Search
Close this search box.

পারকিনসন্স ডিজিজ (Parkinson Disease) কি? এই রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা– অংশুলা ব্যানার্জী

শরীরের স্নায়ুতন্ত্রের এক ধরনের ব্যাধি হল পারকিনসন্স ডিজিজ (Parkinson Disease)। এই রোগের ক্ষেত্রে রোগলক্ষন খুব ধীরে ধীরে শুরু হয়, কখনও কখনও কেবলমাত্র হাতে হাল্কা কাঁপুনি ছাড়া আর কোনো লক্ষন দেখাই যায় না। কাঁপুনি ছাড়াও নড়াচড়ায় আড়ষ্টভাব, শক্তভাব ও নড়াচড়া আস্তে আস্তে কমে যাওয়া এই রোগের ক্ষেত্রে প্রধানত দেখা যায়। রোগের একদম প্রথম দিকে মুখের অভিব্যক্তিতে কোনো তেমন পার্থক্য দেখা যায় না। হাঁটার সময় হাতের দুলুনি বন্ধ হয়ে যায়, কথা জড়িয়ে যায়। এই রোগের লক্ষনগুলি সময়ের সাথে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। যদিও এই রোগ কখনোই সারে না, তবে চিকিৎসার মাধ্যমে এর রোগলক্ষনগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। কখনও কখনও ব্রেনের বিশেষ বিশেষ অংশের অস্ত্রোপচার করেও রোগলক্ষনের উপশম ও উন্নতির প্রচেষ্টা করা হয়।

পারকিনসন্স ডিজিজের লক্ষন

পারকিনসন্স ডিজিজের রোগলক্ষনগুলি এক একজন মানুষের ক্ষেত্রে এক একরকম হয়ে থাকে। প্রথম দিকের লক্ষনগুলি প্রায়ই বোঝা যায় না। শরীরের একটা দিক আগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সেই দিকটার অবস্থাই বেশি খারাপ থাকে। শরীরের অন্য দিকটাও আক্রান্ত হয়। এই রোগের প্রাথমিক লক্ষনগুলি হল—

  • গন্ধ পাওয়ার ক্ষমতা কমে যাওয়া (anosmia)
  • কোষ্ঠকাঠিন্য
  • ছোটো ভাঙা ভাঙা হাতের লেখা
  • স্বর বদলে যাওয়া
  • দেহকাঠামো ঝুঁকে যাওয়া
  • বিশ্রামকালে কোনো বিশেষ অঙ্গে কাঁপুনি
  • নড়াচড়ার গতি মন্থর হয়ে যাওয়া
  • হাত, পা ও শরীরের উপরিভাগের অনমনীয়তা
  • শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে সমস্যা হওয়া ও পরে যাওয়া

পরবর্তীতে আরও যে যে লক্ষনগুলি দেখতে পাওয়া যায়, সেগুলি হল—

  • মুখের অভিব্যক্তি মিলিয়ে যায়
  • হাঁটতে হাঁটতে পা আটকে যায়
  • কথা জড়িয়ে যাওয়া
  • চোখের পাতা পরা ও খাবার গিলতে সমস্যা হওয়া
  • পেছন দিকে পড়ে যাওয়ার প্রবনতা
  • হাঁটার সময় হাতের দুলুনি বন্ধ হয়ে যাওয়া

সমস্যা আরও গুরুতর হলে যে যে লক্ষনগুলি দেখতে পাওয়া যায়, সেগুলি হল—

  • ত্বকের তৈলাক্ত অংশের ওপর সাদা বা হলদেটে রঙের আঁশের মতো তৈরি হয়, একে Seborrheic dermatitis বলে।
  • মেলানোমা নামক স্কিন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে
  • ঘুমে ব্যাঘাত হওয়া এবং তার সাথে বিভিন্ন প্রকারের অনেক স্বপ্ন, ঘুমের ভেতর কথা বলা, নড়াচড়া করা
  • অবসাদ
  • উদ্বেগ
  • হ্যালুসিনেশন
  • মনঃসংযোগ ও স্মৃতিশক্তিতে সমস্যা

পারকিনসন্স ডিজিজের প্রথম দিকের রোগ লক্ষনগুলি সহজে ধরা পড়ে না।

পারকিনসন্স ডিজিজের কারণ

এই রোগের সঠিক কারণ এখনও অজানা। বংশগতি ও প্রকৃতির নানা উপাদান এর জন্য দায়ী হতে পারে। কোনো বিষাক্ত রাসায়নিকের সংস্পর্শের ফলও এটা হতে পারে। কোনো বিজ্ঞানী মনে করেন যে কোনো ভাইরাসের আক্রমণও এর কারণ হতে পারে। Lewy bodies নামক একপ্রকার অস্বাভাবিক প্রোটিন পারকিন্স ডিজিজের রোগীদের মস্তিষ্কে পাওয়া গেছে।

কোন ধরনের মানুষদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ?

  • মহিলাদের থেকে পুরুষেদের দেড়গুন বেশি এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
  • আফ্রিকান–আমেরিকান ও এশিয়ানদের তুলনায় শেতাঙ্গরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হন।
  • ৫০–৬০ বছরের মানুষের ভেতরই এই রোগ বেশি হয়ে থাকে। ৪০ বছর বয়সের আগে কেবলমাত্র ৫–১০% মানুষের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • পরিবারের নিকট আত্মীয়ের এই থাকলে তখন আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
  • কিছু বিশেষ বিশেষ বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে আসাও এই রোগের একটা কারণ বলে মনে করা হয়।
  • যে সমস্ত মানুষেরা মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাদের পারকিনসন্স ডিজিজে বেশি আক্রান্ত হতে দেখা গেছে।
পারকিনসন্স ডিজিজের বিভিন্ন স্টেজ বা পর্যায়গুলি কি কি ?  

এই রোগের ক্ষেত্রে সময়ের সাথে সাথে রোগলক্ষনগুলি বাড়তে থাকে। অনেক ডাক্তাররা Hoehn & Yahr স্কেল ব্যবহার করেন এই রোগের পর্যায় পরিমাপের জন্য। এই স্কেলের মাধ্যমে রোগলক্ষনগুলিকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়, ফলে রোগটি কতদূর এগিয়েছে সেটা চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন।

 প্রথম পর্যায়

এই পর্যায়ের রোগলক্ষন এতটাই কম থাকে যেতা সাধারণত বোঝাই যায় না ফলে তা দৈনন্দিন জীবনে কোনো প্রভাবও ফেলে না। যে সামান্য রোগলক্ষনগুলি দেখা যায়, তা শরীরের এক দিকেই সীমাবদ্ধ থাকে।

দ্বিতীয় পর্যায়

প্রথম পর্যায় থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ে যেতে কখনো কয়েক মাস এবং বছরও লেগে যায়। এই স্টেজের রোগলক্ষনগুলি হল—

  • মাংস পেশির শক্তভাব
  • কাঁপুনি শুরু হওয়া
  • মুখের অভিব্যক্তির পরিবর্তন

মাংস পেশির শক্ত ভাবের জন্য সাধারণ কাজগুলো করতেও অনেক বেশি সময় লাগতে শুরু করে। যদিও এই পর্যায়ে ভারসাম্য হারিয়ে পরে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা যায় না। শরীরের দুই দিকেই রোগলক্ষন প্রকাশ পেতে শুরু করে এবং মুখের অভিব্যক্তির পরিবর্তন নজরে আসে।

তৃতীয় পর্যায়

এই স্টেজে রোগলক্ষনগুলি উল্লেখযোগ্য ভাবে নজরে আসে। যদিও নতুন রোগলক্ষন তৈরি হয় না। সিম্পটমসগুলি এই সময় দৈনন্দিন জীবনে সমস্যা তৈরি করতে শুরু করে।

শরীরের নড়াচড়া চোখে পড়ার মতো কমে যায়। ভারসাম্য বজায় রাখাও কঠিন হয়ে যায়, ফলে রোগী প্রায়ই পড়ে যায়। যদিও পারকিনসন্স ডিজিজের তৃতীয় পর্যায়েও রোগী কারোর তেমন সাহায্য ছাড়াই নিজের কাজ নিজে করে নিতে পারে।

চতুর্থ পর্যায়

এই পর্যায়ের পরিবর্তন ভীষণ ভাবেই লক্ষ্য করা যায়। ওয়াকার বা অন্য যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া হাঁটাচলা করা ও দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। মাংস পেশির নড়াচড়া উল্লেখযোগ্য ভাবে ধীর গতির হয়ে পড়ে এবং একা একা থাকা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়।

পঞ্চম পর্যায়

এই স্টেজে রোগলক্ষন সবথেকে বিপজ্জনক ভাবে প্রকাশ পায়। প্রতিমুহূর্তের চলা ফেরার জন্য সাহায্যের প্রয়োজন হয়। দাঁড়াতে পারাও কঠিন হয়ে পড়ে। হুইলচেয়ারের সাহায্য এইসময় একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই সময় রোগী হ্যালুসিনেট করতে শুরু করেন এবং confusion, delusion এর মতো সমস্যা দেখা যায়।

পারকিনসন্স ডিজিজ নির্ণয়ের নির্দিষ্ট কোনো পরীক্ষা নেই। CAT Scan, MRI করা হয় শরীরের অন্যান্য সমস্যা নির্ধারণ করার জন্য। Dopamine Transporter scan ও করা হয়। এই পরীক্ষাগুলোর কোনোটাতেই পারকিনসন্স ডিজিজ ধরা পড়ে না, তবে শরীরের অন্যান্য সমস্যা ধরা পড়ে, যার ফলে ডাক্তারদের পারকিনসন্স ডিজিজ নির্নয় করতে সুবিধা হয়।

পারকিনসন্স ডিজিজের চিকিৎসা

পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম, সুষম খাদ্য এবং এক্সারসাইজ করতে দেওয়া হয় রোগীকে। স্পিচ থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, ফিজিক্যাল থেরাপি করা হয় যাতে রোগী কথা বলা ও মুভমেন্টকে নিয়ন্ত্রন করতে পারেন। ওষুধের মাধ্যমে রোগের ফলে হওয়া মানসিক ও শারীরিক সমস্যাগুলি কে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

Levodopa এর মাধ্যমে ৭৫% ক্ষেত্রেই ভালো ফল মেলে। এটি পারকিনসন্স ডিজিজের সবথেকে কমন ট্রিটমেন্ট Dopamine agonists ব্রেনে ডোপামিনের কাজ কে নকল করে Anticholinergics ব্যবহার করা হয় প্যারাসিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম কে আটকানোর জন্য

সার্জারি

প্রধানত দুই ধরনের সার্জারি করা হয় —

Deep Brain Stimulation

এই সার্জারির সময় ব্রেনের বিভিন্ন অংশে ইলেকট্রোড ইমপ্লান্ট করা হয়। এর মাধ্যমে রোগলক্ষন কে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা হয়

Pump–delivered therapy

এর মাধ্যমে Levodopa & Carbidopa এর মিশ্রন প্রেরণ করা হয়। এর জন্য অপারেশন করে ক্ষুদ্রান্তের কাছে একটি পাম্প স্থাপন করা হয়।

কিছু দরকারী কথা

  • সাবধানে হাঁটতে হবে এবং হাঁটার সময় পায়ের গোড়ালি আগে মাটিতে স্পর্শ করাতে হবে
  • হাঁটার সময় কোনো জিনিস বহন করা উচিৎ নয় এবং পিছনের দিকে স্টেপ ফেলা যাবে না
  • পিছনে ফেরার জন্য সম্পূর্ণ U–turn নিতে হবে
  • সহজে পরা যায় ও খোলা যায় এমন জামাকাপড় পরতে হবে
  • বোতাম এর বদলে চেন দেওয়া জামাকাপড় পরা দরকার
  • যোগার মাধ্যমে ফ্লেক্সিব্লিটি ও মোবিলিটি বাড়ানো যায়
  • অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট, ওমেগা–৩ সমৃদ্ধ খাদ্য ও ফাভা বিনস (যা levodopa সমৃদ্ধ) খাদ্য তালিকায় অবশ্যই রাখতে হবে।
সাবস্ক্রাইব করুন

স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন খবর, তথ্য এবং চিকিৎসকের মতামত আপনার মেইল বক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন.

Table of Contents

আমাদের সাম্প্রতিক পোষ্ট গুলি দেখতে ক্লিক করুন

আমাদের বিশিষ্ট লেখক এবং চিকিৎসক