মানসিক ব্যাধি অনেকরকমের হয়ে থাকে, তবে কিছু ব্যাধি সঠিকভাবে চিকিৎসা না হলে ঝুঁকি বাড়তে পারে, তেমনি একটি রোগ হল স্কিজোফ্রেনিয়া । (স্কিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ কখনও খুব সামান্য আবার কখনও খুব সাঙ্ঘাতিক আকারে প্রকাশ পায়। সহজভাবে বলা যেতে পারে, এই রোগটি অন্যান্য মানসিক সমস্যার মত সাধারন নয় বরং এর পরিণতিও চরম হতে পারে। এই ধরনের রোগে জন্ম নেয় বিভ্রান্তমূলক চিন্তা, মতিভ্রম এবং অহেতুক ভাবনা যা মানুষটিকে চূড়ান্তভাবে উদাসীন করে তোলে। এই রোগে আচরণগত, চারিত্রিকগত অস্বাভাবিকত্ব চোখে পড়ে।
সাধারনত স্কিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia) আক্রান্ত ব্যাক্তির চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী হয়, তবে সমস্যা সাংঘাতিক এবং জটিলতর আকার ধারন করার আগে প্রাথমিক চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীকে কিছুটা সুস্থ রাখা যেতে পারে।
ভারতবর্ষে এই রোগটির প্রকোপ বছরে প্রায় দশ লক্ষ, মুলত ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। টিনেজারদের মধ্যেও এই রোগ এখনের সময়ে দাড়িয়ে কমন হয়ে উঠেছে।
কি কি ভাবে স্কিজোফ্রেনিয়া প্রকাশ পেতে পারে ?
যেহেতু এই রোগটি মানসিক একটি ব্যাধি তাই বিষণ্ণতা, উদাসীনতা, মেজাজ পরিবর্তন ইত্যাদি সাধারনভাবেই দেখা যায়। তবে স্কিজোফ্রেনিয়াতে আক্রান্ত ব্যাক্তির প্রাথমিক লক্ষন হল কথার অসংগতি, কল্পনাপ্রসুত জগতে বিচরণ করা, মানসিক অবসাদ এবং অতিরিক্ত মেজাজের হার পরিবর্তন। বাইপোলার ডিসঅর্ডারও হল একধরনের মানসিক ব্যাধি, কিন্তু এর তুলনায় স্কিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia) অনেক বেশি গুরুতর।
এই ধরনের সমস্যায় আবেগ প্রকাশের আধিক্য, মানসিক অবস্থা পরিবর্তন, মেজাজ পরিবর্তন, অস্বস্তিকর মানসিক পরিস্থিতি ইত্যাদি সমস্যা দেখা যায়।বাস্তবিক জগত থেকে বেরিয়ে মোহকেন্দ্রিক হয়ে ওঠা, যা আকাঙ্ক্ষা বা চাহিদা থাকে সেই প্রেক্ষাপটে নিজেকে দেখতে পাওয়া, নিজেকে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার প্রবনতা এবং কাজের উদাসীনতা বৃদ্ধি পায়। টিনেজাররা এই রোগে আক্রান্ত হলে অবসাদ্গ্রস্থ এবং কর্মে অসক্রিয় হয়ে পড়ে।
উপরোক্ত বিষয় গুলির উপর নির্ভর করে স্কিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia) রোগটিকে ৫ টি প্রকারে বিভক্ত করা যায়;
১। প্যারানয়েড (Paranoid): প্রধানত হ্যালুসিনেশন এবং ডিল্যুসন (Hallucination, Delusion) এই দুইধরনের লক্ষণকে বলা হয় প্যারানয়েড।
২।ক্যাটাটনিক (Catatonic): অস্বাভাবিক অঙ্গভঙ্গি, শিশুসুল্ভ আচরণ করা এইধরনের প্রকারের মধ্যে পড়ে।
৩।হেবেফ্রেনিক (Hebephrenic): শিশুদের মত কথা বলা, কথার অসংগতি এবং কোনো কারণ ছাড়া অতিরিক্ত আবেগ প্রকাশ বা উত্তেজিত হয়ে ওঠা।
৪। আনডিফারেন্সিয়েটেড (Undifferentiated ): এই প্রকারের স্কিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia) কোনো চিকিৎসার দ্বারা নিরাময় সম্ভব না।
৫। রেসিডুয়াল (Residual): কিছু লক্ষণ প্রাথমিকভাবে থাকলেও তা সময় বিশেষে ধীরে ধীরে কম হয়ে আসা।
স্কিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ কি কি হতে পারে ?
স্কিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia) ব্যাধির লক্ষণ মানুষ বিশেষে পরিবর্তিত হতে পারে, কিছুক্ষেত্রে সময় পরিবর্তনের সাথে সমস্যার অবস্থান্তর হয়। লক্ষণ গুলি হলঃ
১) মিথ্যে আশ্বাস এবং ভাবনা যার বাস্তবিক জগতে কোনো অস্তিত্ব নেই, তা নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা এবং সেটা দ্বারা প্রভাবিত হওয়া। অনেকসময় ভয় বা অতিরিক্ত ভাবনার কারণে কেউ ক্ষতি করছে এমন ভাবা, নিজেকে প্রভাবশালী এবং বিত্তশালী মনে করা, কাউকে নিয়ে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখা, কোনো অহেতুক বিষয়ে উতফুল্লিত হয়ে ওঠা ইত্যাদি। অনেকসময় ব্যাতিক্রম চিন্তা বিব্রত করে তুলতে পারে।
২) অনেকসময় আক্রান্ত ব্যাক্তি এমন কিছু শুনতে বা দেখতে পান যা বাস্তবে্ ঘটছেনা, এই ধরনের লক্ষণকে বলা হয় হ্যালুসিনেশন। অনাকাঙ্খিত শব্দ শুনতে পাওয়ার ঘটনাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত
হয়।
৩) কথপোকথনে অসংলগ্নতা, পরিষ্কারভাবে গুছিয়ে কথা বলে উঠতে না পারা এবং অনেক ক্ষেত্রে অর্থহীন কথা, বিষয় বহির্ভূত কথা বলে ওঠা ।
৪) শিশুদের মত আচরণ, স্বাভাবিক আচরণ করতে না পারা, শিশুদের মত অপরিনত কথার ভঙ্গি এবং চালচলন পরিলক্ষিত হয়।
৫) ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থাকা বা অস্বাভাবিক চিন্তায় ভয়ে গুটিয়ে পড়া।
৬) খিদের ইচ্ছা পরিবর্তন হওয়া।
৭) ঘুমের সময় এবং পরিমাণ পরিবর্তিত হয়।
৮) অনেক্ তাড়াতাড়ি এবং গতির সাথে কথা শেষ করে দেওয়া।
১০) অনেক্ষেত্রে আত্মহত্যার চিন্তা জন্ম নেওয়া।
স্কিজোফ্রেনিয়ার উৎস বা সাধারন কারণ কি কি হতে পারে ?
স্কিজোফ্রেনিয়ার সঠিক কারণ এখনও অবধি জানা যায়নি, তবে অনুমান করা হয় জিনগত সমস্যার কারণে মস্তিষ্কের অসংলগ্নতা দেখা যায় এবং তার সাথে পারিপার্শ্বিক অবস্থাও খানিকটা দায়ী। এছাড়াও কিছু অন্যান্য জটিলতার কারনেও এই রোগ দেখা যেতে পারে যেমন গর্ভাবস্থায় সঠিক পুষ্টির অভাব অথবা অনেকসময় জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়া। মস্তিষ্কের অসংগতি অর্থাৎ অ্যাবনরমালিটি পরবর্তীকালে এই রোগের আকার নিতে পারে। ইম্যুনিটি অর্থাৎ অনাক্রম্যতা কম হলে জীবাণু সংক্রমণ হওয়ার সুযোগ বেশি থাকে,এটি কেও স্কিজোফ্রেনিয়ার উৎস বলে ধরা হয়।
যেহেতু এই রোগের সঠিক কারণ সেভাবে জানা যায়নি, তাই কিছু বিষয়কে এই রোগের রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে ধরা যেতে পারে যেমন পরিবারে যদি আগে কারোর এই সমস্যা থেকে থাকে তবে পরবর্তী জেনারেশনে হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। কোনোরকম জন্ম সমস্যা যেমন টক্সিনের সংস্পর্শ, ম্যালন্যুট্রিশন এবং ভাইরাস সংক্রমণ হলে স্কিজোফ্রেনিয়ার প্রকোপ দেখা যেতে পারে।
স্কিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসা কিভাবে হতে পারে ?
শারীরিক আর মানসিক সমস্যার মুল পার্থক্য হল প্রথমটি ওষুধ বা সঠিক ‘মেডিকেসন’ এর দ্বারা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব কিন্তু দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে ওষুধ কতটা কার্যকর হবে তা বলা মুশকিল হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে রোগীর বয়স, ধারণক্ষমতা, রোগের মাত্রার উপর নির্ভর করে। স্কিজোফ্রেনিয়ার ক্ষেত্রেও প্রাথমিক অবস্থাতে ওষুধের প্রয়োগ করা যেতে পারে এবং পদ্ধতিটি একটু সময়স্বাপেক্ষ। এছাড়াও থেরাপি, সামাজিক কার্যকলাপ বা সোশ্যাল অ্যাকটিভিটি, পারিবারিক অবলম্বন অর্থাৎ কাছের মানুষের সহায়তা, তাদের সাথে সময় কাটানো, যেকোনো কাজের মধ্যে লিপ্ত রাখা এগুলোর দ্বারা রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিকে একটি দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার উপর অবলম্বন করতে হয়, যেহেতু বিষয়টি মানসিক তাই ডাক্তারের সংস্পর্শে থাকা শ্রেয়।
স্কিজোফ্রেনিয়া ( Schizophrenia) রোগ প্রতিরোধ করার উপায়
এটি মানসিক ব্যাধির মধ্যে একটি গুরতর সমস্যা, যা এখনও নিয়ন্ত্রণে আনার কোনো উপায় পাওয়া যায়নি। যেহেতু এই রোগের যথাযথ কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি তাই এর প্রতিরোধের উপায় এখনও অজানা। তবে, উপযুক্ত চিকিৎসা, কাউন্সেলিং ও পরিকল্পনার মাধ্যমে এই রোগকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা চেষ্টা করা হয়।