Search
Close this search box.

এন্ডোমেট্রিওসিস এবং অ্যাডেনোমায়োসিস – বন্ধ্যাত্ব ছাড়াও অনেক জটিলতার কারণ

পিরিওডের সময়ে ব্যথা ও অতিরিক্ত রক্তপাত এবং ক্রমাগত তলপেটে (পেলভিক অঞ্চলে) ব্যথা এন্ডোমেট্রিওসিস এবং অ্যাডেনোমায়োসিস বলে অভিহিত ইউটেরাসের দুই গুরুতর সমস্যারই উপসর্গ হ’তে পারে। এই দুই সমস্যা কখন হয়, একটু জেনে নিই।

এন্ডোমেট্রিওসিস

ইউটেরাসের ভেতরের প্রাচীরকে বলে এন্ডোমেট্রিয়াম। এন্ডোমেট্রিয়ামের কোষগুলি কখনো কখনো অস্বাভাবিক হারে বংশবিস্তার করে এবং ইউটেরাসের (জরায়ু) বাইরে গজাতে শুরু করে। মাসিক ঋতুচক্র বা পিরিওডের সময় ইউটেরাসের বাইরে গজিয়ে ওঠা এই সব কোষ থেকে পেলভিক অঞ্চল এবং সেটিকে ছাড়িয়ে অন্যান্য জায়গাতেও রক্তপাত হ’তে পারে। তার ফলে সিস্ট এবং স্কার টিস্যু বা ক্ষতের ওপর কোষ জমাট বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

অ্যাডেনোমায়োসিস

এন্ডোমেট্রিয়ামের কোষগুলো ইউটেরাস বা জরায়ুর বাইরে না গজিয়ে জরায়ুর পেশীগুলোর ভেতর অবধি ছড়িয়ে পড়লে সেই সমস্যাকে অ্যাডেনোমায়োসিস বলা হয়। অ্যাডেনোমায়োসিস এবং এন্ডোমেট্রিওসিস এক ধাঁচের ব্যাধি হলেও দুটির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পার্থক্য আছে। সেগুলি নিয়ে এখানে আলোচনা করা হ’ল।

এন্ডোমেট্রিওসিস হলে এন্ডোমেট্রিয়ামের কোষগুলি (টিস্যু) ইউটেরাস থেকে বেরিয়ে ব্ল্যাডার, বাওয়েল অথবা অন্যান্য অঙ্গে গজাতে থাকে। অন্য দিকে অ্যাডেনোমাইসিস হ’লে এন্ডোমেট্রিয়ামের টিস্যু ইউটেরাসের নরম পেশী মায়োমেট্রিয়ামের ভেতরে ঢুকে যায়। ইউটেরাসের বাইরের এবং ভেতরের প্রাচীরের মাঝামাঝি মায়োমেট্রিয়ামের অবস্থান। মায়োমেট্রিয়ামে একবার গেঁথে যাওয়ার পরে ঠিক তখনই এন্ডোমেট্রিয়ামের এই টিস্যু থেকে রক্তপাত হতে থাকে যখন এন্ডোমেট্রিয়ামের অবশিষ্ট অংশ থেকে পিরিওডের রক্তপাত শুরু হয়। এর ফলে অতিরিক্ত রক্ত পড়ে, ব্যথা হয় এবং অসহ্য যন্ত্রণা হয়।

এন্ডোমেট্রিওসিস এবং অ্যাডেনোমায়োসিস এর উপসর্গ

এন্ডোমেট্রিওসিস এবং অ্যাডেনোমায়োসিস দুটি সমস্যার ক্ষেত্রেই সাধারণ উপসর্গ হ’ল ব্যথা। অ্যাডিনোমায়োসিস হ’লে সাধারণত পিরিওডের সময়ে ব্যথা হয়। এছাড়া লার্জ ইনটেসটাইনের ওপরে এবং ভেতর পর্যন্ত এন্ডোমেট্রিওসিস ছড়িয়ে পড়লে পিরিওড চলাকালীন ব্যথার সঙ্গে মলত্যাগের সময়েও ব্যথা হ’তে পারে।

অ্যাডেনোমায়োসিস হ’লে পিরিওডের ব্যথাই সবচেয়ে বড় কষ্ট যা রোগিণীর জীবনযাত্রাকেও প্রভাবিত করে। তার কারণ এই সমস্যা ইউটেরাসের অনেক ভেতর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।

দুটি ক্ষেত্রেই আবার অনেক সময় আলাদা করে উপসর্গ টের পাওয়া যায় না। অ্যাডেনোমায়োসিস থাকা সত্বেও মোটের ওপর এক তৃতীয়াংশ নারী কোনও উপসর্গই টের পান না।

এন্ডোমেট্রিওসিস-এর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই রকম। বিভিন্ন মেয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে এর উপসর্গ দেখা দেয়। কোনও কোনও মেয়ের সঙ্গী হয় পুুরনো ব্যথা, ঘুরেফিরে প্রত্যেক মাসে তলপেটে ব্যথা আর অস্বাভাবিক রক্তপাত। একই সমস্যায় কোনও কোনও মেয়ের সন্তানধারণে অসুবিধা সৃষ্টি হয়। অন্য দিকে কোনও কোনও মেয়ের এই সমস্যা থাকা সত্বেও কোনও উপসর্গ দেখা দেয় না।

রোগ নির্ণয়

তলপেটে ব্যথা এবং পিরিওডের অস্বাভাবিক যন্ত্রণা- এ দু’টি এন্ডোমেট্রিওসিস এর অন্যতম উপসর্গ। সাধারণত এ দুটির ভিত্তিতেই বেশিরভাগ চিকিৎসক ইঙ্গিত পেয়ে যান যে রোগিণীর এই সমস্যা হয়েছে। তা সত্বেও নিশ্চিত ভাবে এন্ডোমেট্রিওসিস নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকেরা ল্যাপারোস্কোপি নামে সার্জারির নিদান দেন। এই প্রক্রিয়ায় তলপেটে একটি ছোট ছিদ্র করে ভেতরে একটি সরু টিউব ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এই টিউবের শেষ প্রান্তে আলো এবং ক্যামেরা লাগানো থাকে। এই ক্যামেরার মাধ্যমে এন্ডোমেট্রিয়ামের লেসিয়ন, সিস্ট (পিন্ড) এবং জমাট বাঁধা কোষ চোখে পড়ে। তারপরে সেগুলিকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়।

অ্যাডেনোমায়োসিস নির্ণয় করতে হলে তলপেটের অতটা গভীরে নিরীক্ষণ করার দরকার হয় না। ম্যাগনেটিক রেসোনান্স ইমেজিং (এম আর আই) টেস্ট করে বোঝা যায় মায়োমেট্রিয়াম স্বাভাবিকের চেয়ে পুরু হয়ে গেছে কিনা। মনে রাখতে হ’বে যে মায়োমেট্রিয়ামের পুরুত্ব অ্যাডেনোমায়োসিস- এর অন্যতম লক্ষণ। এম আর আই এবং ট্রান্সভ্যাজাইনাল আলট্রাসাউন্ড করেও বোঝা যায় ইউটেরাসের প্রাচীরে কোনও সিস্ট হয়েছে কিনা। মায়োমেট্রিয়ামের গঠনে কোনও অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি হয়ে থাকলে তাও এই দু’টি টেস্ট থেকে বোঝা যায়। মাত্র কয়েকটি সিস্ট ছাড়া আর কোনও অস্বাভাবিকতা চোখে না পড়লে সমস্যাটিকে ফোকাল অ্যাডেনোমায়োসিস বলা হয়। পুরো ইউটেরাস বরাবর মায়োমেট্রিয়ামে অস্বাভাবিকত্ব চোখে পড়লে ডাক্তারি পরিভাষায় সমস্যাটিকে ডিফিউজ অ্যাডেনোমায়োসিস বলা হয়ে থাকে।

বন্ধ্যাত্ব এবং এন্ডোমেট্রিওসিস এবং অ্যাডেনোমায়োসিস

এন্ডোমেট্রিওসিস এবং অ্যাডেনোমায়োসিস দুটি ক্ষেত্রেই সন্তানধারণে সমস্যা তৈরি হ’তে পারে। এ সব ক্ষেত্রে গর্ভসঞ্চার এবং সন্তানকে ন’ মাস গর্ভে ধরে রাখতে বাধা আসতে পারে।

বিশেষ করে অ্যাডেনোমায়োসিস হ’লে, বড় হয়ে যাওয়া এবং শক্ত ইউটেরাসে ভ্রূণ ঠিক মতো এঁটে থাকতে বাধা পায়। ফলে বহু ক্ষেত্রেই গর্ভস্থ ভ্রূণ মরে যায়। কৃত্রিম প্রজনন বা ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (আই ভি এফ) – এর ক্ষেত্রে যে সব মেয়ের শুধু অ্যাডেনোমায়োসিস হয় তাঁদের গর্ভপাত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। যারা অ্যাডেনোমায়োসিস এবং এন্ডোমেট্রিওসিস দুটি সমস্যাতেই আক্রান্ত তাঁদের আই ভি এফ করে গর্ভসঞ্চার হলে যে হারে গর্ভপাতের আশঙ্কা তার দ্বিগুণ আশঙ্কা শুধু অ্যাডিনোমায়োসিসে আক্রান্তদের।

এছাড়া সন্তানধারণের জন্য অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাকটিভ থেরাপি (আর্ট) এর সহায়তা নেওয়ার সময়েও অ্যাডেনোমায়োসিসে আক্রান্ত মেয়েদের গর্ভসঞ্চারের হার কম কিন্তু গর্ভপাতের হার বেশি।

এই দুটি সমস্যার জেরে সৃষ্ট বন্ধ্যাত্বের সমস্যার ক্ষেত্রে আইভিএফ প্রক্রিয়ায় সন্তান না পেলে গোনাডোট্রোপিন প্রোটোকল চিকিৎসার সহায়তা নেওয়া হতে পারে।

এই প্রক্রিয়ার সাহায্যে প্রোজেস্টেরোন এবং ইস্ট্রোজেন সহ প্রজননে সহায়ক হরমোনগুলির উৎপাদন নিয়ন্রণ করা হয়। ইউটেরাসের ভেতরে কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি আটকে দেওয়াই এই চিকিৎসা পদ্ধতির উদ্দেশ্য।

সার্জারি
ইউটেরাস থেকে সিস্ট বা যে কোনও অস্বাভাবিক বৃদ্ধি কেটে বাদ দেওয়ার জন্য সার্জারি করা যেতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে সার্জারির মাধ্যমে ইউটেরাস নতুন করে গড়ে দেওয়াও সম্ভব। অ্যাডেনোমায়োসিস থেকে বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি হয়েছে এমন মেয়েদের ক্ষেত্রে সার্জারি করার পর স্বাভাবিক গর্ভসঞ্চারের হার বেড়ে যায়।

এছাড়া ড্রাগ প্রোটোকল আই ভি এফ-এর সাফল্য বাড়িয়ে দেয়।

তবে অ্যাডেনোমায়োসিস-এর সমস্যা কতটা ছড়িয়েছে এবং সিস্ট কতটা বড় তার ওপরে নির্ভর করে ডাক্তারদের এগোতে হয়। অ্যাডেনোমায়োসিসের প্রকট সমস্যায় অনেক মেয়েকে সন্তান ধারণ করার জন্য সারোগেট মাদার বা গর্ভদাত্রীর সাহায্য নিতে হয়।

চিকিৎসা নিয়ে বলতে হ’বে যে দুটি অসুবিধার ক্ষেত্রেই একইভাবে রোগ সারানো হয়। জন্ম নিয়ন্ত্রক বড়ি থেকে শুরু করে সার্জারি সব কিছুই করতে হ’তে পারে। সার্জারি করে সিস্ট, ক্ষতিগ্রস্ত কোষ এমন কী দরকার মতো পুরো ইউটেরাস বাদ দেওয়া হয়।

জন্ম নিয়ন্ত্রক বড়ি এবং সার্জারির মাঝামাঝি হরমোন থেরাপি করা যায়। হরমোনে ভরপুর কিছু ওষুধ সেবন করলে ইস্ট্রোজেন হরমোনের উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া যায়। মনে রাখতে হ’বে যে ইস্ট্রোজেন অ্যাডেনোমায়োসিস এবং এন্ডোমেট্রিওসিস- দু’টি সমস্যাকেই তীব্র করে তোলে। ইনজেকশন, হরমোনাল আই ইউ ডি অথবা পিল (বড়ি) ইত্যাদির মাধ্যমে শরীরে এমন সব হরমোন ঢুকিয়ে দেওয়া যায় যেগুলি ইস্ট্রোজেন ক্ষরণ কমিয়ে দেয়।
হরমোন থেরাপি করলে ইউটেরাসের এই দু’টি সমস্যার ক্ষেত্রেই পিরিওডের সময়ে অসহনীয় ব্যথা, সহবাসকালীন যন্ত্রণা এবং তলপেটের নিত্যসঙ্গী ব্যথার অনেকটা উপশম হয়।

এন্ডোমেট্রিওসিস বা অ্যাডেনোমায়োসিস, রোগিণীর যে সমস্যাই হোক না কেন, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পরীক্ষানিরীক্ষা করে বলে দেবেন কোন চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করতে হ’বে।

সাবস্ক্রাইব করুন

স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন খবর, তথ্য এবং চিকিৎসকের মতামত আপনার মেইল বক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন.

Table of Contents

আমাদের সাম্প্রতিক পোষ্ট গুলি দেখতে ক্লিক করুন

আমাদের বিশিষ্ট লেখক এবং চিকিৎসক