হেপাটাইটিস বি কি ছোঁয়াচে রোগ? ভাইরাস দ্বারা কিভাবে আক্রান্ত হয় মানুষ এই রোগে! নিম্নলিখিত আলচনায় সবটাই জানুন এবং পাশাপাশি অন্যদের জানাতে সাহায্য করুন।
হেপাটাইটিস বি কি?
হেপাটাইটিস বি হল একরকমের লিভার ইনফেকশন যা হেপাটাইটিস ভাইরাসের ( HBV) কারণে হয়ে থাকে। HBV হল পাঁচ প্রকারের ভাইরাল হেপাটাইটিসের মধ্যে একটি। অন্যান্য প্রকারগুলি হল A, C, D, E। প্রতিটি ভাইরাস আলাদা আলাদা প্রকৃতির। এর ভেতরে B ও C হলে ক্রনিক হয়ে থাকে।
প্রতিবছর ভারতবর্ষে প্রায় ১.৫ লক্ষ মানুষ মারা যায় এবং ৬০ মিলিয়ন মানুষ ভাইরাল হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে B ও C ভাইরাসে বেশি মানুষ আক্রান্ত হন। একে “সাইলেন্ট কিলার” বলা হয়, কারণ ৮০% মানুষই তার ইনফেকশনের ব্যাপারে জানতে পারে না।
প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অ্যাকিউট হেপাটাইটিসের লক্ষণ বেশি দেখা যায়। যেসব শিশুরা জন্মের সময় হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়, তাদের বেশিরভাগেরই অ্যাকিউট হেপাটাইটিস হয়ে থাকে। সাধারণত সব হেপাটাইটিস বি ইনফেকশনই ক্রনিক হয়ে থাকে।
ক্রনিক হেপাটাইটিস বি ধীরে ধীরে শরীরে ছড়ায় এবং অবস্থা ক্রিটিকাল না হওয়া পর্যন্ত রোগলক্ষণ খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না।
হেপাটাইটিস বি কি ছোঁয়াচে রোগ?
হেপাটাইটিস বি খুবই ছোঁয়াচে! আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত ও শরীর থেকে নির্গত অন্যান্য দেহ-রস থেকে দ্রুত এই রোগ ছড়ায়। যদিও এই ভাইরাস মুখের লালায় থাকে, কিন্তু একই বাসনপত্র ব্যবহার বা চুম্বনের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায় না। একই ভাবে হাঁচি, কাশি ও স্তন্যপানের মাধ্যমেও এই ভাইরাস ছড়ায় না। ভাইরাসের সংস্পর্শে (এক্সপোজার) আসার তিন মাসের ভেতর রোগলক্ষণ প্রকাশ নাও পেতে পারে এবং শরীরে ২—১২ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। যদিও তখনও রোগীর থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে এবং শরীরের বাইরে এই ভাইরাস সাতদিন পর্যন্ত জীবিত থাকে।
কিভাবে এই রোগ ছড়াতে পারে তার উপসর্গগুলি হল —
- সংক্রমিত রক্তের সাথে সরাসরি সংস্পর্শে আসলে
- জন্মের সময় মায়ের থেকে শিশুর শরীরে
- সংক্রমিত ছুঁচ থেকে
- HBV আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে যৌন সম্পর্ক করলে
- রেজার বা অন্যান্য ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিসে যদি সংক্রমিত ফ্লুইড থাকে, তা অন্য কেউ ব্যবহার করলে
কাদের হেপাটাইটিস বি তে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি?
- হেলথকেয়ার ওয়ার্কার্স
- যেসব পুরুষেরা অপর পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্ক করে
- একের অধিক যৌনসঙ্গী থাকলে
- যাদের ক্রনিক লিভার ডিজিজ আছে
- কিডনির অসুখ আছে এমন ব্যক্তি
- ৬০ বছরের ঊর্ধ্বের ব্যক্তি যাদের ডায়াবেটিস আছে
- যেসব দেশে HBV এর অতিরিক্ত সংক্রমণ আছে, সেইসব জায়গায় গেলে
হেপাটাইটিস বি রোগের লক্ষণ
অ্যাকিউট হেপাটাইটিস এর রোগলক্ষণ যদিও অনেক মাস পর্যন্ত দেখা যায় না, তবুও এই রোগের সাধারণ রোগলক্ষণগুলি হল—
- ক্লান্তি
- গাঢ় রঙের মূত্র
- অস্থিসন্ধি ও পেশিতে যন্ত্রণা
- খিদের অভাব
- জ্বর
- পেটের গন্ডগোল
- দুর্বলতা
- চোখের সাদা অংশ এবং ত্বক হলুদ রঙের হয়ে যাওয়া
যদি মনে হয় কেউ হেপাটাইটিস বি সংক্রমণের সংস্পর্শে আসে তাহলে দ্রুত তাকে চিকিৎসককে সেটা জানাতে হবে, তাহলে ইনফেকশন থেকে বাঁচা যেতে পারে।
হেপাটাইটিস বি কিভাবে পরীক্ষা করা হয় ?
চিকিৎসকেরা খুব সাধারণ রক্তপরীক্ষার মাধ্যমেই হেপাটাইটিস বি নির্ণয় করতে পারেন। স্ক্রিনিং তাদের জন্য করা দরকার, যারা —
- হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছে
- হেপাটাইটিস বি এর প্রচুর সংক্রমণ হয়েছে এমন জায়গায় বেড়াতে গেছে
- কারাগারে থেকেছে
- কিডনি ডায়ালিসিস হয়েছে
- গর্ভবতী
- HIV আক্রান্ত
হেপাটাইটিস বি এর স্ক্রিনিং এর জন্য চিকিৎসক একাধিক রক্তপরীক্ষা করবেন।
হেপাটাইটিস বি সারফেস অ্যান্টিজেন টেস্ট
এই পরীক্ষাটি চিকিৎসক করবেন রোগী সংক্রমিত কি না তা বোঝার জন্য। যদি টেস্ট রেজাল্ট পজিটিভ হয় তাহলে সেই ব্যক্তি হেপাটাইটিস বি তে আক্রান্ত এবং তার মাধ্যমে রোগটি ছড়িয়ে পড়বে। যদি রেজাল্ট নেগেটিভ হয় তাহলে সেই মূহুর্তে সেই ব্যক্তির ভেতর হেপাটাইটিস বি নেই। এই টেস্টে অ্যাকিউট ও ক্রনিক হেপাটাইটিস এর মধ্যে পার্থক্য করা হয় না।
হেপাটাইটিস বি কোর অ্যান্টিজেন টেস্ট
বর্তমানে কোনো ব্যক্তি হেপাটাইটিস বি তে আক্রান্ত কি না তা বোঝার জন্য এই টেস্ট করা হয়। রেজাল্ট পজিটিভ হওয়ার অর্থ সেই ব্যক্তি অ্যাকিউট বা ক্রনিক হেপাটাইটিসে আক্রান্ত। অবশ্য কোনো ব্যক্তি যখন অ্যাকিউট হেপাটাইটিস থেকে সেরে উঠছে তখনও এই টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ হয়।
হেপাটাইটিস বি সারফেস অ্যান্টিবডি টেস্ট
এই টেস্ট করা হয় HBV এর প্রতিরোধ ক্ষমতা শরীরে তৈরি করা হয়েছে কিনা তা জানার জন্য। যদি টেস্ট রেজাল্ট পজিটিভ হয় তাহলে বোঝা যাবে যে হেপাটাইটিস বি এর বিরুদ্ধে শরীরে ইমিউনিটি তৈরি হয়েছে। কারোর যদি হেপাটাইটিস বি এর ভ্যাকশিন নেওয়া থাকে বা সে অ্যাকিউট হেপাটাইটিস বি থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছে তাহলেও টেস্ট রেজাল্ট পজিটিভ হয়।
লিভার ফাংশন টেস্ট
হেপাটাইটিস বা অন্য যেকোনো লিভার ডিজিজের জন্য লিভার ফাংশন টেস্ট করাটা খুব দরকারী। এই টেস্টে দেখা হয় যে রক্তে লিভার থেকে তৈরি এনজাইম কি কি এবং কতটা পরিমানে রয়েছে। এনজাইমের পরিমান বেশি হওয়ার অর্থ লিভার ড্যামেজ হয়েছে অথবা লিভারে প্রদাহ তৈরি হয়েছে। লিভারের কোন অংশ সঠিকভাবে কাজ করছে না, তাও এই পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যায়।
এইসব টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ হলে হেপাটাইটিস B, C বা অন্যান্য লিভার ইনফেকশনের পরীক্ষা করতে হবে। হেপাটাইটিস বি ও সি সারা পৃথিবীতে হওয়া লিভারের সংক্রমণের প্রধান কারন। এ ছাড়াও লিভারের আল্ট্রাসাউন্ড ও অন্যান্য পরীক্ষা করতে হয়।
হেপাটাইটিস বি রোগের চিকিৎসা
হেপাটাইটিস বি ভ্যাক্সিনেশন এবং ইমিউনোগ্লোবিউলিন
যদি এমন মনে হয় যে কেউ গত ২৪ ঘন্টার ভেতর হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছে তাহলে যত দ্রুত সম্ভব তাকে চিকিৎসকের সাথে দ্রুত যোগাযোগ করতে হবে। যদি আপনি এখনও হেপাটাইটিস বি ভ্যাক্সিন না নিয়ে থাকেন তাহলে ইনফেকশন থেকে বাঁচার প্রধান রাস্তা হল ভ্যাক্সিন নিয়ে নেওয়া এবং ইমিউনোগ্লোবিউলিন ইঞ্জেকশন নেওয়া। এর ফলে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় তা হেপাটাইটিস এর বিরুদ্ধে কাজ করে।
হেপাটাইটিস বি এর চিকিৎসা পদ্ধতি
অ্যাকিউট হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হলে সাধারণত কোনো বিশেষ চিকিৎসার দরকার হয় না। রোগী নিজে থেকেই সেরে যায়। তবে বিশ্রাম ও বেশি পরিমানে পানীয় গ্রহণ করলে রোগের দ্রুত নিরাময় সম্ভব হয়।
অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ ক্রনিক হেপাটাইটিস এর চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। এটা ভাইরাসের সাথে লড়াই করতে সাহায্য করে এবং ভবিষ্যতের লিভার সমস্যা থেকে রক্ষা করে।
যদি লিভার অতিরিক্ত পরিমানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে তাহলে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করার প্রয়োজন হয়।
ক্রনিক হেপাটাইটিস বি হলে কি কি সমস্যা হয়?
- হেপাটাইটিস বি ইনফেকশন
- লিভার সিরোসিস
- লিভার ফেলিওর
- লিভার ক্যান্সার
- মৃত্যু
হেপাটাইটিস ডি একমাত্র সেইসব ব্যক্তির ভেতরই হতে পারে যারা হেপাটাইটিস বি তে আক্রান্ত।
কিভাবে হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধ করা যায়?
হেপাটাইটিস বি কে আটকানোর প্রধান পদ্ধতিই হল ভ্যাক্সিনেশন। সমগ্র সিরিজটা পূরন করতে তিনটি ভ্যাক্সিনের প্রয়োজন হয়। যাঁরা এই ভ্যাক্সিন নেবেন তাঁরা হলেন —
- জন্মের পরেই সমস্ত শিশু
- সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি যাদের জন্মের পর ভ্যাক্সিন নেওয়া হয়নি
- প্রাপ্তবয়স্ক যারা সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়েছে
- যেসব মানুষেরা তাদের কর্মসূত্রে সরাসরি রক্তের সংস্পর্শে আসে
- HIV পজিটিভ ব্যক্তি
- যেসব পুরুষেরা অন্য পুরুষ সঙ্গীর সাথে যৌন সঙ্গম করেছে
- যাদের একাধিক যৌন সঙ্গী থাকে
- ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে যারা ড্রাগ নেয়
- পরিবারের কেউ হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত হয়ে থাকলে
- হেপাটাইটিস বি এর সংক্রমণ বেশি হয়েছে এরকম স্থানে গেলে
এককথায় বলতে গেলে সবারই উচিৎ ভ্যাক্সিন নেওয়া। এছাড়া যৌন সঙ্গীকে হেপাটাইটিস বি টেস্ট করাতে বলা, ড্রাগের ব্যবহার বন্ধ করা এবং দেশের বাইরে কোথাও বেড়াতে গেলে সেই জায়গায় হেপাটাইটিস বি এর সংক্রমণ আছে কিনা সেটা জানা এবং ভ্যাক্সিনের সম্পূর্ণ ডোজ কমপ্লিট করতে হবে। এইভাবে আমরা হেপাটাইটিস বি কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি।