হাড় ও মাংসপেশীর ব্যাধির কারণ হিসাবে দায়ী ঘটনাগুলির মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণটির নাম হল ফাইব্রোম্যালজিয়া। তাও বেশিরভাগ সময়েই এই রোগটির নির্ণয় ও চিকিৎসায় ভুল হয়ে থাকে। এর প্রধান লক্ষ্মণই হল মাংসপেশী ও অস্থিসন্ধিতে যন্ত্রণা এবং ক্লান্তি। এই রোগের থেকে পুরোপুরি মুক্তি কখনই পাওয়া সম্ভব নয়, তবে ওষুধ, শরীর চর্চা, স্ট্রেস কম রাখা এবং সুঅভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে রোগলক্ষনক প্রশমিত রেখে একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায়।
ফাইব্রোম্যালজিয়ার কারণ
ডাক্তাররা এখনও এই রোগের সঠিক কারণ সম্বন্ধে নিশ্চিত নন, তবে মনে করা হয় যে সমস্যাটা নিহিত আছে আমাদের মস্তিষ্ক ও সুষুম্নাকাণ্ড কিভাবে স্নায়ু থেকে যন্ত্রনার অনুভূতি তৈরি করছে, তার ওপর। যে যে পরিস্থিতিতে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় সেগুলো হল—
আপনি একজন মহিলা
আর্থারাইটিস অথবা অন্য কোনো যন্ত্রণাদায়ক সংক্রমণ (ইনফেকশন) আছে।
এছাড়া ফাইব্রোম্যালজিয়ার সম্ভাব্য কারণগুলি যেভাবে ব্যাখ্যা করা যায় সেগুলি হল—সংক্রমণ (Infection)পূর্বের কোনো রোগ ফাইব্রোম্যালজিয়ার সম্ভাবনা ও লক্ষন আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে। ফ্লু, নিউমোনিয়া, খাদ্যনালীর ইনফেকশন যেগুলো Salmonella এবং Shigella bacteria এর কারণে হয়ে থাকে এবং Epstein–Barr ভাইরাস — এদের সবার ফাইব্রোম্যালজিয়ার সাথে সংযোগ আছে।বংশগতি (Hereditary)পরিবারে কারোর এই রোগ থাকলে অন্য সদস্যেরও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।ট্রমা (আঘাত)যে সমস্ত মানুষরা ভীষণ শারীরিক ও মানসিক আঘাতের শিকার হয়েছেন, তাঁরা এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এই অবস্থাটা Post Traumatic Stress Disorder এর সাথে সম্বন্ধিত থাকে।চাপ (Stress)স্ট্রেসের ফলে শরীরে হরমোনের উৎপাদন অস্বাভাবিক হয়ে যায় এবং এটিকেও একটি কারন হিসাবে ধরা হয়।এছাড়া মনে করা হয় যে কোনো কারণে যদি স্নায়ু শরীরের যন্ত্রনার অনুভূতি অধিক পরিমাণে করতে শুরু করে তখন ফাইব্রোম্যালজিয়ার যন্ত্রনা শুরু হয়ে যায়। আগে যে যন্ত্রনাগুলো রোগী অনুভব করতেন না সেগুলো অনুভব করা শুরু করে দেন। মস্তিষ্কও যন্ত্রনার অনুভূতিতে অতিসংবেদনশীল হয়ে পড়ে।
ফাইব্রোম্যালজিয়ার লক্ষন
সাধারণ ভাবে বলতে গেলে সারা শরীরে যন্ত্রণা হওয়া। এছাড়া আরও লক্ষণগুলি হল—
মাংসপেশিতে যন্ত্রনা, জালাভাব ও মোচড় দেওয়া মতো অনুভূতি
অস্থিসন্ধির চারপাশে আঙুল দিয়ে চাপ দিলে ব্যাথা অনুভব করা
অস্বাভাবিক ক্লান্তি
মনে রাখা, বা চিন্তা করায় সমস্যা তৈরি হওয়া, যাকে ‘fibro fog’ বলা হয়।
ইনসোমনিয়া, অর্থাৎ ঘুম না আসা
সবসময় চিন্তিত, অবসন্ন থাকা
পেট ব্যাথা, পেট ফুলে থাকা, কোষ্ঠকাঠিন্য অথবা ডায়রিয়া
মুখ, চোখ ও নাক শুষ্ক হয়ে থাকা
মাথা যন্ত্রণা
ঠান্ডা, গরম, আলো ও শব্দে অনুভূতি বেশি হওয়া
হাত, পা, মুখের নানা জায়গা অসার হয়ে থাকা
অস্টিওআর্থারাইটিস, টেণ্ডিনাইটিস এর লক্ষনগুলির সঙ্গে কখনো কখনো ফাইব্রোম্যালজিয়ার লক্ষণগুলি গুলিয়ে যায়, তবে শরীরের বিশেষ কোনো যায়গায় যন্ত্রনার বদলে এই রোগের ক্ষেত্রে সারা শরীর জুড়ে যন্ত্রনা হয়ে থাকে।
ফাইব্রোম্যালজিয়ার রোগ নির্ণয়
ডাক্তারবাবু নানা ধরনের পরীক্ষা করবেন এবং সেই সাথে পূর্বে হওয়া অন্যান্য রোগ এবং পরিবারে অন্য কারোর এই রোগ আছে কিনা সেই ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। এই রোগ নির্ণয়ের জন্য কোনো নির্দিষ্ট পরীক্ষা নেই। যেহেতু এই রোগের লক্ষণের সাথে অন্যান্য রোগের লক্ষণের অনেক মিল আছে তাই চিকিৎসক থাইরয়েড, নানা রকমের আর্থারাইটিস ও লুপাস রোগ এবং প্রদাহ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন রক্তপরীক্ষা, এম.আর.আই ও এক্স–রে করে থাকেন।
ফাইব্রোম্যালজিয়া ট্রিগার পয়েন্টস
আগেকার দিনে যদি মানুষের শরীরের বিশেষ বিশেষ ১১— ১৮ টা জায়গায় ব্যাথা থাকতো, তাহলে মনে করা হত যে সেই ব্যক্তি ফাইব্রোম্যালজিয়ায় আক্রান্ত। চিকিৎসকরা সেই পয়েন্ট গুলোর ওপর জোরে চাপ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতেন যে কোন কোন জায়গায় যন্ত্রণা আছে। ট্রিগারপয়েন্টগুলো হল—
মাথার পেছন দিক
কাঁধের উপর দিক
বুকের উপরিভাগ
নিতম্ব
হাঁটু
কনুইয়ের বাইরের দিক
তবে বর্তমানে চার–পাঁচটি ট্রিগার পয়েন্টে ব্যাথা থাকলে এবং সেই ব্যাথার অন্য কোনো কারণ নির্ণয় করা না গেলে তা ফাইব্রোম্যালজিয়া হিসাবে ধরা হয়।ফাইব্রোম্যালজিয়ার কারণে যন্ত্রণা
ফাইব্রোম্যালজিয়ার প্রধান লক্ষনই হল যন্ত্রণা। শরীরের বিভিন্ন মাংসপেশী থেকে শুরু করে শরীরের নরম টিস্যুগুলোতে যন্ত্রনা হয়। এই যন্ত্রনা সামান্য থেকে শুরু করে বাড়তে বাড়তে একেবারে সহ্যসীমার বাইরেও চলে যায়।বুকে যন্ত্রণা
ফাইব্রোম্যালজিয়ার কারণে যখন বুকে যন্ত্রণা হয়, তখন এর সাথে হার্ট অ্যাটাকের যন্ত্রনার প্রায় পার্থক্য করাই যায় না। যে কার্টিলেজগুলো আমাদের পাঁজরের সাথে বুকের হাড়ের সংযোগ স্থাপন করে প্রধানত সেই কার্টিলেজগুলোতেই যন্ত্রনাটা হয় এবং যন্ত্রনাটা কাঁধে ও হাতেও ছড়িয়ে পড়ে।
পিঠে যন্ত্রনাপিঠে আমাদের নানা কারণে যন্ত্রনা জয়ে থাকে। সেটা ফাইব্রোম্যালজিয়া নাকি অন্য কোনো কারণ তা বোঝা তাই অনেক সময় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ব্রেইন ফগ বা ক্লান্তির মতো অন্যান্য লক্ষন থেকে বোঝার চেষ্টা করা হয় পিঠের যন্ত্রনার কারন ফাইব্রোম্যালজিয়া কি না। ফাইব্রোম্যালজিয়ায় শরীরের অন্যান্য অংশের ব্যাথা কমানোর জন্য যে ওষুধ ব্যবহার করা হয় পিঠের যন্ত্রনার ক্ষেত্রেও সেই ওষুধই ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন স্ট্রেচিং ও স্ট্রেনদেনিং এক্সারসাইজের মাধ্যমে পিঠের পেশী ও টিস্যু গুলিকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হয়।
পায়ের যন্ত্রণা
ফাইব্রোম্যালজিয়ার কারণে পায়ের পেশী ও নরম টিস্যুগুলো তে যন্ত্রনা হয়। এই যন্ত্রনা অনেকটা পেশীতে টান লাগা অথবা আর্থারাইটিসের ব্যাথার মতো হয়ে থাকে। কখনো কখনো অসাড়তা ও মোচড় দেওয়ার মতো অনুভূতিও হয়। কখনো কখনো পাগুলো খুব ভারী মনে হয়, যেন ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চায়।
ফাইব্রোম্যালজিয়ার চিকিৎসা
চিকিৎসক রোগলক্ষন দেখে চিকিৎসা করে থাকেন। পেনরিলিভার, অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট, মাসল রিলাক্সার ইত্যাদি ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়। যে তিনটি ওষুধ প্রধানত ফাইব্রোম্যালজিয়ার যন্ত্রনার জন্য দেওয়া হয় সেগুলি হল—
Duloxetine (Cymbalta)
Milnacipran (Savella)
Pregabalin (Lyrica)
প্রতিদিনের নিয়মিত এক্সারসাইজ হল ফাইব্রোম্যালজিয়া কে নিয়ন্ত্রনে রাখার একমাত্র উপায়। স্ট্রেচিং এর সাথে সাথে শরীরের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও পেশীকে শক্তিশালী করার এক্সারসাইজ করা দরকার। শরীরের মুভমেন্ট ঠিক রাখার জন্য যোগা, তাই-চি এমনকি হাঁটাহাঁটিও খুব ভালো কাজ করে। এছাড়া এক্সারসাইজের ফলে এন্ডরফিন নির্গত হয়, যা যন্ত্রনা ও স্ট্রেস কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে, যার ফলে ভালো ঘুম হয়। যন্ত্রণা ও স্ট্রেস কমাতে মাসাজ, আকুপাংচার ও ক্যারিওপ্র্যাকটিকের মতো পদ্ধতিরও সাহায্য নেওয়া যায়।
Hello, I am Anshula Banerjee, completed my post-graduation degree in English, along with Bachelor of Education. I live at Nadia. I am a voracious reader in various fields of knowledge that may help the readers to satisfy their urge specially in the area of health and wellness.