার জন্য পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের কাছে আপনি থাকার জায়গা (যদি না থাকে) বাচ্চাদের দেখাশোনা ও ইমোশনাল গাইডেন্স পাবেন। তবে নেতিবাচক মন্তব্য করা মানুষদের থেকে দূরে থাকুন। শুধুমাত্র আপনাকে বোঝে এমন মানুষদের শরনাপন্ন হন।
নিজেকে শান্ত করুন ও নতুন বন্ধু পাতানঃ- বিয়ের পরে সঙ্গীর পাশাপাশি তার পছন্দের মানুষগুলির সাথেও সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু বিচ্ছেদের পর সেইসব সম্পর্কে ভাঙন ধরলে তা অত্যন্ত পীড়াদায়ক হয়। চেষ্টা করুন সেইসব সম্পর্ক বজায় রাখার। তবে অনেকক্ষেত্রেই এটি সম্ভব হয়না। তাই নিজেকে শান্ত করুন। বিয়ের আগে আপনার পুরোনো বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করুন। কিংবা নতুন করে বন্ধুত্ব পাতান। প্রয়োজনে-
● পরিচিত কোন স্ব-সহায়ক, সামাজিক গ্রুপে ভলেন্টিয়ার হিসাবে যুক্ত হন।
● কলিগ অথবা পরিচিত মানুষকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করুন।
● নাচ, গান, আর্ট, যোগার ক্লাস জয়েন করুন।
● ডিভোর্স সাপোর্ট গ্রুপে যুক্ত হন।
নিজের সাথে পরিচিত হনঃ- আপনি যতই মনে করুন আপনি নিজের সম্বন্ধে সবকিছু জানেন, তাও বিবাহবিচ্ছেদ আপনার স্বকীয় স্বত্বাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আপনি স্বভাবতই অনুভব করতে পারেন বিয়ের আগেকার স্বত্বার সাথে বিয়ের পরবর্তী স্বত্বার আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে। বিয়ের পরবর্তীকালে আপনি নিজের প্রয়োজনে এবং সঙ্গীর প্রয়োজন মাথায় রেখে নিজের ব্যবহার, দৈনন্দিন জীবনশৈলী, খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, ঘরের কাজ জনিত অনেক পরিবর্তন আনেন। কিন্তু এইসবের ফলে আপনার পুরোনো স্বকীয় স্বত্বা ক্রমশ হারিয়ে যায়। তাই, ডিভোর্সের পর, নিজের পছন্দ অপছন্দ গুলি সম্পর্কে পুনরায় পরিচিত হন। আপনার হারিয়ে যাওয়া স্বত্বা এবং বর্তমান অবস্থার উপর ভিত্তি করে নিজের পছন্দ মতো নিজেকে গড়ে তুলুন।
নতুন রুটিন তৈরী করুনঃ- উদ্দেশ্যহীন জীবন কাটানো যায়না। ডিভোর্সের পরে আপনি সাময়িক দিশেহারা হয়ে পড়েন। এই দিশেহারা ভাব কাটিয়ে উঠতে না পারলে ক্রমশ দীর্ঘস্থায়ী মানষিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়বেন। তাই চিরাচরিত রুটিনে পরিবর্তন আনা খুব জরুরি।
● নিয়ম করে প্রতিদিন শরীরচর্চা করুন।
● বেডটাইম রুটিন তৈরী করুন।
দায়ী করা-ভাবা থেকে বিরত থাকুনঃ- অনেকক্ষেত্রেই বিয়ে ভাঙার পেছনে টক্সিক ও অত্যাচার ছাড়াও আরও নানান কারন দায়ী থাকে। সময়ের সাথে সাথে মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আসে। বিবাহ জনিত স্বর্গীয় অনুভূতি, রোমান্টিক হানিমুন, স্বপ্নের মতো জীবনসঙ্গী সবই তেঁতো অনুভূত হয়, যখন আপনি ক্রমশ বুঝতে পারেন, অপর পাশের মানুষটিকে আপনি পুরোপুরি চিনেননা। আবার অনেক সময় আপনি জীবনকে ঠিকমতো উপভোগ করার আগেই বিয়ে করে ফেলেন। তাই বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেই উপলব্ধিও ক্রমশ আপনার মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারে। যদিও কমিউনিকেশন প্রবলেম ও মতের মিল না হওয়া কখনোই পরোকীয়া ও বিশ্বাসঘাতকতাকে জাস্টিফাই করেনা। এগুলো আসলে ঠিক কী কারনে সমস্যা হয়েছে সেটি পরিষ্কার করে দেয়। তাই বিবাহবিচ্ছেদের জন্য নিজেকে অথবা সঙ্গীকে দায়ী করা থেকে বিরত থাকুন এবং জীবনে এগিয়ে চলুন। এর ফলে আপনি মানষিক ভাবে অনেকটাই হাল্কা অনুভব করবেন।
কো-প্যারেন্টিংঃ- বাবা-মায়ের মধ্যেকার বিচ্ছেদের নেতিবাচক প্রভাব বাচ্চাদের উপর পড়ে। নিজেদের সমস্য নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকার ফলে আপনারা হয়তো খেয়াল করেননা, বাচ্চারা ক্রমশ একাকীত্বের অন্ধকারে চলে যাচ্ছে। তাই, সম্মানজনকভাবে আলোচনা করে বিচ্ছেদ গ্রহন করুন। তাতে আপনাদের মধ্যে তিক্ততা কম থাকবে, যা পারতপক্ষে আপনাদের সন্তানের জন্য মঙ্গলজনক হবে। পরস্পরের প্রতি জেদ ও ঘৃনার মনোভাব ও ডিভোর্সের মানষিক চাপের প্রভাব থেকে সন্তানকে সরিয়ে রাখতে কো-প্যারেন্টিং এর সাহায্য নিন। যেমন-
● দুজনের সাথেই সময় কাটানোর জন্য শিডিউল তৈরি করুন।
● বেডটাইম, হোমওয়ার্ক, অনান্য কার্যক্রমের জন্য রুটিন তৈরি করুন।
● অন্য প্যারেন্টের সাথে থাকার সময় আপনিও যোগাযোগ রাখুন।
● ডিভোর্স ব্যাপারটি তাদেরকে সহজে বুঝিয়ে বলুন।
ফলে, আপনার সন্তান বুঝতে সক্ষম হবে, আপনারা দূরে থাকলেও তাদের প্রয়োজনে তারা মা বাবা দুজনকেই পাবে।
বাচ্চাদের সাথে সময় কাটানঃ- বাচ্চাদের সাথে সময় কাটালে ডিভোর্স পরবর্তী প্রভাব ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। নতুন রুটিনে আপনি যতই ব্যস্ত হন না কেন, নির্দিষ্ট একটি সময় বার করুন সন্তান ও পরিবারের সঙ্গে কাটানোর জন্য। এক্ষেত্রে-
● সপ্তাহের একটি দিন বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতে যান।
● সবাই মিলে একসাথে রান্না করতে পারেন।
● প্রতিদিন সন্ধ্যায় অত্যন্ত আধঘন্টা একত্রে সময় কাটান। বাচ্চারা যদি ডিভোর্সের ব্যাপারে জানতে চায়, সেক্ষেত্রে, বয়স অনুযায়ী যথাসম্ভব সহজ ও সত্যি কারন ব্যাখা করুন।
● শান্ত স্বরে কথা বলুন।
● অপর অভিভাবক সম্পর্কে প্রতি কু মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন।
● বাচ্চাদের বোঝান ডিভোর্সে আপনাদের অথবা ওদের কোন দোষ নেই।
● খুব মন খারাপ হলে প্রয়োজনে তারা অন্য অভিভাবকের কাছে সহজেই যেতে পারে।
![](https://www.healthinside.in/wp-content/uploads/2023/03/care-1.jpg)
নিজের জন্য সময় নিনঃ- একাকীত্বের অভ্যেস না থাকলে একা থাকার চেষ্টা খুব পীড়াদায়ক হয়। চেষ্টা করুন নিজের সাথে সময় কাটিয়ে একাকীত্ব ভুলে থাকার। তবে, তা সম্ভবপর না হলে, প্রয়োজন বুঝে নতুন সম্পর্ক তৈরী করুন। সাধারণত একাকীত্ব ও হৃদয়ের ক্ষত সারানোর জন্য ভালোবাসা ও ঘনিষ্ঠতা জরুরি মনে হলেও, সেক্ষেত্রে সচেতন হন। একটি সম্পর্কের ডিপ্রেশন কাটাতে তৎক্ষণাৎ অন্য সম্পর্কে যুক্ত হওয়া যথোপযুক্ত নয়। সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিন। সব ঠিক মনে হলে অবশ্যই নতুন সম্পর্কে জড়াতে পারেন।
প্রোফেসনাল থেরাপিস্টের সহযোগিতা নিতে পারেনঃ- ডিভোর্স আপনার মানষিক যন্ত্রণা, অবসাদ বাড়িয়ে তোলে। তবে মনোচিকিৎসকের সাহায্যে আপনি যে কোন ধরনের যন্ত্রণা ও অবসাদ গ্রস্ত চিন্তাগুলির সাথে লড়াই করতে সক্ষম হবেন-
● নিজের প্রতি অবিশ্বাস ও সন্দেহ।
● ব্যর্থ হওয়া ভাবনা।
● ডিপ্রেশনের লক্ষন।
● ক্ষোভ ও বিরক্তিকর অনুভূতি।
এছাড়াও থেরাপিস্টের সহায়তায় আপনি অনান্য কয়েকটি বিষয়েও সহায়তা পাবেন। যেমন-
● প্রতিদিনের কাজকর্মে ও সন্তান প্রতিপালনের সমস্যা।
● কর্মক্ষেত্রে নিজের কাজের অমনোযোগী হওয়া।
● নিজের প্রতি যত্নে অনীহা ও আপনজনদের থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে নেওয়া।
অবশেষে, ডিভোর্স সাময়িক ভাবে জীবনের গতিপথকে থামিয়ে দেয়। তবে যেভাবে একটা বই শেষ হলে আমরা অন্য বই পড়া শুরু করি। সেরকমভাবেই, ডিভোর্সের ধাক্কা কাটিয়ে জীবনের গতিপথে আবারও এগিয়ে গেলে নতুন এবং আরও ভালো, সুখী ও আনন্দময় ভবিষ্যত অদূরেই আপনার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। ক্ষত সেরে ওঠার জন্য নিজেকে সময় দিন। ধাক্কা সামলে ওঠে আবারও ধীরে ধীরে পথ চলা শুরু করুন। একসময় আবারও আপনি নিজের স্বকীয় ছন্দে প্রত্যাবর্তন করবেন।