বর্তমানে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কারণে বেশ কিছুকাল আগে থেকেই রাতে সঠিক ঘুম না হওয়ার সমস্যা বাড়ছিল, কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি যে জায়গায় এসে পৌঁছেছে তাতে পর্যাপ্ত এবং খাঁটি ঘুম না হওয়ার ফলে বহু জটিল অসুখের জন্ম হচ্ছে। এমনকি বহু মানুষের জীবনে স্রেফ এই কারণেই দ্রুত দাঁড়ি পড়ে যাচ্ছে। রাতে ঠিক করে ঘুম হয় না এই কথাটা আজকাল প্রায়ই চারপাশে শোনা যায়। আমরা অনেকেই বিষয়টিতে তেমন একটা গুরুত্ব দিই না। কিন্তু রাতে সঠিক মাত্রায় ঘুম না হওয়ার কারণে সারাদিন ক্লান্তি ভাব, মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকা, মাথা ধরে থাকার মত প্রাথমিক সমস্যাগুলো সহজেই নজরে আসে। কিন্তু ধীরে ধীরে এর ভেতরেই দানা বাঁধতে থাকে নানান জটিল সমস্যা। এই পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ার কারণে ডায়াবেটিস ভয়াবহভাবে বেড়ে যায়, ব্লাড প্রেসারের উপর প্রভাব পড়ে। এমনকি হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ব্যাহত হয়। সেই সঙ্গে মস্তিষ্কের সুস্থতার বিষয় তো আছেই। কিন্তু রাতে ঠিক করে ঘুম না হওয়ার এই সমস্যা সহজেই আমরা কাটিয়ে ফেলতে পারি।
রাতে ভালো ঘুমের উপায়গুলি হলঃ
১) দিনের বেলায় যথাসম্ভব উজ্জ্বল আলোয় থাকুন :- আমাদের প্রত্যেকের শরীরের মধ্যেই একটা নির্দিষ্ট বডি ক্লক আছে। সে তার নিজের মত করে বিশ্রামের সময় খুঁজে নেয়। আর সেই অনুযায়ী আমাদের মস্তিষ্ককে সঙ্কেত দিতে থাকে। কিন্তু বর্তমানে চারিদিকে কৃত্রিম আলোর আধিক্যের কারণে অনেক সময়ই শরীরের ভেতরে থাকা সেই বডি ক্লক নষ্ট হচ্ছে। আর তাতেই ঘুমের সমস্যা বাড়ছে। রাতে ভালো ঘুমানোর জন্য দিনেরবেলায় উজ্জ্বল আলোর মধ্যে থাকা খুব জরুরি। আপনি যদি বাড়িতে বা অফিসে থাকেন তবে সেখানে সূর্যের উজ্জ্বল আলো প্রবেশ করলে সবচেয়ে ভালো। না হলে দিনের বেলায় কৃত্রিম উজ্জ্বল আলোর ব্যবস্থা রাখুন যাতে আপনার শরীরের বডি ক্লক সেই সময়টাকে দিনেরবেলা হিসেবে সঠিকভাবে বুঝতে পারে। আবার রাতে ঠিক এর উল্টোটা হতে হবে। তখন উজ্জ্বল আলোর তীব্রতা যথাসম্ভব কমিয়ে ফেলুন। তবেই আপনার শরীরের বডি ক্লক বুঝতে পারবে রাত হয়েছে, এবার বিশ্রাম নিতে হবে।
২) সন্ধ্যে হলেই স্মার্টফোন, ল্যাপটপের নীল আলো কমিয়ে ফেলুন :- রাতে আমাদের ঘুমানোর ক্ষেত্রে বিপুলভাবে সাহায্য করে শরীরের মেলাটোনিন হরমোন। কিন্তু স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ডেক্সটপ থেকে বিচ্ছুরিত হওয়া নীল রং সেই মেলাটোনিন হরমোনের নিঃসরণ কমিয়ে দেয়। ফলে অনিদ্রাজনিত সমস্যা বাড়তে থাকে। তাই রাতে শান্তির ঘুমের জন্য সন্ধ্যে হলেই ল্যাপটপ, ডেক্সটপ, স্মার্টফোনের নীল আলো বিচ্ছুরণের মাত্রা কমিয়ে ফেলতে হবে। আজকাল নানান অ্যাপ পাওয়া যায় যার মাধ্যমে এই ডিভাইসগুলি থেকে নীল আলো বিচ্ছুরণের মাত্রা কমিয়ে ফেলা যায়। এছাড়াও, চোখে নির্দিষ্ট ধরনের চশমা পরেও এই নীল আলোকে আটকানো সম্ভব। এছাড়াও ভালো ঘুমের জন্য শুতে যাওয়ার অন্ততপক্ষে ২ ঘণ্টা আগে থেকে আর টিভি দেখা বা এই ধরনের ডিভাইস নিয়ে নাড়া ঘাঁটা না করাই ভালো। সেক্ষেত্রে আপনার ঘুমের উন্নতি হবেই।
৩) রাতের দিকে কফি জাতীয় জিনিস খাবেন না :- কফির মূল উপাদান হল ক্যাফেইন। এই ক্যাফেইন ক্রীড়াবিদ থেকে শুরু করে সমস্ত মানুষের এনার্জি লেভেল বাড়িয়ে দেয়। ফলে আমরা অনেক বেশি কাজ করতে পারি। কিন্তু রাতের দিকে কফি খেলে আপনার এনার্জি যেমন বেড়ে যায় তেমনই মস্তিষ্ক অতিরিক্ত সজাগ হয়ে পড়ে। যা আপনাকে ঘুমোতে দেয় না। তাই রাতে ভালো ঘুমোতে হলে সন্ধ্যের পর কফি বা ক্যাফেইন সমৃদ্ধ কোনরকম খাবার খাওয়া বন্ধ করতে হবে।
৪) দিনে দীর্ঘ সময় ন্যাপ নেওয়া চলবে না :- অনেকেই ভাবেন দুপুরে ন্যাপ অর্থাৎ ভাতঘুম নিলে রাতে ঘুম হয় না। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। বরং প্রতিদিন নিয়ম করে নির্দিষ্ট সময়ে ৩০ মিনিটের ন্যাপ নিলে রাতে ঘুম আরও ভালো হয়। কিন্তু সেই ন্যাপের সময় ৩০ মিনিটের বেশি হলেই রাতে আপনার ঘুমের সমস্যা হতে থাকবে। কারণ সেক্ষেত্রে আপনার শরীরে থাকা বডি ক্লক বিভ্রান্ত হয়ে পড়বে, সে বুঝতে পারবে না এটা রাত না দিন। এছাড়াও বিশেষজ্ঞরা অনিয়মিত ন্যাপের অভ্যেসকে ত্যাগ করতে বলছেন। হঠাৎ করে আপনি কোনদিন ন্যাপ নিচ্ছেন আবার কোনদিন নিচ্ছেন না, এতে ঘুমের সমস্যা আরও বাড়ে।
৫) নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমোতে যান এবং উঠুন :- ভালো ঘুমের জন্য গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকা অত্যন্ত খারাপ অভ্যাস। চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতিদিন সকালে তাড়াতাড়ি ওঠার অভ্যাস করুন। তাতে সার্বিকভাবে আপনার নিদ্রাজনিত সমস্যা অনেকটাই কমবে। অ্যালার্ম ঘড়ি ব্যবহারে পরিবর্তে প্রতিদিন রাতে নির্দিষ্ট সময় ঘুমানো এবং সকালে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট সময়ে ওঠা অভ্যাস করতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাতে শরীরে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অনেক ভালোভাবে কাজ করবে, যা ঘুমকে আরও গাঢ় করে তোলে। কারণ শরীর তবেই বুঝতে শিখবে, তার এখন ঘুমোনোর সময় হয়েছে এবং কখন তার উঠে পড়ার টাইম।
৬) ভালো ঘুমের জন্য মেলাটোনিন সাপ্লিমেন্ট নিতে পারেন :- আমাদের ঘুমের ক্ষেত্রে মেলাটোনিন সাপ্লিমেন্ট দুর্দান্ত কাজ করে। মাত্র ২ মিলিগ্রামের মেলাটোনিন সাপ্লিমেন্ট আপনার অনিদ্রাজনিত সমস্যাকে অনেকটাই দূর করে দিতে পারে। চিকিৎসকরাও বহু ক্ষেত্রে ভালো ঘুমের জন্য এই সাপ্লিমেন্ট নিতে বলেন। তবে আমেরিকার মত দেশে যে কেউ চাইলেই এই মেলাটোনিন সাপ্লিমেন্ট নিতে পারেন। কিন্তু ভারতে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া এই সাপ্লিমেন্ট বিক্রি হয় না। আপনার অনিদ্রাজনিত সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে মেলাটোনিন সাপ্লিমেন্ট নিন। সেক্ষেত্রে শুতে যাওয়ার ১ ঘণ্টা আগে এই সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করলে আপনার ঘুম আরও ভালো হবে।
৭) মদ্যপান এড়িয়ে চলুন :- বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে মদ্যপানের প্রবণতা ক্রমশই বাড়ছে। সমস্ত দিক থেকেই মদ্যপান শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক। আর ঘুম নষ্ট করে দেওয়ার ক্ষেত্রে তা ভয়াবহ। অনেকেই ভাবেন রাতে শোয়ার আগে মদ্যপান করলে দারুন ঘুম হবে। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। মদ্যপানের কারণে শরীরের মেলাটোনিন হরমোন নিঃসরণ ব্যাহত হয়। ফলে আপনি ঘুমোলেও সেই ঘুমের গুণগত মান উন্নত হয় না। এর জন্য অনিদ্রাজনিত অসুখ বাড়তে থাকে। বিশেষ করে সন্ধ্যের পর মদ্যপান করলে ঘুমের সমস্যা আরও বাড়বে।
৮) বেডরুমের পরিবেশ ভালো রাখুন :- অনেকে বিশ্বাস করেন বেডরুমের পরিবেশের উপর ঘুম কেমন হবে তা নির্ভর করে। বিশেষজ্ঞরাও এই মতের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। তাঁরা জানিয়েছেন, বেডরুমের তাপমাত্রা, সেখানে বাইরে থেকে কতটা শব্দ প্রবেশ করে, দেওয়ালের রং, আসবাবপত্রের গঠন এগুলো মানুষের ঘুমের উপর গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। যদি কোনও বেডরুমে বাইরে থেকে অনেক বেশি শব্দ প্রবেশ করে তবে ঘুমোতে সমস্যা হবে। এছাড়াও বেডরুমের তাপমাত্রা ঘুমের ক্ষেত্রে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বেডরুমে অত্যধিক গরম থাকলে কখনওই ভালো ঘুম হতে পারে না। ঘুমানোর জন্য বেডরুমের আদর্শ তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
৯) বেশি রাত করে খেলে ঘুমের সমস্যা হবে :- অনেকেই রাতে খেয়ে উঠে শুতে চলে যান। এটা অত্যন্ত ক্ষতিকারক অভ্যাস। এই কারণেই ঘুমের সমস্যা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশি রাত করে খাওয়া চলবে না। সেইসঙ্গে রাতে যত ভারি খাবার খাবেন ততই অনিদ্রাজনিত সমস্যা বাড়বে। সবচেয়ে ভালো হয়, সন্ধ্যের পর এমন সময়ে ডিনার করুন যাতে রাতে তার ৪ ঘণ্টা পর ঘুমোতে যেতে পারেন। তাহলে ঘুম খুব ভালো হবে। কারণ হজম প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঘুমের ওতোপ্রত সম্পর্ক আছে।
১০) নিজের মনকে হালকা এবং জটিলতা মুক্ত রাখুন :- উপরে যে সমস্ত প্রক্রিয়ার কথা বলা হল সেগুলি আপনি হুবহু মেনে চললেও আপনার ভালো ঘুম নাও হতে পারে, যদি আপনার মন শান্ত না থাকে। ভালো ঘুমের জন্য সবার আগে দরকার শান্ত ও উদ্বেগহীন মন। এর জন্য সন্ধ্যের পর থেকে আর কোনরকম জটিল কথাবার্তা না বলার চেষ্টা করুন। সেই সঙ্গে চেষ্টা করুন উদ্বেগজনক পরিস্থিতি এড়িয়ে গিয়ে মনকে হালকা রাখতে। তাহলেই দেখবেন অনেকটা কাজ হয়ে গিয়েছে। আপনার অনিদ্রাজনিত সমস্যা দূর হয়ে ধীরে ধীরে ভালো ঘুম হচ্ছে।