টেস্টোস্টেরন কী? টেস্টোস্টেরন কমে যাওয়ার লক্ষণ এবং ডায়েট এর মাধ্যমে টেস্টোস্টেরন হরমোন বৃদ্ধির উপায়

Published by

টেস্টোস্টেরন হল এক ধরনের  যৌন স্টেরয়েড হরমোন যা একজন পুরুষকে প্রকৃত পুরুষ করে তোলে , অর্থাৎ একজন পুরুষকে প্রজননে অংশগ্রহন করে নিজের বংশানুক্রমিকতা বজায় রাখার  যোগ্য করে তোলে ।  একজন কিশোরের  বয়ঃসন্ধি এর সময় থেকে এই হরমোনের ক্ষরণ দ্রুত হারে বৃদ্ধি হয়ে বিভিন্ন যৌন চরিত্রের বিকাশ ঘটাতে ( সেক্সুয়াল  ডেভেলপমেন্ট )  সাহায্য করে এবং শরীরের স্বাস্থ্য ও সুস্থতা নিয়ন্ত্রনে বিশেষ ভুমিকা রাখে । যদিও এটি পুরুষ প্রধান হরমোনে তবু এটি খুব সামান্য পরিমানে মহিলাদের ওভারি ( ডিম্বাশয় ) থেকেও  উৎপন্ন হয় , তবে এর অতিরিক্ত ক্ষরণ মহিলাদের ব্রন , চুলের. অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, ওজন বৃদ্ধি, অনিয়মিত ঋতুস্রাব এবং বন্ধ্যাত্বের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে । এই হরমোনের কম ক্ষরণে (হাইপোগোনাডিজম ) পুরুষের  ব্যক্তিগত জীবনের পাশাপাশি কর্মজীবনের বিভিন্ন দিক ব্যহত হতে পারে,  অপরদিকে  তুলনামুলক বেশী  ক্ষরণে  যৌন, শারীরিক এবং মানসিকভাবে পরিপূর্ণতার অনুভুতি সৃষ্টি করে ।

টেস্টোস্টেরন কীভাবে উৎপন্ন হয়?

পুরুষদের মধ্যে, টেস্টোস্টেরনের উৎপাদন যৌবনে শুরু হয়, যখন মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন (যা প্রাথমিকভাবে শুক্রাণু উৎপাদনে সাহায্য  করে) এবং লুটিইনিজিং হরমোন (Luteinizing Hormone / LH) নামক হরমোন উৎপাদন শুরু করে। এই (Luteinizing Hormone / LH) হরমোন মানুষের টেস্টোস্টেরন উৎপাদনের প্রক্রিয়াকেও উদ্দীপিত করে। পুরুষদের দেহে মূলত দুটি স্থান থেকে টেস্টোস্টেরন  উৎপন্ন হয় যার ৯৫% টেস্টোস্টেরন testicular interstitial tissue এর মধ্যে থাকা লিডিগ কোষ দ্বারা (Leydig cells)  উৎপাদিত এবং বাকি ৫% টেস্টোস্টেরন  অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকে উৎপন্ন হয় ।

বয়ঃসন্ধিকালে টেস্টোস্টেরনের উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পায় (প্রায় 18-গুণ)। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের শরীরে প্রতিদিন প্রায় 6 মিলিগ্রাম টেস্টোস্টেরন তৈরি হয়। তবে কখনো দেহের অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি অথবা অন্যান্য শারীরিক অবস্থার অবনমনের কারনে টেস্টোস্টেরনের উৎপাদন ব্যহত হতে পারে ।

টেস্টিস থেকে ক্ষরিত  টেস্টোস্টেরনের বেশির ভাগ শরীর ব্যবহার করতে পারে না, এটি লিভার দ্বারা নিস্ক্রিয় হয় এবং কিডনির মাধ্যমে নিস্কাশিত হয় । একজন মানুষের রক্তে থাকা, বেশিরভাগ টেস্টোস্টেরন রক্তের অন্যান্য অণুতে যুক্ত থাকে । টেস্টোস্টেরনের প্রায় ৪৪ % একটি ক্যারিয়ার-প্রোটিনের সাথে শক্তভাবে যুক্ত হয় (একটি প্রোটিন অণু যা অন্যান্য অণুগুলিতে যুক্ত হয় এবং তাদের রক্তে পরিবহন করে) যাকে সেক্স হরমোন বাইন্ডিং গ্লোবুলিন (SHBG) বলে । টেস্টোস্টেরনটি শক্তভাবে যুক্ত হওয়ার কারণে, এটি Sex Hormone Binding Globulin (SHBG) থেকে আলাদা হতে পারে না এবং অন্যান্য অণুগুলির সাথে যুক্ত  হতে পারে না এবং তাই পুরুষের দেহে কোষ  এটি ব্যবহার করতে পারে না। আর এই ব্যবহার হতে না পারা টেস্টোস্টেরন কে নিস্ক্রিয় টেস্টোস্টেরনও বলা হয়  ।

টেস্টোস্টেরনের আরও ৫৪% রক্তের ​​অ্যালবুমিন নামক আরও একটি ক্যারিয়ার প্রোটিনের সাথে আলগাভাবে যুক্ত থাকে। টেস্টোস্টেরন অ্যালবুমিনের সাথে আলগাভাবে যুক্ত হওয়ার সাথে সাথে এটি এই প্রোটিন থেকে পৃথক হয়ে রক্তের অন্যান্য অণুগুলিতে যুক্ত হতে পারে অথবা মানুষের দেহের কোষ দ্বারা ব্যবহৃত হতে পারে।

রক্তে টেস্টোস্টেরনের অবশিষ্ট 2% অন্যান্য অণুতে যুক্ত হয় না, এটি ফ্রি থাকে । আর এই আনবাউন্ড অংশটি ফ্রি টেস্টোস্টেরন নামে পরিচিত ।

মহিলাদের ক্ষেত্রে রক্তস্থিত টেস্টোস্টেরনের প্রায় ৫০% টেস্টোস্টেরন ডিম্বাশয় (ওভারি) থেকে উৎপন্ন হয় এবং বাকি অংশ অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি  থেকে ক্ষরিত হয়। পুরুষের টেস্টিসের মতো মহিলাদের ওভারিও  লুটিইনিজিং হরমোনে (LH) দ্বারা টেস্টোস্টেরন উপাদন কে প্রভাবিত করে । মহিলারা পুরুষদের তুলনায় অনেক কম টেস্টোস্টেরন উৎপাদন করে , তবে এই অল্প পরিমান টেস্টোস্টেরন মহিলাদের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে । মহিলাদের দেহে  ইস্ট্রোজেন উত্পাদন বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত টেস্টোস্টেরনের প্রয়োজন হয় । বলে রাখি,  ইস্ট্রোজেন হল মহিলাদের প্রধান যৌন হরমোন যা ডিম্বস্ফোটন সহ অনেকগুলি প্রজনন কার্য নিয়ন্ত্রণ করে ,তাই মহিলাদের স্বাস্থ্য এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য  এর মাত্রা বজায় থাকাটা প্রয়োজন।

টেস্টোস্টেরন এর স্বাভাবিক মাত্রা কত ?

বিশ্বজুড়ে চিকিৎসকদের দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন সমীক্ষা অনুসারে , রক্তে টেস্টোস্টেরন এর স্বাভাবিক মাত্রা ২৭০ থেকে ১০৭০ ন্যানো গ্রাম প্রতি ডেসি লিটারে । টেস্টোস্টেরন এর মাত্রা জানার জন্য চিকিৎসকরা যে পরীক্ষার কথা বলেন সেটি সকাল ৭টা থেকে ১০টার মধ্যে করতে বলা হয় কারণ এই সময় দিনের অন্য সময়ের তুলনায় টেস্টোস্টেরন এর স্তর ভালো থাকে । যদি কেউ ৫০০-১০০০ ন্যানো গ্রাম প্রতি ডেসি লিটার উৎপন্ন করে  থাকে তাহলে একে টেস্টোস্টেরনের  স্বাভাবিক মাত্রা হিসেবে ধরা হয় ।

মহিলাদের ক্ষেত্রে, সাধারণ টেস্টোস্টেরনের মাত্রা 15 থেকে 70 ন্যানোগ্রাম /ডেসিলিটার ।

টেস্টোস্টেরন এর কাজ কি?

 টেস্টোস্টেরন হল পুরুষের প্রধান যৌন হরমোন , এটি পুরুষের  প্রাইমারী এবং সেকেন্ডারি যৌন বৈশিষ্ট্যগুলোর বিকাশে সাহায্য করে   ।

  • এটি  প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের পেনিসের  এবং টেস্টিসের পূর্ণ বিকাশের জন্য দায়ী । টেস্টোস্টেরনের পর্যাপ্ত ক্ষরণ না হলে পেনিস এবং টেস্টিস এর বিকাশ ব্যহত হতে পারে ।
  • এটি পুরুষদের পিউবিক হেয়ার, মুখে দাড়ি, শরীরে চুল গজাতে এবং গলার স্বর ভারী হতে সাহায্য করে ।
  • টেস্টোস্টেরন শুক্রাণু উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে এবং এর অনুপস্থিতে অথবা অপর্যাপ্ত ক্ষরণে পুরুষদের বন্ধ্যাত্ব হতে পারে ।
  • টেস্টোস্টেরন হরমোন পুরুষের সেক্সড্রাইভ কে প্রভাবিত করে, এর অভাবে পুরুষের যৌনমিলনে অনিহা দেখা দিতে পারে ।
  • এটি পুরুষের যৌন উত্তেজনাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং যৌনমিলনের সময় ইরেক্টাইল টিস্যুগুলির বৃদ্ধি এবং বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

পুরুষের তুলনায় নারীদের দেহে টেস্টোস্টেরনের কার্যকারিতা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা অনেক কম জানেন । তবে বিভিন্ন গবেষনায় দেখা গেছে  পুরুষের মতো  নারীদের যৌন কার্যকলাপ  নিয়ন্ত্রনে টেস্টটোস্টেরনের বিশেষ কার্যকারিতা  রয়েছে । এটি মহিলাদের যৌন ইচ্ছা, যোনি তৈলাক্তকরণ, উত্তেজনা এবং মানসিক সুস্থতা (মেজাজ ) নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । কোনও মহিলার মধ্যে টেস্টোস্টেরনের অভাব একটি মহিলার যৌন এবং প্রজনন কার্যক্রমে যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে পারে। তাছাড়া টেস্টোস্টেরন এর ঘাটতি মহিলাদের অস্টিওপেনিয়া এবং অস্টিওপোরোসিসের জন্যও কম বেশী দায়ী।

পুরুষদের দেহে টেস্টোস্টেরন কমে যাওয়ার লক্ষণগুলি কি?

কিশোর বয়সে এবং যৌবনের প্রথম দিকে টেস্টোস্টেরনের পরিমান সাধারণত সর্বোচ্চ হয় । মোটামোটি ৩০ বছর বয়সের পর থেকে বেশির ভাগ পুরুষের মধ্যে ধীরে ধীরে প্রতি বছর প্রায় ১ শতাংশ হারে টেস্টোস্টেরন এর মাত্রা কমতে থাকে । অত্যধিক পরিশ্রম, গুরুতর অসুস্থতায় ভুগলে এবং অপুষ্টিও  টেস্টোস্টেরন মাত্রা হ্রাসের কারণ হতে পারে যে ক্ষেত্রে  অবশ্যই একজন  ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত ।পুরুষের দেহে টেস্টোস্টেরনের কম ( low testosterone)  হলে যে যে লক্ষণ প্রকাশিত হয় তা হল –

টেস্টোস্টেরন কমে যাওয়ার লক্ষণ
  • যৌনমিলনে অনিহা
  • ইরেক্টাইল ডিস্ফাংশন
  • স্পার্ম কাউন্ট কমে যাওয়া
  • চুল পড়ে যাওয়া
  • ধৈর্যশক্তি কমে যাওয়া
  • দুর্বলতা
  • অস্টিওপোরোসিস
  • পেট সহ বুকে চর্বি জমে যাওয়া (গাইনোকোমাস্টিয়া)

ডায়েট এর মাধ্যমে টেস্টোস্টেরন হরমোন বৃদ্ধির উপায়?

উপরে উল্লেখিত যে কোন ধরনের লক্ষণ দেখাদিলে একজন ভালো ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ওষুধ নিন এবং টেস্টোস্টেরন বর্ধক খাবার দাবার গ্রহন করুন । আপনি যদি কম টেস্টোস্টেরন লেভেলে ভুগছেন তবে কিছু নির্দিষ্ট খাবার রয়েছে যা অল্প সময়ের মধ্যেই টেস্টোস্টেরন লেভেল বাড়িয়ে তুলতে পারে । এদের মধ্যে এখানে কিছু তুলে ধরলাম –

কুমড়ো বীজ

আমাদের বেশিরভাগ পরিবারেই এই কুমড়োর বীজ কে উপেক্ষা করা হয় অনেকটা না জেনেই । এর বীজ  ম্যগ্নেসিয়াম , জিঙ্ক এবং ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিডে সমৃদ্ধ । এই মিনারেলস গুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি  টেস্টোস্টেরন বুস্টিং , প্রোস্টেট  স্বাস্থ্য্, হার্ট এবং লিভার কে ভালো রাখতে কার্যকরী ।

কুমড়ো বীজ

ব্রাজিলিয়ান বাদাম

ব্রাজিলিয়ান বাদামে প্রচুর পরিমাণে সেলেনিয়াম থাকে এবং এতে প্রাকৃতিক কোলেস্টেরলও থাকে। এই উভয় ফ্যাক্টর টেস্টোস্টেরন লেভেল বাড়াতে সাহায্য করে । তাছাড়া এটি দেহের মেটাবলিজম এবং ত্বকের সুন্দরতা বজায় রাখতেও সাহায্য করে ।

আদা

আদা প্রাকৃতিকভাবে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বাড়ানোর জন্য বিশেষ উপকারী । ইরাকে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে,আদা পুরুষদের টেস্টোস্টেরনের মাত্রায় 17% বৃদ্ধি করতে সক্ষম । এটি খুবই সহজে দৈনন্দিন খাবারের মেনুতে যোগ করা যায় কেননা টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বাড়ানো ছাড়াও এর অনেক ঔষধি গুনাগুন রয়েছে ।

আদা

ডিমের কুসুম

ডিমের কুসুম খাওয়া আপনার টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বাড়িয়ে তুলতে পারে, যেহেতু ডিমগুলি খুব পুষ্টিকর ঘন, এবং এই পুষ্টিগুলি আপনার টেস্টোস্টেরনের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাছাড়া হাতের নাগালের মধ্যে অনেক সহজ প্রাপ্ত খাবার রয়েছে যা টেস্টোস্টেরন এর মাত্রাকে বাড়িয়ে তুলে সুন্দর সুস্থ জীবনের পথ দেখাতে পারে এগুলি হল – মিষ্টি আলু, স্ট্রবেরি, নারকেল, দই, ঝিনু্‌ক, গমের ভুসি সহ আটা ইত্যাদি ।

Amarendra Haldar

I belong from Tripura , As a Diet Students always interested in helping people about physical and mental well-being . I am very happy to join as a Health Blogger in Healthinside And hope i Will contribute something good for our readers.

Leave a Comment
Share
Published by

Recent Posts

ব্রঙ্কাইটিস: কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

কাকে বলে ব্রঙ্কাইটিস? ফুসফুসের দু’টি ভাগ রয়েছে। একটি অংশে বাতাসের অক্সিজেন রক্তে মেশে। এই অংশটির…

4 months ago

ডায়াবেটিস রোগীকে কখন দিতে হয় ইনসুলিন?

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা শরীরের সব অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে…

4 months ago

ইউরিক অ্যাসিড কমানোর উপায়

সাধারণত ইউরিক অ্যাসিড বাড়লেই যে চিকিৎসা করাতে হয় এমন নয়। একমাত্র যখন ইউরিক অ্যাসিড থেকে…

4 months ago

কুকুরে কামড়ালে করণীয় কি

পাড়ার রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিলেন বিধুবাবু। হঠাৎ পাড়ার কুকুর কালুর লেজে দিলেন পা! কালুর কী…

4 months ago

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে কী করণীয়

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী? হার্টের চারটি কুঠুরি বা চেম্বার থাকে। ওপরের দু’টি চেম্বার এবং নীচের দু’টি…

4 months ago

ব্রেন স্ট্রোক: এই লক্ষণগুলি থাকলে সতর্ক থাকুন

ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার আগে আগে শরীরে কী কী সঙ্কেত আসে? ব্রেন স্ট্রোক কিন্তু একটা ভয়াবহ…

4 months ago